ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

শাবি উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে অনশন চলছে

আলোচনায় এলেও আন্দোলনে অনড় শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ২১:৪৬, ২২ জানুয়ারি ২০২২

আলোচনায় এলেও আন্দোলনে অনড় শিক্ষার্থীরা

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ অনশন চলবে, আলোচনাও চলবে, এমন পরিস্থিতিতেই শাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের নবম দিন শুক্রবার অতিবাহিত হয়েছে। উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থা ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। শাবির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী শুক্রবার সিলেট আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। একই সঙ্গে তিনি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গেও কথা বলেন। দীপু মনির সঙ্গে আলোচনা করতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি প্রতিনিধিদলকে ঢাকায় যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রতিনিধিরা আলোচনায় গেলেও অনশন চালাতে অনঢ় রয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে শিক্ষামন্ত্রী শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার সময় ফোনের স্পীকার চালু রেখে সবাইকে শোনানো হয়। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমরা চাই আমাদের সন্তানেরা ভাল থাকবে। তাদের যেন কষ্ট না হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও ঠিক থাকবে। আপনারও ওখানে কষ্ট করছেন এটা দেখছি, অন্য সমস্যা হচ্ছেও, সেটাও দেখছি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপার আছে। আমরা তাতে দ্রুত হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে শিক্ষার্থীরাও কষ্ট পাবেন এটাও চাই না। মন্ত্রী বলেন, সব সমস্যারই একটা সমাধান আছে। এই সমস্যারও নিশ্চয়ই সমাধান আছে। তবে আলোচনার মাধ্যমেই সেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের ৪/৫ জন যদি আসেন, শিক্ষক সমিতির নেতারা যদি আসেন তবে আমরা আলাপ করে একটা সমাধানে পৌঁছুতে পারব। মন্ত্রী আরও বলেন, আপনারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে আসবেন, পরে নিজেদের মধ্যে যেন ঝামেলা না হয়। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলাপকালে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে সাদিয়া আফরিন বলেন, আমরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী। সন্ধ্যার আগেই আমাদের ৫ জন প্রতিনিধি ঢাকায় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে যাবেন। আমরা আলোচনা করে কিছুক্ষণের মধ্যে ৫ জন প্রতিনিধি ঠিক করব। আশা করছি, মন্ত্রী আমাদের দাবি মেনে নেবেন। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় গেলেও আমাদের অনশন যথারীতি চলবে। এর আগে শুক্রবার বেলা দেড়টার দিকে শিক্ষামন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে ক্যাম্পাসে আসেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম নাদেল, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগ সহ-সভাপতি আশফাক, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেনসহ কয়েকজন নেতা। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার পরই আওয়ামী লীগ নেতারা উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের বাসভবনে আলাপের জন্য যান। শফিউল আলম নাদেল সাংবাদিকদের বলেন, এভাবে অচলাবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। আমাদের সন্তানদের এই কষ্ট আমরা মেনে নিতে পারছি না। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর বার্তা নিয়ে এখানে এসেছি। দুই পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমাধানের পথ বের করার চেষ্টা করব। উপাচার্যও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতারা উপাচার্যের বাসভবনে আলাপ করে ফিরে আসার পর বিকেল ৩টায় বাংলাদেশ শফিউল আলম চৌধুরীর মুঠোফোনে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল বাশার বলেন, আমাদের একটাই দাবি- উপাচার্যের পদত্যাগ। এই দাবি আদায় না হলে আমরা আন্দোলন থেকে সরছি না। প্রয়োজনে আমরা মারা যাব। এদিকে অনশনকারীদের মধ্যে অসুস্থের সংখ্যা বাড়ছে। বেলা ৩টা পর্যন্ত ১২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। উপাচার্য ভবনের সামনে অনশনে থাকা বাকি সবার হাতেও স্যালাইন চলছে। আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাও সেখানে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। ডায়াবেটিকস থাকায় তাদের একজনের অবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানা গেছে। গুলি চালিয়েছেন তার মুখ আমরা দেখতে চাই না ॥ আওয়ামী লীগ নেতারা উপাচার্যের বাসভবনে যাওয়ার পর সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তাদের পক্ষে শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল বাশার বলেন, আমাদের একটাই দাবি- উপাচার্যের পদত্যাগ। এই দাবি আদায় না হলে আমরা আন্দোলন থেকে সরছি না। প্রয়োজনে আমরা মারা যাব। তিনি বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলোচনায় আপত্তি নেই। তবে তাকে (শিক্ষামন্ত্রী) উপাচার্যের পদত্যাগ ইস্যুতে কথা বলতে হবে। তবে উপাচার্যের সঙ্গে কথা বলতে আমরা রাজি নই। যিনি আমাদের ওপর গুলি চালিয়েছেন তার মুখও আমরা দেখতে চাই না। অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দেখতে আ’লীগ নেতারা ॥ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত অসুস্থ শিক্ষার্থীদের দেখতে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যান সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মোঃ জাকির হোসেন। শুক্রবার সকালে নেতৃবৃন্দ ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে আন্দোলনরত অসুস্থ শিক্ষার্থীদের পাশে যান এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। নেতৃবৃন্দ সিওমেকের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডাঃ শিশির রঞ্জন চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলে তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ নার্সেস এ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ সম্পাদক। অনশনরত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী শাহেরিয়ার আবেদীন বলেন, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বুধবার দুপুর ৩টা থেকে অনশনে আছি। প্রায় ৪০ ঘণ্টা পার হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ৮ জন হাসপাতালে। ডাক্তারের বারবার সতর্কবাণী সত্ত্বেও তারা অনশন ভাঙ্গতে রাজি হয়নি। আমাদের অনেকের গ্লুকোজ লেবেল, ব্লাড প্রেসার, পালস রেট এসবের সবকিছু অনিয়ম হয়ে গেছে। তিনি বলেন, এই উপাচার্যের মানবিক মূল্যবোধ ও লজ্জা থাকত, তাহলে সে, এই যে শিক্ষার্থীরা যে অনশন করছে, তার জন্য, সে এটার দায় নিয়ে হলেও সে পদত্যাগ করত। সে যেহেতু এখন পর্যন্ত পদত্যাগ করেনি, আমাদের কথা হচ্ছে, এই নির্লজ্জ, স্বৈরাচারী উপাচার্য যতক্ষণ না পদত্যাগ করছেন, ততক্ষণ যত কষ্টই হোক, যত ত্যাগই স্বীকার করা লাগুক, আমরা আমাদের অনশন জারি রাখব। উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বুধবার বিকেল ৩টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কিলোতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অনশনে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অনশনরত ১৫ জন ছাত্র ও ৯ জন ছাত্রী। অসুস্থ হয়েও কিছুই মুখে নিচ্ছেন না তারা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন ভাঙবেন না বলে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে শুক্রবার বিকেল ৫টায় সর্বশেষ তথ্য জানতে চাইলে ক্যাম্পাসে অনশনরতদের সেবায় নিয়োজিত আন্দোলনরত শিক্ষার্থী নওরিন জামান (ডিপার্টমেন্ট ও সেশন উল্লেখ করতে অনিচ্ছুক) বলেন, প্রায় সবাই অসুস্থ। এর মধ্যে ১২ জন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ছাত্র ৬ জন এবং ছাত্রী ৬ জন। হাসপাতালে ভর্তি ১২ জনের মধ্যে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে ৯ জন, এর মধ্যে গুরুতর অসুস্থ ২ জন। আর ২ জন জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এবং ১ জন আখালিয়ায় অবস্থিত মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে ভর্তি আছেন। শুক্রবার বেলা সোয়া ২টায় সংবাদ সম্মেলন করেছেন শিক্ষার্থীরা। সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ইয়াসির সরকার বলেন, উপাচার্যের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের ওপর ন্যক্কারজনক বর্বরোচিত হামলার পর উপাচার্য অপসারণের দাবিতে আন্দোলন ষষ্ঠ দিন। আমাদের ২৩ জন অকুতোভয় সহযোদ্ধা উপাচার্য অপসারণের দাবিতে আমরণ অনশন করছে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা অর্থাৎ দুদিন হয়ে গেল। তাদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীকে ইতোমধ্যে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, কিন্তু তারা ভিসি অপসারণ ব্যতিরেকে কোনভাবেই অনশন ভাঙতে রাজি নয়। তিনি আরও বলেন, আজ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ঘোষণা এসেছে, ২১ জানুয়ারি থেকে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি সকল স্কুল কলেজ বন্ধ থাকবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মূলত আমাদের উপাচার্য গত ১৬ তারিখেই শিক্ষার্থীদের ওপর প্রশাসনিক হামলার পর শাবিপ্রবি বন্ধ ঘোষণা দেন। হলগুলোও বন্ধ করে দেন। তিনি বলেন, ১৬ জানুয়ারির পর থেকেই আমাদের ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেছে এবং নতুন করে বন্ধ হবার কিছু নেই। কার্যত বন্ধ ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থীরা আন্দেলন করে আসছেন। বোমাবাজ অপসারণ করে একটি সুন্দর শিক্ষাজীবন উন্মোচনের লক্ষ্য। সুতারাং আমাদের আন্দোলন চলছে এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে যতক্ষণ পর্যন্ত এই উপাচার্যের পতন না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো। এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাত ১২টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত পুরো ক্যাম্পাসে মশাল মিছিল করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। এ বিষয়ে শিক্ষার্থী ইয়াসির সরকার বলেন বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন থেকে ২০০-৩০০ শিক্ষার্থী মশাল মিছিল বের করেন।
×