ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ডেসটিনি টু ইভ্যালি ডিজিটাল ফাঁদ ৪

ই-কমার্সের নামে অদ্ভুত ব্যবসা মডেল

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

ই-কমার্সের নামে অদ্ভুত ব্যবসা মডেল

রহিম শেখ ॥ ২০০২ সালে ডেসটিনিসহ দেশে বহুস্তর বিপণন পদ্ধতি বা এমএলএম কোম্পানি ছিল ১৬টি। ২০০৬ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪টিতে। বর্তমানে দেশে অন্তত শতাধিক এমএলএম কোম্পানির খোঁজ মিলেছে। কিন্তু একটি কোম্পানিকেও লাইসেন্স দেয়নি সরকার। অর্থাৎ দেশে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা একেবারেই নিষিদ্ধ। বর্তমানে প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-বিজনেস ও ডাইরেক্ট টেলিমার্কেটিং ইত্যাদি নামে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি গড়ে উঠেছে। এসব ব্যবসা পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতের কিছু অসাধু কোম্পানি। এর মধ্যে অন্যতম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ইভ্যালি’। ‘সাইক্লোন’ অফার (বাজার মূল্যের অর্ধেক মূল্যে পণ্য বিক্রয়), ‘ক্যাশব্যাক’ অফার (মূল্যের ৫০-১৫০ ভাগ ক্যাশব্যাক অফার), টি-১০, টি-৫ ও টি-৩, ‘আর্থকোয়াক’ অফারের নামে ‘অদ্ভুত’ ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। কোম্পানিটির শুরু থেকেই ক্রেতাদের অভিযোগ ছিল অগ্রিম টাকা পরিশোধের পরও সময়মতো হাতে এসে পৌঁছাচ্ছে না অর্ডার করা পণ্য। এরপর দিন, মাস, বছর পেরিয়ে গেলেও পণ্যই পায়নি ক্রেতা। শুধু ইভ্যালি নয়, এ তালিকায় আরও রয়েছে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদীনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডিসহ অন্তত ২৬ কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে ডিজিটাল কমার্স সেল গঠন করা হয়েছে, সেখানে আলাদা করে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। অনেক মন্ত্রণালয় ই-কমার্স নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই। জানা যায়, ডেসটিনি গ্রæপের অনিয়ম-দুর্নীতি ও প্রতারণার ফাঁদ ধরা পড়ার পর সরকার বিষয়টি প্রথম আমলে নেয় ২০১২ সালে। এমএলএম পদ্ধতির ব্যবসায়ের মাধ্যমে এক যুগ ধরে (২০০০-২০১২) ডেসটিনি মানুষের কাছ থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি সংগ্রহ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করেছে। প্রায় সব প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে গ্রাহকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা পাঁচ হাজার কোটি টাকার মধ্যে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা। এরপর ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রণয়ন করা হয় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কার্যক্রম (নিয়ন্ত্রণ) আইন। এই আইনের অধীনে ২০১৪ সালের ফেব্রæয়ারিতে করা হয় বিধিমালা, যা আবার সংশোধন করা হয় ওই বছরের ২২ জুলাই। আইনে উল্লেখ করা হয়েছে, পিরামিডসদৃশ বিপণন কার্যক্রম চালানো, সুনির্দিষ্ট তথ্যসহ মোড়কজাত না করে পণ্য বিক্রি, প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী পণ্য বা সেবা বিক্রি না করা, পণ্য বা সেবার অযৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ, নিম্নমানের পণ্য বা সেবা বিক্রি করা এবং অসত্য, কাল্পনিক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বিজ্ঞাপন প্রচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এসব বিবেচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চ‚ড়ান্তভাবে একটি কোম্পানিকেও আর লাইসেন্স দেয়নি। কিন্তু প্রতারণার ধরন পাল্টে ই-বিজনেস ও ডাইরেক্ট টেলিমার্কেটিং ইত্যাদি নামে বিভিন্ন এমএলএম কোম্পানি গড়ে উঠেছে। হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। অধিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো সদস্য বানাচ্ছে সহজ-সরল তরুণ-তরুণীদের। বহুস্তর বিপণন পদ্ধতি বা এমএলএম ব্যবসা পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্ভাবনাময় ই-কমার্স খাতের কিছু অসাধু কোম্পানি। কখনও ‘সাইক্লোন’, কখনও ‘আর্থকোয়াক’, আবার কোন সময় ‘পুরাই গরম’। পানির দরে পণ্য বেচতে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে অনলাইনভিত্তিক ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ‘ইভ্যালি’। ইভ্যালির পিলে চমকানো রাজকীয় ছাড় আর লোভনীয় ক্যাশব্যাক অফারের ফুলঝুরিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত লাখ লাখ মানুষ। ইভ্যালির বিক্রি বাড়াতে গ্রাহকদের প্রতিনিয়ত চাহিদা তৈরি হয় এ ধরনের পণ্যকে বেছে নেয়া হতো। মূল্য ছাড়ের ফলে যার ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। এর ফলে ক্রমান্বয়ে প্রতিষ্ঠানটির দায় বাড়তে থাকে। প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্কে যত গ্রাহক তৈরি হতো, দায় তত বৃদ্ধি পায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মূলত একটি বিদেশী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় অফারের (১:২) আলোকে ইভ্যালির ব্যবসায়িক কৌশল তৈরি করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও মোহাম্মদ রাসেল। তিনি আরও বলেন, প্রথমত একটি ব্রান্ড ভ্যালু তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। এরপর দায়সহ কোন প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছে বিক্রি করে লভ্যাংশ নেয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণও করেছেন। শুধু ইভ্যালি নয়, অভিনব প্রতারণার এ তালিকায় আরও রয়েছে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা শপিং, সিরাজগঞ্জ শপিং, আলাদীনের প্রদীপ, বুম বুম, কিউকম, আদিয়ান মার্ট ও নিডস ডটকম বিডিসহ অন্তত ২৬ কোম্পানি। এদিকে আইডি খোলার নাম করে ‘রিং আইডি’ নামের একটি ই-কমার্স কোম্পানি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বেশি মুনাফার আশায় এখানে বিনিয়োগ করছেন গ্রাহকরা। কয়েকজন গ্রাহক জনকণ্ঠকে জানান, ‘গোল্ড মেম্বারশিপ’ কেনার জন্য এক মাস আগে ২২ হাজার টাকা করে পেমেন্ট করেন তারা। এ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও কেটে নেয়া হয়। কিন্তু তাদের আইডি এখনও এ্যাকটিভ হয়নি। এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে জায়গায় যোগাযোগ করেও কোন কাজ হয়নি। এভাবে মেম্বারশিপের নামে শত শত গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে রিং আইডি। ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন (ই-ক্যাব) জানিয়েছে, ক্রেতাদের পণ্য বা মূল্য ফেরত না দেয়া, ই-ক্যাবকে নতুন মালিকদের পূর্ণ তথ্য না দেয়ায় ই-অরেঞ্জের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। অর্থ আত্মসাত, ই-ক্যাবের চিঠির জবাব না দেয়া, অফিস বন্ধ পাওয়ায় টোয়েন্টিফোর টিকেটির সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। এছাড়া আর গ্রীনবাংলা ই-কমার্স ও এক্সিলেন্ট ওয়ার্ল্ড এ্যাগ্রো ফুড এ্যান্ড কনজ্যুমার লিমিটেডের বিরুদ্ধে এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ পাওয়ায় তাদের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে। এছাড়া ৯টি প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শানো নোটিস দিয়েছে ই-ক্যাব। এগুলো হচ্ছে ইভ্যালি ডট কম লিমিটেড : ফাল্গুনী শপ ডট কম, আলেশা মার্ট, ধামাকা শপিং, আদিয়ান মার্ট, সিরাজগঞ্জ শপ, আমার বাজার লিমিটেড, গিøটার্স আরএসটি ওয়ার্ল্ড ও এ্যানেক্স ওয়ার্ল্ড ওয়াইড লিমিটেড। বিতর্কিত এসব ই-কমার্স কোম্পানির ব্যবসায়িক মডেল প্রচলিত ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বছরখানেক আগেই সরকারকে তাদের সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়ে জানিয়েছিলাম। ইভ্যালিসহ আমাদের যেসব সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, আমরা তাদের প্রথমে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছি। কিছু প্রতিষ্ঠানের সদস্য পদ স্থগিত করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করে এ্যানালগ পদ্ধতিতে প্রতারণা মোকাবেলা করার চেষ্টা করছি। ই-কমার্স খাতে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে তা মোকাবেলায় আমাদের নজরদারি সংস্থাগুলোর পর্যাপ্ত লোকবল, শক্তিশালী মনিটরিং সিস্টেম নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যে ডিজিটাল কমার্স সেল গঠন করা হয়েছে, সেখানে আলাদা করে লোকবল নিয়োগ করা হয়নি। সবচেয়ে বড় সমস্যা অনেক মন্ত্রণালয় ই-কমার্স নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও এসব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় নেই।
×