ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২

মাসুদ রানা আশিক

গল্প ॥ সম্পর্ক

প্রকাশিত: ০০:০৭, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২

গল্প ॥ সম্পর্ক

সম্ভবত দ্বিতীয়বারের মতো বিপদে পড়লাম। কিছুটা পিছিয়ে এলাম আমি। একটা দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খেলাম সজোরে। ওয়াক করে একটা শব্দ হলো মুখ দিয়ে। ব্যথায় কুঁকড়ে ফেললাম মুখ। সবেমাত্র সন্ধ্যা হয়েছে। দিনের উজ্জ্বলতা নিভিয়ে দিয়ে এসেছে রাতের আঁধার। নগরের নিয়ন বাতিগুলো জ্বলজ্বল করছে। নিয়ন আলোতে আমাকে স্পষ্ট দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু আমি চাচ্ছি আড়াল হতে। খুব ভাল হতো, যদি ছোট কোন গলিপথ পাওয়া যেত। তাহলে পালিয়ে যেতে পারতাম। অন্তত একটা অনাকাক্সিক্ষত বিড়ম্বনা থেকে তো রেহাই পেতাম। দুর্ভাগ্যবসত আমি আশপাশে গলিপথ পেলাম না। বুঝতে পারলাম আজও হয়তোবা ঝামেলা পোহাতে হবে আমাকে। তারপরও নিজেকে আড়াল করার জন্য রাস্তার পাশে থাকা একটা ভাজাপোড়া খাবার বিক্রেতার পেছনে গিয়ে বসে পড়লাম। বিক্রেতার পেছনে বসে পড়াতে সে খুব অবাক হলো। আমার ভয়ার্ত চেহারার দিকে তাকাল সে একবার। বেশ কড়া গলায় বলল, ‘রাস্তায় কি কোন বাঘ দেখছেন যে আমার এখানে এসে লুকাতে হবে? আর আপনে কি পোলাপান? এভাবে লুকায় কেউ! যেন লুকোচুরি খেলছেন কারও সঙ্গে।’ আমি আমার একটা আঙ্গুল নিজের মুখে দিয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, চুপ থাকুন। কিন্তু তিনি বুঝলে তো। বিক্রেতা তার নিজের মতো করে কথা বলেই যাচ্ছে। অবশেষে আমি বেশ ক্ষীণ স্বরে বললাম, ‘আপনি একটু চুপ থাকুন। আমি আপনাকে একটু পর সব বোঝাচ্ছি। ওই মহিলাটা চলে যাকে আগে। না হলে আমি বড় একটা বিপদে পড়ব। যে কোন মুহূর্তে হামলে পড়তে পারে বিপদ।’ আমার কথা শুনে বিক্রেতা চুপ থাকল। তবে তার কৌতূহল কমল না। সে একবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে তাকায়, আরেকবার আমার দিকে তাকায়। আমি ওভাবেই মাথা নিচু করে বিক্রেতার পেছনে বসে আছি। মহিলাটি এখনও আমার কাছ থেকে বেশ দূরেই। বয়সের তুলনায় শরীরটা এখনও বেশ শক্তই বলা যায়। কথাতেও কোন জড়তা নেই। সম্ভবত চোখেও সমস্যা নেই তাঁর। চোখে সমস্যা থাকলে চশমা থাকত। কিন্তু চশমা নেই। আর আমাকেও অনেক দূর থেকেই মহিলাটি দেখতে পেত না। তিনি আমাকে খুঁজছেন। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মহিলাটি। চোখের পলকে আমাকে একবার দেখেছেন। তারপরই তো আমি নিজেকে আড়াল করে নিলাম। কোথায় লুকিয়েছি সেটা তিনি আর দেখতে পাননি। পেলে নিশ্চয়ই এখানে চলে আসতেন। মহিলাটি নড়ছে না। ঠায় দাঁড়িয়ে শুধু এদিক ওদিক দেখছে। আজ মহিলাটির সঙ্গে এক বয়স্ক লোককেও দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত মহিলাটির স্বামী উনি। লোকটি মহিলাটিকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। কিন্তু তিনি যাচ্ছেন না। উনারা কিছু একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। আমি ঠিক এখান থেকে বুঝতে পারছি না। আমি নড়তেও পারছি না বিক্রেতার পেছন থেকে। বিক্রেতা আমাকে বার বার সরে যেতে বলছে। কিন্তু আমি সরছি না। কারণ ওই মহিলা। কোনভাবেই মহিলাটির সামনে পড়তে চাচ্ছি না। চাচ্ছি না আজও কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটুক। এর আগে যেমন একবার ঘটেছে। প্রথম যেদিন মহিলাটির সঙ্গে আমার দেখা হয় সেদিনও মনের বিরুদ্ধে বাইরে বের হয়েছিলাম। সেদিন সবেমাত্র শহরে এসেছি আমি। তখনই মহিলাটি আমাকে খপ করে ধরে ফেললেন। আমি প্রথমে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলাম। ‘ও মাগো’ বলে চিৎকার করেছিলাম দুইবার। তাকিয়ে দেখি এক বয়স্ক মহিলা। তিনি আমাকে এভাবে কেন ধরলেন ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। চোখ দুটো ছলছল করছিল তখন। তিনি হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরেন। আমি তখন কিছুটা ভড়কে যাই। কী যে এক বিড়ম্বনায় পড়লাম, ভাবছিলাম তখন। চেষ্টা করেছিলাম নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার। কিন্তু পারছিলাম না। মহিলাটি বয়স্ক হলে কী হবে, শক্তি ছিল বেশ। তিনি নিজেই আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার চোখ-মুখ মুছে দিয়ে বললেন, ‘আহারে অনেক কালো হয়ে গেছিস তুই। ভাল করে গোসলও করিস না বোধহয়। তুই আমাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলি, বল তো? তোকে কত যে খুঁজেছি। পুরো দেশে তোকে খুঁজেছি। আমি তো জানি তোর প্রিয় ঠিকানা হলো নানা বাড়ি। আমি মনে করেছিলাম ওখানেই তুই আছিস। সেখানে গেলাম। পেলাম না। তুই থাকতে পারিস এমন সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেছি। কোন জায়গাতেই তোকে পাওয়া গেল না। মা-বাবাকে এভাবে কষ্ট দিয়ে সন্তান পালিয়ে থাকতে পারে, বল! আমি তোর বাবার সঙ্গে চ্যালেঞ্জ করে বলেছি, তুই কোথাও লুকিয়ে আছিস। আমাদের সঙ্গে অভিমান করে লুকিয়ে আছিস। যখনই অভিমান ভাঙবে তুই ফিরে আসবি। আমার কথা তোর বাবা বিশ্বাসই করল না। আমি তো জানি তুই এমনই। আমি পেটে ধরেছি, আর আমি জানব না? আহারে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছিস তুই। ভালভাবে খাওয়াও হয় না বুঝি! এই, তুই কথা বলছিস না কেন? ওভাবে হাবার মতো তাকিয়ে আছিস, কথা বল। আমি তোর মা বলছি রে, মা। তোকে আমি পেটে ধরেছি। চল, বাড়িতে চল। তোর বাবা বেশ সারপ্রাইজড হবে। তোর বাবাও তো কষ্ট পায়। যদিও আমার মতো এত হয়তোবা নয়। তুই দুই বুড়ো বুড়িকে কষ্ট দিয়ে কী লাভ পাচ্ছিস বল তো? তোর জন্য আরও একটা সুখবর আছে। আমি তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে। আমি আমার বউমাকে পছন্দ করে তোর বাবাকে বললাম, ‘দেখো তো আমাদের তাওরাত বিল্লার জন্য মেয়েটা পারফেক্ট না?’ তোর বাবা উত্তরই দিল না! শুধু চেয়ে থেকে দু’চোখের পানি ফেলল। আমি তো জানি এটা আনন্দের কান্না। ছেলের জন্য সুন্দর বউ নিয়ে আসার কান্না। তোর বাবাটা আসলেই একটা নিরামিষ। বিয়ের পর থেকেই তো দেখছি। আজ পর্যন্ত পরিবর্তন হলো না। ছেলের জন্য বাবা মায়ের একটা দায়িত্ব আছে না। বাড়িতে গিয়ে দেখবি তোর রুম আমি কত সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছি। তোর রুমের চেয়ার টেবিলগুলো সব ঝকঝকে এখনও। ওই রুমটা সারাদিন বন্ধই থাকে। আমিই মাঝে মাঝে যাই। আমি জানি তোর অভিমান ভাঙবে। তুই আবার আমার কোলে ফিরে আসবি। আমাদের যত আত্মীয়-স্বজন আছে, সবাইকে বলেছি, ‘আমাদের তাওরাত বিল্লা লুকিয়ে আছে। আমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে যে কোন সময় বাড়ি ফিরে আসবে।’ মহিলাটি কথা বলছিল আর আমি ঘামছিলাম। বৃদ্ধা মহিলাটি তখন আবারও তাঁর শাড়ির আঁচল দিয়ে আমার মুখম-ল মুছে দিয়ে বললেন, ‘এভাবে ঘামছিস কেন রে বাবা। আজ তো তেমন গরম পড়েনি। আকাশ তো মেঘলা।’ আমার মুখ দিয়ে রা শব্দটি বের হচ্ছিল না। কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেছি আমি। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলাম। চোখ দুটো বড় করে তাকিয়ে ছিলাম। মহিলাটি আমাকে তাঁর সন্তান ভাবছেন। কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। আমি খুবই ¤্রয়িমান গলায় বলেছিলাম, ‘আপনার মনে হয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি তাওরাত বিল্লা না। আমি তৌহিদুল ইসলাম। আমার বাড়ি এখানেই। এই তো কিলোখানেক দূরে হবে। ভুল হতেই পারে। এটা কোন সমস্যা না। মানুষের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য হলো ভুল করা। আমার যে বয়স তাতে আমি আপনার নাতি বয়সী হওয়ার কথা। তা দাদি চলুন, আপনাকে আপনার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসি। ভাল ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করিয়ে নেবেন। আশা করা যায় সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার বাড়ি কোথায় দাদি?’ আমার কথা শুনে তীব্র রাগ ঝড়ল যেন বয়স্কা মহিলাটির চোখে মুখে। প্রায় চিৎকার করে বললেন, ‘তাওরাত, আমার সঙ্গে ফাইজলামি করবি না। আমি ফাইজলামি করার মুডে নেই। এতদিন পরে মায়ের কাছে এসে বলে কিনা দাদি! আশ্চর্য! তোকে কষে এক চড় মারা উচিত। যাতে কয়েকটা দাঁত পড়ে যায়। ছোটবেলার কথা মনে নেই? একটা চড়ে তোর দুটা দাঁত নড়িয়ে দিয়েছিলাম। কোন বাড়বাড়ন্ত করবি না। বাড়ি চল। তোর প্রিয় খাসির মাংস রান্না হবে আজ। সঙ্গে সাদা পোলাও।’ কথাগুলো বলে মহিলাটি আমার হাত ধরে টানতে লাগলেন। আমি বেশ বিপদেই পড়ে গিয়েছিলাম সেদিন। আমি মহিলাটিকে বলেছিলাম, ‘আমি আপনার ছেলে হবো কেন! আমি তো আজই প্রথম আপনাকে দেখলাম। আপনার ছেলের চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার হয়তোবা মিল আছে। এজন্যই আপনার ভ্রান্তি হয়েছে।’ এবার মহিলাটি প্রায় উত্তেজিত হয়ে গেল, ‘শোন তাওরাত, বেশি বকবি না। মুখ কিন্তু সেলাই করে দেব। আমার রাগ তোর জানার কথা। এতদিন মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে থেকেছিস। এখন আমার কাছে এসেও বোকা বানাতে চাচ্ছিস।’ ততক্ষণে মানুষের সমাগম বেড়ে গেছে রাস্তায়। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করছে আমাদের বিষয়টা। তারাও ঠিক ঠাহর করতে পারছে না কিছুই। একজন তখন বলেই ফেলল, ‘আপনাদের সমস্যা কী বলেন তো? আপনাদের মাঝে সম্পর্কইটা বা কী?’ তারপর একজন লোক বয়স্ক মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা আপনার ছেলে?’ বয়স্ক মহিলাটি বেশ রেগে গেল লোকটার ওপর, ‘আপনাদের কি মনে হচ্ছে আমি অন্য কারও ছেলেকে নিয়ে টানাটানি করছি? আমার ছেলে এটা। তাওরাত বিল্লা। এতদিন অভিমান করে কোথায় যেন পালিয়ে ছিল। অনেক খুঁজেছি, কিন্তু পাইনি। আজ পেয়েছি। কিন্তু বাড়ি যেতে চাইছে না।’ তখনই শুরু হলো হট্টগোল। সবাই ওই বৃদ্ধা মহিলাটির পক্ষে। কেউ বুঝতেই চাইল না আমার কথা। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ধোপে টিকল না কথা। সবাই আমাকে বলল, ‘মায়ের সঙ্গে বাড়ি যান। মাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক নয়। মায়ের ভালবাসাকে অগ্রাহ্য করা ভাল না। মা হলো মায়ার বাঁধন। ¯েœহের বাতিঘর। যিনি রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, ঝড় মাথায় নিয়ে সন্তানকে আগলে রাখেন সবসময়।’ বাধ্য হয়েই আমাকে ওই মহিলাটির ছেলে হয়ে যেতে হলো। কী এক বিতিকিচ্চিরি অবস্থা। বেশ খানিক দূর হেঁটে গেলাম মহিলাটির সঙ্গে। উপায় খুঁজতে লাগলাম পালানোর। শেষে না আবার কোন বিপদে পড়ি। কোন বাসায় নিয়ে যাবে কে জানে। কিংবা উনি যে বললেন আমার জন্য মেয়ে দেখেছেন। যদি আসলেই কোন মেয়ের সঙ্গে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন তাহলে সেটা বিরাট ফাঁড়া হবে। আমি মাথাটা খেলাতে লাগলাম। মহিলাটি আমাকে পেয়ে যেন আনন্দের অতিশয্যে পৌঁছে গেছেন। নানা ধরনের গল্প শুরু করে দিয়েছেন তিনি। আমি ছোটবেলায় কত দুষ্টু ছিলাম। কী কী করেছি। উনি কথা বলছেন। সেই ফাঁকে তাঁকে বললাম, ‘আমি একটু আসছি মা। ওই যে ওই গলি থেকে। বেশি দেরি হবে না। মিনিট পাঁচেক। তারপর আবারও ফিরে আসব।’ মহিলাটি আমাকে ধরার চেষ্টা করলেন বটে। তবে আমি ফুড়ুৎ করে দৌড় দিয়েছিলাম। চলে গিয়েছিলাম গলি পথ দিয়ে আরও অনেক দূর। যেখান থেকে মহিলাটি আমাকে আর খুঁজে পাবে না। তারপর চলে গিয়েছিলাম বাড়ি। অনেকক্ষণ পর ঠিক বিকালবেলা। আমি আবারও এসেছিলাম সেই রাস্তায়। তখন যা দেখেছিলাম, তা দেখে আমার মনের গহীনে একটা কষ্ট দানা বেঁধেছিল। মহিলাটি তখনও দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল, আমি যে গলি দিয়ে গিয়েছিলাম সেই গলির দিকে। দীর্ঘ বিলাপের মতো সুর করে কাঁদছিলেন তিনি। তাঁর চোখের পানি পড়ছিল রাস্তায়। অনেকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করছিল তাঁকে। মহিলাটি বলছিল, ‘আমার ছেলে হারিয়ে গেছে। ওই গলির দিকে গেছে। আর ফিরে এলো না।’ রাস্তার মানুষজন বৃদ্ধা মহিলাটিকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। অন্তহীন বিমর্ষতায় তলিয়ে গিয়েছিলাম তখন আমি। মনে হয়েছিল মহিলাটির সঙ্গে তাঁর বাড়ি যাই। কিন্তু অনাকাক্সিক্ষত, অযাচিত ঝামেলা থেকে রেহাই পেতে সেই সিদ্ধান্ত থেতে পিছপা হই আমি। তবে মহিলাটির জন্য খুবই খারাপ লাগছিল আমার। নিশ্চয়ই কোন হৃদয়বিদারক ঘটনা আছে তাঁর জীবনে। আজও মহিলাটির সামনে যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি বিক্রেতার পেছনে ঘাপটি মেরে বসে আছি। কিছুক্ষণ থাকার পর বিক্রেতা বাধ সাধলো তাতে। চিৎকার করে আমাকে বলল, ‘ওখান থেকে বের হন বলছি। কী এমন ঘটেছে যে আপনাকে এভাবে লুকিয়ে থাকতে হবে। বয়স্ক মহিলাকে দেখে কেউ ভয় পায়! আশ্চর্য এক মানুষ তো আপনি!’ আমি বাধ্য হয়েই বের হয়ে এলাম। তখনই মহিলাটি প্রায় দৌড়ে এলেন। বললেন, ‘তাওরাত, তুই কিন্ত আমাকে ঠকাচ্ছিস। সেদিন তুই পালিয়ে গিয়েছিলি। আজ আর তোকে পালাতে দেব না। চলে আয় আমার কাছে। আমার বুকে ফিরে আয়। প্রয়োজনে তোকে আজ বেঁধে নিয়ে যাব বাড়িতে।’ মহিলাটির পেছন পেছন এলো তাঁর সঙ্গে থাকা বয়স্ক লোকটি। আমি নির্বিকার দাঁড়িয়ে রইলাম। অনেকটা জেদ চেপে গেছে মনে। দেখি না কী হয়। একচু বোঝার চেষ্টা করি, আসলে ঘটনাটা কী। বয়স্ক লোকটাও আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কিছুটা বিস্ময় মাখা চেহারা নিয়ে বলল, ‘তাওরাত বিল্লা!’ আমি তখন কিছুটা এগিয়ে গেলাম বয়স্ক লোকটার দিকে। তাঁকে বললাম, ‘আমি তাওরাত নই। সম্ভবত কোন এক জায়গায় আপনাদের ভুল হচ্ছে। ভুলটা কোথায় একটু খুঁজে বের করুন।’ বয়স্ক লোকটা আমার মাথায় ¯েœহের হাত বুলিয়ে দিল। আমার কপালে ভালবাসার চুমু এঁকে খুবই ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আমি জানি না তুমি কে। তবে আমার মনে হচ্ছে তুমি আমাদের তাওরাত বিল্লা। তোমাকে আমি সব খুলে বলব বাবা। তুমি শুধু আমাদের বাড়িতে একটু যাবে। সামান্য সময় থাকবে। অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে তাহলে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কিছুদূর হাঁটার পর তাঁদের বাড়ি এসে পৌঁছালাম। আলিশান বাড়ি। তিন তলা। কিন্তু মানুষ মাত্র ৪ জন। উনারা দু’জন। আর কাজের মানুষ দু’জন। বয়স্ক লোকটা সরকারী চাকরি করেছেন। অবসর জীবন পার করছেন এখন। পেনশন পান। মুক্তিযুদ্ধও করেছেন। তাঁর বাড়ির গেটে বড় করে লেখা আছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা, জনাব মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ।’ তারপর বাড়ি নম্বর, রোড নম্বর, মহল্লা সব লেখা আছে। আমাকে দ্বিতীয় তলার একটা রুমে নিয়ে আসা হলো। মহিলাটি বললেন, ‘তাওরাত এটা তোর রুম। আজ থেকে তুই এই রুমেই থাকবি। আমি রুমে প্রবেশ করেই অবাক হয়ে গেলাম। সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো রুমটা। পুরো রুমে একটা নজর দিয়ে এলাম। আকাশি রং করা হয়েছে রুমে। দেয়ালে কয়েকটা পেইন্টিং ঝুলানো আছে। কিন্তু পেইন্টিংগুলো বর্তমান সময়ের কারও আঁকা না। একটা বুক সেলফ্ দেখা গেল। সেখানে থরে থরে অনেক বই সাজানো। সবই পুরনো আমলের বই। ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলের। বুক সেলফ্টাও সেই সময়েরই বোঝা যায়। আমি বুক সেলফ্ েহাত বুলিয়ে এলাম। একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। তার ঠিক বাঁ পাশেই ব্যালকনিতে যাওয়ার দরজা। ব্যালকনিটাও সুুদৃশ্য। ছোট্ট একটা পড়ার টেবিল দেখলাম। সেখানে একটা দোয়াত কলম। একটা খাতা দেখলাম টেবিলে। খাতাটা হাতে নিয়ে দেখলাম। সুন্দর হস্তাক্ষরে অনেক কিছু লেখা আছে তাতে। পড়ার টেবিলের সঙ্গে লাগানো একটা চেয়ার। হয়তোবা আগে কেউ এখানে বসে পড়াশোনা করত। তবে চেয়ার কিংবা টেবিল কোনটিই বর্তমান সময়ের নয়। দেখেই বোঝা যায় সবগুলোই আগের। ছোট একটা আলনা দেখা গেল। পুরনো, ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া রং তার। সেই আলনাতে বেশ কয়েকটা শার্ট আর প্যান্ট ইস্ত্রি করে সাজানো আছে। একটা দেয়াল ঘড়ি আছে, পুরনো। বন্ধ হয়ে আছে সেটা। আমি সম্মোহিত হওয়ার মতো করে বিছানায় বসলাম। বিছানাটা নরম তুলতুলে। সম্ভবত তোষকটা নতুন। একটা এটাচ বাথরুম আছে রুমে। পুরো রুমে আরও একটা নজর বুলিয়ে এলাম। কোন রুম এত সুন্দরভাবে সাজানো যায় সেটা আমি কল্পনাও করতে পারছি না। আমার মা বেশের ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তুই ফ্রেস হয়ে নে তাওরাত। আমি তোর জন্য রান্না চড়িয়ে দেই। সেদিন তো এলি না। খাসির মাংস রান্না করেছিলাম। তোকে ছাড়া খেতে কি আমার ভাল লাগবে? আজ আবার খাসির মাংস রান্না হবে।’ কথাগুলো বলে উনি চলে গেলেন। আমি নিশ্চল চোখে উদাস তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখে নির্বিকার দৃষ্টি। তখনই আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল বয়স্ক লোকটা। প্রবল আন্তরিকতা নিয়ে বললেন, ‘বাবা, তুমি একটু বসো। আমি এখনই আসছি। তোমাকে কিছু বলার আছে। তোমার কিছু জানার আছে। হৃদয়ের গভীরে গাঢ় যন্ত্রণার বাতাস বয় আমাদের। জীবনের বয়ে যাওয়া একটা ¯্রােতে ডুবে গেছি আমরা। সাঁতার জানি বলে এখনও টিকে আছি। বিধাতা আমাদের শ্বাসও টিকে রেখেছেন। তুমি কি জানতে চাও সবকিছু?’ আমি মুখ দিয়ে কোন কথা বললাম না। গভীর চিন্তায় মগ্ন আমি। শুধু মাথা দুলিয়ে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালাম। ভাবতে লাগলাম কী এমন ঘটনা আছে এই বয়স্ক দম্পতির মাঝে। মিনিটখানেক পরে বয়স্ক লোকটা রুমে ফিরে এলো। তাঁর হাতে শত ছিন্ন সাদা একটা পাঞ্জাবি। সেটাকে সাদা বলা হয়তোবা ঠিক হবে না। সাদার মাঝে ছোপ ছোপ লাল দাগ। ওটা পাঞ্জাবির রং নয়। কালচে হয়ে যাওয়া লাল রক্ত। পাঞ্জাবিতে ময়লা মাটি জমে আছে। বয়স্ক লোকটা আমার সামনে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। তারপর পাঞ্জাবিটা আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা আমার ছেলের পাঞ্জাবি। ১৯৭১ সালে যখন পাকিস্তানীরা হামলা করে তখন আমার ছেলে যুদ্ধে চলে যায়। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২০ বছর। সামান্য এক ভুলের কারণে আমার ছেলে ধরা পড়ে ওদের হাতে। সেদিন আমার ছেলে এই পাঞ্জাবি পড়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার কিছু সময় পরেই ব্রাশফায়ারের শব্দ হয়। ব্রাশফায়ারের শব্দে যা বোঝার তা বুঝে ফেলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দল। অনেকক্ষণ পর সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমাদের দলটা এগিয়ে যায়। বোঝে পাকিস্তানীরা চলে গেছে। আরও একটু এগিয়ে যাবার পর তারা দেখে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ মাটিতে। মাটিতে রক্তের ছটা দেখে বোঝা যায় কোন লাশ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একটু দূরে মুক্তিযোদ্ধারা খুঁজে পায় আমার ছেলের পরনে থাকা এই পাঞ্জাবি। ব্রাশফায়ার করার ফলে পাঞ্জাবিটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল সাদা পাঞ্জাবিটা। আশপাশে অনেক খোঁজার পরও আমার ছেলের লাশ পাওয়া যায় না। রক্তে লাল হয়ে যাওয়া পাঞ্জাবিটা আমাকে দিয়ে ওরা সব খুলে বলে। কথাটা শুনে আমি পাথর চাপা বোবা কান্নায় অস্থির হয়ে যাই। নিজের ছেলের লাশটুকুর সর্বশেষ সম্মান দিতে পারলাম না আমি।’ কথাগুলো বলে থেমে যান বয়স্ক লোকটা। আমার মনেও তখন বিষণœ ঘণ্টা বেজে চলেছে। হাতে নিয়ে ধরে থাকা পাঞ্জাবিটা মেলে ধরি। সেই ’৭১-এর ধ্বংসাত্মক স্মৃতি বহন করছে পাঞ্জাবিটা। পাশবিকতার স্মৃতি বহন করছে। একজন যুবক মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের স্মৃতি বহন করছে। পাঞ্জাবিটা ধোয়া হয়নি তখন থেকেই। বুঝতে পারি চোখের কোণ ভিজে গেছে আমার। বয়স্ক ভদ্রলোকও নিজের চোখের পানি মোছেন। বলতে থাকেন তিনি, ওর মাকে কিভাবে বোঝাব সেটা বুঝতে পারছিলাম না। রক্তে ভেজা ফুটো হয়ে যাওয়া পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে আমার স্ত্রীর কাছে যাই। তাঁকে খুলে বলি ঘটনাটা। পাঞ্জাবিটা ওর হাতে দেই। কথা শুনে মৃত মানুষের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যায় আমার স্ত্রীর মুখ। জ্ঞান হারায় সে। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিল। দেশ স্বাধীন হয়। আমার স্ত্রীকে অনেক ডাক্তার দেখাই। পুরোপুরি সুস্থ হয় না। আমার স্ত্রীর একটাই কথা, ‘আমার তাওরাত বেঁচে আছে। আমি জানি ও ফিরে আসবে। একদিন মায়ের কাছে ফিরে আসবেই।’ এর পর থেকে ব্যথা কাতর দীর্ঘদিন রাত পার হয় আমাদের। আমার স্ত্রী তাঁর নিজ বিশ্বাসে অটুট থাকেন যুদ্ধপরবর্তী এতটা দিন। মুক্তিযুদ্ধের পরে এই বাড়িটা তৈরি করার পর আমার স্ত্রী এই রুমটা তাওরাতের জন্য বেছে নেয়। তাওরাতের ব্যবহার্য সকল জিনিস এই রুমে রাখে সে। এই রুমটা সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখে আমার স্ত্রী। ও লেখালেখি করত। দোয়াত কলম, খাতা সবই আছে আগের মতো। ওর পরনের শার্ট, প্যান্ট সব আগের মতো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখে। ওর রুমে দেয়াল ঘড়িটা ছিল। সেটাও রেখে দিয়েছে তাওরাতের মা। ওর ব্যবহারের ড্রেসিন টেবিলটাও সেভাবেই আছে। চেয়ারটাও রেখে দিয়েছে এই রুমে। আমার ছেলে বই পড়তে পছন্দ করত। বইসহ সেই বুক সেলফ্ এই রুমে রেখে দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন সকালে তাওরাতের মা ঘরে এসে ঝাড়ু দিয়ে যায়। পানি রেখে যায় রুমে। তাওরাতের প্রিয় খাসির মাংস রেঁধে এই রুমে রেখে যায়। আমার স্ত্রীর বিশ্বাস তাওরাত এসে অবশ্যই খাবে খাসির মাংস। তাওরাতের জন্য আমার স্ত্রী একটা মেয়ে দেখেছিল ’৭১ সালে। এখনও সে বিশ্বাস করে তাওরাত ফিরে এলে বিয়ে দেবে তাঁকে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আমার স্ত্রী মানসিকভাবে এখনও পড়ে আছে ১৯৭১ সালে। এখনও তাঁর ছেলের বয়স ২০ বছর। সে বাইরে যায়। কেনাকাটা করে। তাঁর ছেলের জন্য অনেক নতুন জামা কিনেছে সে। বাড়িতে এসে রান্না করে, ঘুমায়। আমার সঙ্গে ঘোরে। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যায়। কিন্তু এখন যে ২০২১ সাল সেটা সে বোঝে না। তাঁর দিনগুলো থমকে আছে ’৭১-এ। কয়েকদিন আগে তাওরাতের মা আমাকে এসে বলে, ‘আজ বাজারে তাওরাতকে দেখলাম। আমি বলেছিলাম না ও ফিরে আসবে। ওকে ধরে নিয়ে আসছিলাম। কিন্তু কিভাবে যেন পালিয়ে গেল।’ আমি স্ত্রীর কথা বিশ্বাস করিনি। আমি জানি তাওরাত না ফেরার দেশে চলে গেছে পাকিস্তানীদের আঘাতে জর্জরিত হয়ে। কিন্তু আজ তোমাকে দেখে বুঝলাম সে ভুল দেখেনি। আসলেই তাওরাত ফিরে এসেছে। তুমিই আমাদের তাওরাত। কোন মানুষের সঙ্গে কারও এত মিল হতে পারে সেটা তোমাকে না দেখলে বুঝতাম না। তাওরাতের সঙ্গে তোমার চেহারার হুবহু মিল। আমাদের আর কোন সন্তান হয়নি। তাওরাতের স্মৃতি আগলে বেঁচে আছি আমরা।’ এবার বয়স্ক ভদ্রলোক তাঁর পকেট থেকে একটা সাদাকালো ছবি বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘দেখো তো বাবা এই ছবিটা। বোঝার চেষ্টা করো তো আমার সন্তান তাওরাতের সঙ্গে তোমার কোন মিল আছে কিনা?’ আমি ছবিটা হাতে নিলাম। চমকে উঠলাম দিগুণ বেগে। হুবহু মিল। কোন পার্থক্য নেই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। নাক, চোখ, মুখ, গায়ের রং, মুখের আকৃতি সবই একই রকম। যেন বিধাতা একই রকম মানুষ তৈরি করে পাঠিয়েছেন এই পৃথিবীতে। এত মিল হতে পারে দুটো মানুষের মাঝে! আমার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তাওরাতের বাবা মায়ের ভুল হওয়ারই কথা। এই দম্পতির জন্য খুবই কষ্ট হতে থাকে আমার। অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। করুণ আর্তনাদে কাঁদতে থাকে মন। মনে হতে থাকল এক অসহনীয় যন্ত্রণা বাসা বেঁধেছে বুকের ভেতর। যেন বিষণœ ঘণ্টা বাজিয়ে চলেছে কোন লাশবাহী গাড়ি। বৃদ্ধা মহিলাটিকে অনেক আপন করে মা বলে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করছে তাঁর হাতে এক লোকমা ভাত খেতে। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অনবরত। যদিও আমি তাঁদের সন্তান নই। কিন্তু তাঁদের কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না। আমি অস্ফুট স্বরে বয়স্ক ভদ্রলোককে বললাম, ‘মা কোথায়?’ তিনি আমাকে নিয়ে গেলে রান্নাঘরে। মা তাঁর ছেলের জন্য পরম যতেœ খাসির মাংস রান্না করছেন। আমি চোখ দুটো মুছে বললাম, ‘মা আজ আমাকে ভাত তুলে খাওয়াবে? আমি তোমার হাতে ভাত মেখে খেতে চাই। মায়ের চোখে-মুখে তখন অদ্ভুত আলো খেলে গেল। অদ্ভুত সুখাবয়ব বয়ে যায় তাঁর চোখ মুখ বেয়ে।
×