ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অরবিন্দ মৃধা

বাংলার প্রথম চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পাল ও তাঁর জীবনকর্ম

প্রকাশিত: ২২:১৬, ২১ জানুয়ারি ২০২২

বাংলার প্রথম চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পাল ও তাঁর জীবনকর্ম

তৎকালীন ভারতীয় চিত্রকলা ঘরানার প্রথম যুগের প্রথম সারির চিত্রশিল্পী বাংলাদেশের খুলনা জেলার সেই সময়ের প্রসিদ্ধ গ্রাম মহেশ্বরপাশায় জন্মগ্রহণ করেন শশিভূষণ পাল (জন্ম- ১৪ জানুয়ারি-১৮৭৮-মৃত্যু: ১ জুলাই ১৯৪৬)। পিতা শ্রীমন্ত পাল ছিলেন একজন স্বভাব কবি ও শিল্পী। শশিভূষণ পাল বাল্যকালেই চিত্রশিল্পে আকৃষ্ট হন এবং শিক্ষা গ্রহণ করে কর্মজীবনের শুরুতেই ১৯০৪ সালে নিজবাড়িতে ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামে আর্ট স্কুল তৈরি করে শিক্ষকতা শুরু করেন, এর পাশাপাশি চিত্রশিল্প কর্ম কাজ চালিয়ে যান। তাঁর শিল্পকর্মের সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে বর্ধমানের মহারাজাধিরাজের পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারীভাবে মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট এর স্থায়ী ভবন নির্মিত হয়। স্থানটি দৌলতপুর থানাধীন যশোর রোডের পশ্চিম পাশে। লিখিত ফলক অনুযায়ী ১৯২৯ খ্রিঃ ১৯ মে খুলনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর এইচ কুইনন্টন ভবনের শীলা উন্মোচন করেন। এই ভবনটি বর্তমান বাংলাদেশের চিত্রকলা শিল্পের শতাব্দীর সাক্ষ্য হয়ে জীর্ণ মলিন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ভবনের মাপ- দৈর্ঘ ৫৫ ফিট, প্রস্থ ২৫ ফিট সামনে বারান্দা। ছয়টি প্রবেশদ্বার, নয়টি দরজা। ইটের তৈরি চুন সুড়কির গাঁথা। টালির উপর ঢালাই ছাঁদ। বাংলাদেশের প্রথম প্রতœসম্পদ হিসেবে ভবনটি সংরক্ষণ ও সংস্কার হওয়া সময়ের দাবি। শশিভূষণের রংতুলির আঁচড় তাকে জাত শিল্পীর আসনে বসিয়েছিল। এঁকেছেন রাজদরবারের ছবি, কীর্তিমান বাঙালীর ছবি, সাধু-দরবেশের ছবি, ইংরেজ সাহেব ও দেশী বাঙালীর ছবি, ল্যান্টস্কেপ, যুদ্ধবিগ্রহ, মানুষের অবয়বসহ নানা ঘটনার প্রতিকৃতি। রবীন্দ্রপরিবার বলয়ের বাইরে শশিভূষণ পাল তাঁর চিত্রকর্ম দ্বারা দেশে বিদেশে সাড়া জাগিয়ে ছিলেন। ‘গ্লাসগো ও প্যারিস প্রদর্শনীতে তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত ও পুরস্কৃত হয়। ইংল্যান্ডসহ দেশ-বিদেশের প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে ৪০টির বেশি স্বর্ণপদক, রৌপ্যপদক এবং সম্মানসূচক প্রশংসাপত্র অর্জন করেন তিনি, শশিভূষণের আগে কোন চিত্রশিল্পীর জীবনে এমন ঘটনা বিরল।’ (তথ্যসূত্র- মোঃ তরিকত ইসলাম, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪/০১/২০২১) তিনি ব্রিটিশ সরকার ও সুধীমহলে পুরস্কৃত এবং নন্দিত হয়েছিলেন।’ সম্রাট পঞ্চম জর্জের অভিষেক উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে দিল্লীর দরবারে চিত্র প্রদর্শনী করেছিলেন শশিভূষণ। সেই প্রদর্শনী দেখে সম্রাট ও তাঁর স্ত্রী এই শিল্পীর ভূয়সী প্রশংসা করেন।’ ১৯২৫ সালে সরকার এই বাঙালী চিত্রশিল্পীকে ‘রায় সাহেব’ উপাধিতে ভুষিত করে। ‘শশিভূষণ পালকে গবর্নমেন্ট হাউসে সনদটি প্রদান করেন লর্ড লিটন।’ কালের ধুলায় এই সুখ্যাত বাঙালীর কীর্তি যেমনি ঢাকা পড়েছে, তেমনি ১৯০৪ সালে শশিভূষণ পালের প্রতিষ্ঠিত তাঁর আজীবনের কর্মস্থল খুলনাসহ ‘মহেশ্বরপাশা স্কুল অব আর্ট’ নামের সুরম্য (সংস্কারবিহীন) একতলা বিশিষ্ট ভবনটি সম্প্রতি অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ১৯১৮ সাল থেকে তৎকালীন খুলনা জেলা বোর্ড ও সরকারী অনুদান পাওয়া শুরু করে। শশিভূষণ পাল ৪১ বছর ধরে উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে নিজ অঞ্চলে চিত্রশিল্পবিদ্যা উৎকর্ষ সাধনে ভূমিকা রাখেন। তিনি তৎকালীন পূর্ব বাংলার এবং বর্তমান বাংলাদেশে চিত্রবিদ্যা চর্চার প্রথম পথিকৃৎ। বলা যায় উনিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিশ শতকের চল্লিশ দশক পর্যন্ত শশিভূষণ পাল ভৈরব নদী বিধৌত পূর্ববাংলা জনপদের শক্তিমান একক চিত্রশিল্পী ছিলেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি রক্ষার তাগিদে বাংলাদেশের প্রথম আর্ট স্কুল হিসেবে, ইতিহাসের স্মারক হিসেবে, ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে, চিত্রশিল্প সংস্কৃতির শিকড় হিসেবে চিহ্নিত করে শশিভূষণ স্মৃতি ভবনটি সংরক্ষণ ও সংস্করণের জন্য সদাশয় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করছি। শিক্ষা জীবন : শশিভূষণ পাল ‘খুলনার দৌলতপুরের এন্ট্রান্স স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া কালে কাজের সন্ধানে কলকাতায় গিয়ে প্রাণের টানে মাঝে মাঝে কলকাতা আর্ট স্কুলে যেতেন এবং সেখানে থেকে চিত্রবিদ্যার কলাকৌশল শিখে নিজে চর্চা করতেন’ (পূর্বোক্ত) শশিভূষণ প্রথমে সামাজিক রীতি ও পারিবারিক প্রথায় নানা ধরনের মৃৎ শিল্প তৈরি করেছেন। পেশার বাইরে এসে প্রথমে কাষ্ঠশিল্প, যেমন কাঠের ঘোড়া, রেলগাড়ি, ঘড়ি, বাঁশি এবং ধাতব শিল্প তৈরি করেন, পরে রংতুলিতে সময়ের পটসহ নানা রকম চিত্রশিল্প কর্মকে নেশা ও পেশা হিসেবে গ্রহণ করে নিজকে সময়ের সাহসী চিত্রশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন। বলা যায়, তাঁর সময়ে তিনি ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত চিত্রশিল্পী। শিক্ষকতা : শিল্পী শশিভূষণ চিত্রবিদ্যার উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে ছবি আঁকাকে শিক্ষকতা পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি ‘প্রথমে সাঁওতাল পরগনার পাঁকুড়বাজার হাইস্কুলে যোগদান করেন, পরে খুলনার দৌলতপুর ও সেনহাটিতেও ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন।’ উল্লেখ্য, উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময় থেকে বিশ শতকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত সেনহাটি, মহেশ্বরপাশা, দৌলতপুর ও সংলগ্ন অঞ্চলটি শিক্ষা-সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চায় প্রসার লাভ করে। ১৯০২ সালে দৌলতপুরে ব্রজলাল কলেজ প্রতিষ্ঠা পায়। শশিভূষণ পাল আর্ট স্কুলে শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পকর্ম চর্চা এবং দেশ বিদেশের চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। তাঁর আঁকা চিত্রকর্মে তেল রং, রঙের ঘনত্বের ছাপ লক্ষণীয়। সমসাময়িক চিত্রশিল্পী : শশিভূষণ পালের কালকে রবীন্দ্র পরিবার বলয়ের ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলাকাল হিসেবে চিহ্নিত করা বোধ করি অসমীচীন হবে না। উনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ের পরের চিত্র শিল্পীদের মধ্যে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮), অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), নন্দদুলাল বসু (১৮৮৩-১৯৬৬), যামিনী রায় (১৮৮৭-১৯৭২) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই বলয়ের বাইরে থেকে শশিভূষণ পালের (১৮৭৮-১৯৪৬) চিত্রশিল্পকর্ম প্রশংসনীয় এবং মাইলফলক হয়েছে উঠেছিল। উল্লেখিত শিল্পীগণ ভারত সরকারের পদ্মভূষণ, দেশিকোত্তমসহ নানা উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। শশিভূষণ এ বলয়ের বাইরে থেকে নিজ কর্মগুণে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে শশিভূষণের চিত্রকর্ম এবং নিজ এলাকায় চিত্র শিল্পোন্নয়নে ভূমিকার বিষয়টি দিনে দিনে বর্ণহীন হয়ে পড়ে। পরবর্তী কথা : চিত্রশিল্পে বিশেষ অবদান রাখায় স্বাধীনতাত্তোর কালে বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন (১৯১৪-১৯৭৬), পটুয়া কামরুল হাসান (১৯২১-১৯৮৮), শেখ মুহাম্মদ সুলতান (১৯২৩-১৯৯৪), সাইফুদ্দিন আহমেদ (১৯২২-২০১২), মুর্তজা বশীর (১৯৩২-২০২০), কাইয়ুম চৌধুরী (১৯৩২-২০১৪), সৈয়দ জাহাঙ্গীর (১৯৩৫-২০১৮) নিতাই গোপাল কু-ু, (নিতুন) (১৯৩৫-২০০৬) হাসেম খান (জন্ম- ১৯৪১),আব্দুস শাকুর শাহ (জন্ম- ১৯৪১), মনিরুল ইসলাম (জন্ম- ১৯৪৭), শাহাবুদ্দীন আহমেদ (১৯৫০) প্রমুখ শিল্পীগণ স্ব-স্ব কাজের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। অথচ বাংলার প্রথম চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পাল স্মৃতির আড়ালেই রয়ে গেছেন। শিল্পসৌকার্য সংরক্ষণ : শশিভূষণ পালের আঁকা শিল্পসৌকার্য ভারতের এক প্রদর্শনীতে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। ‘শশিভূষণ পালের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল চারদিকে। ভারতের শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে তাঁর আঁকা একটি ছোট আকারের পোস্টকার্ড, যেটির এক পাশে ছিল সে সময়ের সারা কলকাতার দৃশ্য এবং অন্য পাশে বারো শ’লাইন, তিনি এমনভাবে বিন্যাস করেছিলেন যে লেখার মধ্যে দৃশ্যমান ছিল হরিদ্বারের প্রাকৃতিক দৃশ্য। এই পোস্টকার্ড ভারতের বরোদা মহারাজার জাদুঘরে সংরক্ষিত। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্রকর্ম রয়েছে, সেই ছবিটি সামনে থেকে দেখলে কেশব চন্দ্র সেন, ডান দিক থেকে দেখলে জাস্টিস শম্ভুনাথ এবং বাঁ-দিক থেকে দেখলে রাজা রামমোহন রায়ের অবয়ব দৃশ্যমান হয়। এই ছবি বর্তমানে লন্ডন জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে’। (সূত্র : পূর্বোক্ত)। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শশিভূষণের বিভিন্ন ধরনের চিত্রকর্মের কিছু তাঁর আর্ট ভবনে রক্ষিত ছিল। সেগুলো কালে কালে অনেক কিছু বেহাত ও নষ্ট হয়েছে, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে কিছু চিত্রকর্ম রক্ষিত আছে। প্রথিতযশা এই বাঙালী চিত্রশিল্পী শশিভূষণ পালের ১৪৪তম জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি অকুতোভয়।
×