ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

৫০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা বাবা- পুত্রের কবর চিহ্নিত

প্রকাশিত: ১৫:৩২, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

৫০ বছর পর মুক্তিযোদ্ধা বাবা- পুত্রের কবর চিহ্নিত

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ ৫০ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা স্বামী-সন্তানকে পাক সেনারা জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে হত্যার স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছে বয়ঃবৃদ্ধা শহীদ জননী বেগম হালিমা হাফিজ (৯৫)। লালমনিরহাট শহরের রেলওয়ে সাহেব পাড়ায় স্বামী-সন্তান কে চাপা দিয়ে হত্যার স্থানটি ৫০ বছর পর শনাক্ত হয়েছে। সেখানে পারিবারি ভাবে পাকা করা হয়েছে কবরটিকে। এখানে মহান মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নাম না জানা শতশত নারী- পুরুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। এই গণ কবরটি রাষ্ট্রীয় ভাবে রংরক্ষণের দাবি উঠেছে। জানা গেছে, ৭১’র সালে রেলওয়ে ডিটিএস অফিসের হেড ক্লার্ক হিসেবে কর্মরতছিলশহীদ এমএ হাফিজ । চাকুরির সুবাদে স্ত্রী সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগীয় শহরের সাহেব পাড়া রেলওয়ে কোয়াটারে।পুত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বেলাল সুজা সেই সময় ছিল সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ ম শ্রেণির ছাত্র। পিতা –পুত্র ছিল বীরমুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন রেডক্রস ময়দানে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন দেয়। এই ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষনের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষনার সূচনা হয়ে যায়। জাতির পিতার আহবানে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে শুরু হয়। রেলওয়ে বিভাগীয় শহর লালমনিরহাটে তরুণ ও স্বাধীনতা পাগল মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। রেলওয়ে কর্মকর্তা, কর্মচারি, শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষক মিলে স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। গোপনে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেয়। হেড ক্লার্ক এমএ হাফিজ ও তার পুত্র বেলাল সুজা স্থানীয় গোপন প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলেন। পিতা-পুত্র মিলে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ রেলওয়ে মেডিক্যাল হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের পাশের মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে উল্লাস প্রকাশ করে। এই পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে রেলওয়ে কোয়াটারের সকলে উপস্থিত ছিল। সে কি আনন্দ। সকলে পটকা ফুঁটিয়েজয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে মুখরিত করে রেখে ছিল। এই পতাকা উত্তোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে ১৮ এপ্রিল ভোর বেলায় পাকিস্তানি আর্মি ও বিহারীরা পিতা - পুত্র কে রেলওয়ে বাসা হতে ধরে নিয়ে যায়। বাসার পাশে গর্ত খুড়ে পিতা - পুত্র কে একই গর্তে জীবন্ত পুতে হত্যা করে। সেই দৃশ্য সেই দিন দেখেছেলিন আজকের বৃয়ঃবৃদ্ধা বেগম হালিমা হাফিজ (৯৪)। ৫০ বছর ধরে সেই যন্ত্রনাদায়ক স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছে তিনি। জীবন সায়েহ্নে এসে বৃদ্ধ মা হালিমা হাফিজ তার শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্বামী - সন্তানের স্বীকৃতি দেখে যেতে চায়। জীবন্ত মাটি চাপা দেয়ার স্থানটি সম্প্রতি চিহ্নিত করেছে। লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের ম্যানেজার মোঃ নুর মোহাম্মদ জানান, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লালমনিরহাট রেলওয়ে কর্মকর্তা কর্মচারি গণের আত্মত্যাগের ইতিহাস গৌরবের। একটি দেশের স্বাধীনতায় বেসামরিক একটি পরিবহন সংস্থার মানুষ এতো প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সেই ইতিহাস দেরিতে হলেও সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।সরকারের পাশাপাশি রেলওয়ে মুক্তিযুদ্ধের এই গৌরব গাঁথা বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্মৃতি ধরে রাখতে উদ্যোগ নিয়েছে। লালমনিরহাটে ডিআরএম অফিস সংলগ্ন রেলওয়ে গণ কবরটি তার প্রমাণ হিসেবে স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। রেলওয়ে অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বীরমুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুল ছালাম জানান, নতুন প্রজন্ম মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর বীরত্বপূর্ণ অবদান ও আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানাতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে। ৫০ বছর পর হলেও বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ধর্মান্ধতা ও উগ্রবাদী মৌলবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস জেনে গেছে। ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক অধ্যক্ষ মোঃ শারওযার আলম জানান, ইসলামে উগ্রমৌলবাদীর কোন স্থান নেই। ইসলাম ধর্ম স্বাধীনতা কে সম্মানিত করেছে। যে জাতি স্বাধীন হতে চায় আল্লাহ পাক সেই জাতির প্রতি রহমত বর্ষণ করেছে। প্রিয় নবী হয়রত মোহাম্মদ সঃ বলেন, কোন আনন্দের সংবাদে আরবরা যাতে দাস-দাসিকে মুক্ত জীবন দিয়ে সেই আনন্দকে বাড়িয়ে দেয়। আল্লাহ স্বাধীনতা পছন্দ করেন। যিনি স্বাধীন করতে সহায়তা করেন ও অংশ নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি শহীদের মর্যাদা পাবেন। ধর্মের নামে স্বাধীনতার বিরোধীতা করার কোন সুয়োগ নেই।
×