ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি

প্রকাশিত: ১৯:৩৭, ২৪ অক্টোবর ২০২১

ব্রেস্ট ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ ব্রেস্ট ক্যান্সার বা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে প্রায় ৯৮ শতাংশ নারী হলেও অল্প সংখ্যক পুরুষও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। যার মধ্যে স্তন ক্যান্সার অন্যতম। স্তনের কিছু কোষ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। সেই অনিয়মিত ও অতিরিক্ত কোষগুলো বিভাজনের মাধ্যমে টিউমার বা পিণ্ডে পরিণত হয়। যার থেকেই ক্যান্সারের সূত্রপাত। স্তন ক্যান্সার এবং প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চলুন জেনে নেওয়া যাক- স্তন ক্যান্সারে রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ থেরাপি- রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ থেরাপি হচ্ছে উচ্চ শক্তির এক্স-রে, প্রোটন বা অন্যান্য কণা ব্যবহার করে ক্যান্সার কোষগুলোকে হত্যা করা। ক্যান্সার কোষের মতো দ্রুত বর্ধনশীল কোষগুলো সাধারণ কোষের তুলনায় বিকিরণ থেরাপির প্রভাবের জন্য বেশি সংবেদনশীল হয়ে থাকে। স্তন ক্যান্সারের জন্য বিকিরণ থেরাপির মাধ্যমে যেসব চিকিৎসা প্রদান করা যেতে পারে - ১) ইবিআরটি – এক্সটার্নাল বিম রেডীওথেরাপি বা বাহ্যিক বিকিরণ: একটি যন্ত্র রোগীর শরীরের বাইরে থেকে স্তন পর্যন্ত বিকিরণ পৌঁছে দেয়। এটি স্তন ক্যান্সারের জন্য ব্যবহৃত সবচেয়ে সাধারণ বিকিরণ থেরাপি। ২) ইনটার্নাল রেডিওথেরাপি বা অভ্যন্তরীণ বিকিরণ (ব্র্যাকিথেরাপি): ক্যান্সার অপসারণের জন্য সার্জারির পরে অস্থায়ীভাবে রোগীর স্তনের ক্যান্সার আক্রান্ত স্থানে একটি রেডিয়েশন-বিতরণকারী বস্তু স্থাপন করা হয়। প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য রেডিয়েশন থেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে। অস্ত্রোপচারের পরে স্তন ক্যান্সারের পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি কমাতে রেডিয়েশন থেরাপি একটি কার্যকর উপায়। উপরন্তু, এটি সাধারণত শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়া ক্যান্সারের কারণে সৃষ্ট লক্ষণগুলো সহজতর করতেও ব্যবহৃত হয় (মেটাস্ট্যাটিক স্তন ক্যান্সার)। লাম্পেকটমি’র পর বিকিরণ- যদি স্তন ক্যান্সার অপসারণের জন্য অপারেশন করা হয় এবং স্তনের টিস্যু অবশিষ্ট থাকে, তাকে লাম্পেকটমি বা ব্রেস্ট কনসার্ভেশন সার্জারি বা স্তন-সংরক্ষণের অস্ত্রোপচার বলা হয়। সেটি করার পর ক্যান্সারের কোষগুলো মেরে ফেলার জন্য বিকিরণ সম্ভব। লাম্পেকটমির পর বিকিরণ করলে আক্রান্ত স্তনে ক্যান্সার ফিরে আসার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। রেডিয়েশন থেরাপির সাথে যুক্ত লাম্পেকটমি প্রায়শই ব্রেস্ট কনসার্ভেশন সার্জারি বা স্তন সংরক্ষণ থেরাপি হিসাবে উল্ল্যেখ করা হয়। এধরণের চিকিত্সা স্তনের সমস্ত টিস্যু অপসারণ বা মাস্টেকটমি এর মতোই কার্যকর। মাস্টেকটমি’র পর বিকিরণ: মাস্টেকটমির পরেও বিকিরণ ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে অপারেশনের পূর্ববর্তী ক্যান্সারের অবস্থা এবং মাস্টেকটমি পরবর্তী বায়প্সি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অতীতে দীর্ঘ সময় ধরে ৫ থেকে ৬ সপ্তাহব্যাপী বিকিরণ চিকিৎসা বা রেডিওথেরাপী দেওয়া হলেও এখন তার পাশাপাশি ৩ সপ্তাহের মধ্যে এমনকি ১ সপ্তাহে রেডিওথেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। যদি স্তন ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে তাকে মেটাস্টাসিস বলা হয়। সেক্ষেত্রে ক্যান্সারকে সঙ্কুচিত করতে এবং ব্যথার মতো উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে রেডিয়েশনথেরাপি ব্যবহার করা যেতে পারে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ- বিকিরণ থেরাপি থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো চিকিৎসার ধরণ এবং কোন টিস্যুগুলো বিকিরণ পাচ্ছে তার উপর নির্ভর করে নানাভাবে প্রকাশ পেতে পারে। সাধারণত বিকিরণ চিকিৎসার তৃতীয় সপ্তাহ থেকে কিংবা শেষের দিকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো সর্বাধিক পরিলক্ষিত হয়। স্তন ক্যান্সারে বিকিরণ চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসমূহ হলো; হালকা থেকে মাঝারি ক্লান্তি, ত্বকের জ্বালা (চুলকানি, লালভাব, খোসা বা ফোস্কা ইত্যাদি), স্তন ফুলে যাওয়া, বাহুর নিচে লিম্ফ নোডগুলো চিকিৎসা করা হলে বাহু ফুলে যাওয়া (লিম্ফডেমা) ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলো কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যায় বা কমে যায় এবং উন্নত পদ্ধতিতে চিকিৎসা গ্রহণ করলে এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্ভাবনা কমে যায়। চিকিৎসা ও চিকিৎসক- রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট, একজন চিকিৎসক যিনি রেডিয়েশন দিয়ে ক্যান্সারের চিকিৎসায় পারদর্শী। রেডিয়েশন অঙ্কোলজিস্ট রোগীর জন্য উপযুক্ত থেরাপি নির্ধারণ করেন, চিকিৎসার অগ্রগতি অনুসরণ করেন এবং প্রয়োজনে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা প্রদান করেন। এছাড়াও রেডিয়েশন অনকোলজি মেডিকেল ফিজিসিস্ট এবং ডোসিমেট্রিস্ট রেডিয়েশনের ডোজ এবং ডেলিভারি সংক্রান্ত কাজ করেন। রেডিয়েশন টেকনোলজিস্ট বিকিরণ চিকিৎসার মেশিনের মাধ্যমে রোগীর চিকিৎসা পরিচালনা করেন। একজন রেডিয়েশন অনকোলজি নার্স বা চিকিৎসক সহকারী, যিনি চিকিৎসা এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন এবং চিকিৎসার সময় স্বাস্থ্য পরিচালনা করতে সহায়তা করেন। কাজেই এটি একটি ‘টিম ওয়ার্ক’ এবং সকলের অংশগ্রহণেই বিকিরণ চিকিৎসা সফলভাবে সম্পন্ন হয়। আমাদের দেশে এখন অনেক হাসপাতালেই যেকোনো ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করার পূর্বে টিউমার বোর্ড আয়োজন করা হয়। ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে টিউমার বোর্ড একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এখানে একজন সার্জন, একজন রেডিওথেরাপিস্ট, একজন মেডিকেল অনকোলজিস্ট বা কেমোথেরাপিস্ট, হিস্টোপ্যাথলজিস্ট বা বায়োপ্সি রিপোর্টকারী, রেডিওলজিস্ট বা সিটি স্ক্যান-এমআরআই রিপোর্টকারী সহ আরো অন্যান্য সদস্যরা উপস্থিত থাকেন। রোগীর মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত করাই এইসবের মূল উদ্দেশ্য। টিউমার বোর্ডের চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় কখনো কখনো নিও-এডজুভেন্ট থেরাপি বা অপারেশনের আগে থেরাপির মাধ্যমে টিউমারকে ছোট করার পর অপারেশনের করা হতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে শুরুতেই অপারেশন করে ফেলা হয়। অনেক সময় হরমোনথেরাপির মাধ্যমেও চিকিৎসা শুরু করা হয়। তবে হরমোনথেরাপি দিয়ে চিকিৎসা শুরুর আগে অবশ্যই বায়োপ্সির পাশাপাশি ইমিউনো হিস্টোকেমিস্ট্রি করে হরমোন রিসেপ্টরের অবস্থা জেনে নিতে হয়। এভাবে রোগীর অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপি এবং কখনো কখনো ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে ক্যান্সারের চিকিৎসা সম্পন্ন হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ণ উন্নতির ফলস্বরূপ আমাদের দেশেই এখন স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তদের সব ধরণের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদ্যমান। প্রয়োজন শুধু সঠিক চিকিৎসক এবং মানসম্মত হাসপাতাল বাছাই করা। ডা. আরমান রেজা চৌধুরী ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ
×