ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবু আফজাল সালেহ

বুদ্ধদেব বসু ॥ কবিতার শিক্ষক

প্রকাশিত: ২৩:৪৬, ২৬ নভেম্বর ২০২১

বুদ্ধদেব বসু ॥ কবিতার শিক্ষক

‘কিছুই সহজ নয়, কিছুই সহজ নয় আর।/লেখা, পড়া, প্রুফ পড়া, চিঠি লেখা, কথোপকথন,/যা কিছু ভুলিয়ে রাখে, আপাতত, প্রত্যহের ভার...’ বুদ্ধদেব বসুর ‘দায়িত্বের ভার’ কবিতার মাধ্যমেই তার সাহিত্যচর্চা, স¤পাদনা ও সাংসারিকজীবনসহ দৈনন্দিনচিত্র ফুটে উঠেছে। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বিচিত্রমুখী স্রষ্টার নাম বুদ্ধদেব বসু। তাঁর মূল পরিচিতি কবি হিসেবেই। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, ভ্রমণকাহিনী, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ, স্মৃতিকথা লিখেছেন। এসবে তিনি সফল ছিলেন। সমালোচনা সাহিত্যকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। শুধু কবিতা নিয়েই অনেক গবেষণা করেছেন। বাংলা কবি ও কবিতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। সৃজনশীসাহিত্য, স¤পাদনা ও সমালোচনা পাশাপাশি প্রবাহিত। তিনি গদ্যরীতিতে ইংরেজীর ওজোগুণ এনেছেন; কবিতায়ও। কবিতা, গল্প, সমালোচনা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ভ্রমণ, শিশুসাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ করেছেন; লিখেছেন ১৫৬টি গ্রন্থ। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক কবিকুলের শেষ্ঠতর প্রতিনিধি। সমালচক সুকুমার সেন বলেন, ‘তাঁর (বুদ্ধদেব বসু) লক্ষ্য ছিল আধুনিক কবিতার স্বত্ব প্রতিষ্ঠা করা এবং আধুনিক কবিতা লেখকদের পক্ষ সমর্থন করা’। ‘প্রজাপতি, তুই কেন এত চঞ্চল?/প্রজাপতি, তুই কেন এত সুন্দর?/রোদে ঝলোমলো তোর দুটি ছোট পাখা/রামধনু-ভাঙা রঙের গুঁড়ায় মাথা,/রামধনু,-রাঙা আলোর ঝলকে আঁকা (প্রজাপতি, বারোমাসের ছড়া)’ অথবা ‘বীরু, বুলু, রবি সব ছুটে আয়-/তিনু, মিলি আর মনু,/চাস যদি তোরা দেখতে একটা/সাতরঙা রামধনু (রামধনু, বারোমাসের ছড়া)’ ইত্যাদির মতো কবিতাংশ পড়লেই জানা যায় কবির মনে শিশুদের নিয়েও একটা সত্তা লুকিয়ে ছিল। ভাষার কমনীয়তা, চমৎকার অনুপ্রাসের ব্যবহার, অপূর্ব ধ্বনিব্যঞ্জনা ও যুতসই শব্দচয়নের মাধ্যমে শিশুসুলভ করার পারঙ্গমতা শিশুতোষ কবিতাগুলো পড়লেই অনুধাবন করা সম্ভবপর হবে। ‘একটু সময় হবে? পাশে গিয়ে বসিবো তোমার (কোন মেয়ের প্রতি, কঙ্কাবতী)’, ‘চোখে চোখ পড়েই যদি, নিয়ো না চোখ ফিরিয়েÑরাখো এই- একটুখানি (গান, কঙ্কাবতী)’, ‘এখন আর কিছু কথা বলার নেই;/এখন শুধু স্পর্শের স্বাক্ষর,/¯পর্শের প্রজ্বলন/¯পর্শ ¯পর্শ!/আগেনের শাঁস,/ইশ্বরের শরীর(স্পর্শের প্রজ্বলন)’, ‘মুক্ত করো জন্ম, মৃত্যু; আমার প্রেমেরে-/প্রেমেরও মুক্তি দাও ইচ্ছার শৃঙখল থেকে (দয়মস্তী)’-এমন সব কবিতার পঙত্তি পড়লে রোমান্টিকতার আবগাহনে ডুব দিতে ইচ্ছে কবেই। এজন্য তাকে ‘বাসন্তী কবি’ও বলা যেতে পারে; বলা যেতে পারে হিরন্ময়ের কবি। ঢাকার পুরানা পল্টনের এক সদ্যযৌবনা প্রতিবেশিনীকে মনে-মনে ভাল বেসেছিলেন বুদ্ধদেব। সে ভাল-লাগায় বাক্যালাপ ছিল না, ছিল ‘শুধু রাস্তার এপারে-ওপারে চোখের দেখা’। পরে ‘কঙ্কাবতী’-র দু-একটি কবিতায় আর ‘ইচ্ছাপূরণকারী’ একাঙ্ক নাটক ‘একটি মেয়ের জন্য’-য় সেই প্রতিবেশিনীকে বাঁচিয়ে রাখলেন বুদ্ধদেব। রোমান্টিজম বাড়াতে বুদ্ধদেবের আর একটি কবিতাংশ তুলে দিই-‘শুধু নয় সুন্দর অপ্সর-যৌবন/কম্পিত অধরের চ¤পক-চুম্বন।/শুধু নয় কঙ্কনে ক্ষণে ক্ষণে ঝংকার/আভরণ হীনতার, আবরণ ক্ষীণতার।/শুধু নয় তনিমার বন্ধন/-কিছু তার দ্বন্দ্ব, কিছু তার ছন্দ(প্রেমের কবিতা)’। বুদ্ধদেব বসুর অনেক কবিতায় প্রেম, রোমান্টিজম বা শিশুতোষ কবিতার পাশাপাশি দ্বন্দ্বময় বা আশা-হতাশার চিত্রের মিশ্রণও পাওয়া যাবে। কিছু কবিতাংশ প্রতিনিধি হিসাবে তুলে ধরলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে- (১) ‘এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে, এই পৃথিবীর।/একদিকে আমি, অন্যদিকে তোনার চোখ স্তব্ধ, নিবিড়;/ মাঝখানে আঁকাবাঁকা ঘোর-লাগা রাস্তা এই পৃথিবীর।’-(এখন যুদ্ধ পৃথিবীর সঙ্গে, নতুন পাতা) (২) ‘দিন মোর কর্মের প্রহারে পাংশু/রাত্রি মোর জ্বলন্ত জাগ্রত স্বপ্নে।/ধাতুর সংঘর্ষে জাগো, হে সুন্দর, শুভ্র অগ্নিশিখা,/ বস্তুপুঞ্জ বায়ু হোক, চাঁদ হোক নারী,/মৃত্তিকার ফুল হোক আকাশের তারা’-(রূপান্তর, বুদ্ধদেব বসু) (৩) ‘আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,/শানো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,/ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা ব’লেও নষ্ট করো না এই রাত্রি-/শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব’-( মুক্তিযুদ্ধের কবিতা) (৪) ‘ওগো চপল-নয়না সুন্দরী/তোলো মোর পানে তব দুই আঁখি,/ৃঢেউ তোলো মোর প্রাণ-সিন্ধুতে,/সুখে উচ্ছ্বসিয়া ওঠে কল্লোলে/ৃওগো মোর পিপাসিত যৌবনে/কর শান্ত একটি চুম্বনে।’-(শিরোনামহীন) বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। ১৯২৭ সালে, উনিশ বছর বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অনার্স প্রথমবর্ষে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে মাস্টার্স পাস করেন। অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা ছাত্রের মর্যাদা তার প্রাপ্য। বিশের দশকের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থির চিত্র আজও অমলিন; বেঁচে আছে বুদ্ধদেব বসুর আত্মস্মৃতিমূলক ‘আমার যৌবন’ গ্রন্থে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি পুরো রমনা ও পুরানাপল্টন এলাকার বর্ণনা আছে তার লেখায়। বুদ্ধদেব বসু অনিচ্ছাসত্ত্বেও কীভাবে তাকে সাহিত্যস¤পাদক পদে নির্বাচন করতে হয়েছিল, সে বর্ণনাও বইতে লেখা আছে। নির্বাচিত হওয়ার পর ম্যাগাজিন ‘বাসন্তিকা’-র স¤পাদনার দায়িত্বও পান। নজরুলের জন্য বুদ্ধদেব জগন্নাথ হলে একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। তখনকার আবেগ ও বর্ণনাও রয়েছে সেখানে। কবি বুদ্ধদেব বোলদেয়ারসহ বেশ কিছু কবিতা বাংলায়ন করেছেন। অনুবাদেও মুন্সিয়ানার ছাপ পাওয়া যাবে। একটি উদাহরণ দিই- ‘বলো আমাকে রহস্যময় মানুষ, কাকে তুমি/সবচেয়ে ভালবাসো?/তোমার পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নীকে?/পিতা, মাতা, ভ্রাতা অথবা ভগ্নী-কিছুই নেই আমার।।/আমি ভালবাসি মেঘ... চলিষ্ণু মেঘৃৃ./উঁচুতে ঐ উঁচুতে/আমি ভালবাসি আশ্চর্য মেঘদল।’-(অচেনা মানুষ, মূল: শার্ল বোদলেয়ার; অনুবাদ: বুদ্ধদেব বসু)। বুদ্ধদেবের সাহিত্যচর্চা নিয়ে কন্যা মীনাক্ষীর তার ‘স্মৃতিতে চিঠিতে বুদ্ধদেব বসু’ বইয়ে লিখছেন-‘কবিতাভবন’ ছিল বারোমাসের ‘ওপেন হাউস’। বহু রাত অবধি চলত হাসি-গল্প-তর্ক। মতানৈক্য বাবা শুধু সহ্যই করতেন না, স্বাগত জানাতেন। সেটা ছিল তার কাছে উত্তেজক টনিক ও মননের প্রয়োজনীয় ব্যায়াম’। বুদ্ধদেব বসু ছিলেন কবিতার শিক্ষক। কবি ও কবিতা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সময়ব্যয় করা বিশ্বসাহিত্যে বিরল। শিক্ষক হিসাবেই তিনি কবিতাকে দেখেছেন। তার পাঠ, চিন্তা ও অভিজ্ঞতা কবিতার মাধ্যমেই প্রকাশ করেছেন। তার কবিতায় বোলদেয়ারসহ ইংরেজী কবিতার প্রভাব রয়েছে। বলা যায়, ইন্দো-ইউরোপীয় মিশ্রণে কবিতা ও আলোচনা শুরু করেছিলেন। প্রেমজসত্তা ধরা দিয়েছে তার কবিতায়। এ হিরন্ময় কবির হাতেই রোমান্টিকতাও ধরা দিয়েছে; আপন গতিতে।
×