ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বিচার হয়েছে মাত্র একটির

সাত বছরে ৩৮৩ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার

প্রকাশিত: ২১:৫২, ৪ আগস্ট ২০২১

সাত বছরে ৩৮৩ গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার

ফজলুর রহমান ॥ দেশে গৃহ শ্রমিকদের শতকরা ৫০ ভাগ ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন। তবে খুব কম ক্ষেত্রেই বিচার হয়। মামলা হলেও পরে চাপের মুখে সমঝোতা বা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলাগুলো আর কার্যকর থাকে না। এখন পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া যায়, তাতে বাংলাদেশে গৃহকর্মী নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিচার পাওয়ার একটি উদাহরণই এখন পর্যন্ত আলোচিত। আর তা হলো গৃহকর্মী আদুরি নির্যাতনের বিচার। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০১৩ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩৮৩ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও মাত্র ১৭১টি ঘটনায় বিভিন্ন থানায় নির্যাতন ও অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। এরমধ্যে ১৭৬ জনের শারীরিক নির্যাতনে ও অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসও এই সংখ্যা কম নয়। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ২৫ জন গৃহ শ্রমিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের পর মারা গেছেন দু’জন। মামলা হয়েছে ১৭টি। গৃহকর্মীদের নিয়ে কাজ করা আরেকটি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস্) এর গবেষণায় বলা হয়, শতকরা ৫০ ভাগ গৃহপরিচারিকা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার। তাদের ৬০ শতাংশই শিশু। বিপুলসংখ্যক গৃহকর্মী আত্মহত্যা করেছেন। এই আত্মহত্যার বিষয়টি স্বাভাবিক আত্মহত্যা মনে করার কোন কারণ নেই। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে নির্যাতন করে রাজধানীর পল্লবীতে একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়। এ ঘটনায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান ও তার মা ইসরাত জাহানকে তখন গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালতে অভিযোগ প্রমাণ হলে ঘটনার চার বছর পর ২০১৮ সালের ১৮ জুলাই নওরীন জাহানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত। নওরীন জাহান এখন কারাগারে দণ্ড ভোগ করছেন। গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা আসক ও বিলসের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের জানা মতে এই একটি নির্যাতনের ঘটনায়ই এ পর্যন্ত বিচার পাওয়া গেছে। পুলিশ ও আদালত সূত্রও বলছে, আদুরির ঘটনা ছাড়া গৃহকর্মী নির্যাতনের আর কোন ঘটনায় বিচার হয়নি। ২০১৫ সালে ঢাকায় ১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে মারাত্মকভাবে নির্যাতনের অভিযোগে ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু পরের বছর ২০১৬ সালের ৬ নবেম্বর আদালত ক্রিকেটার শাহাদাত ও জেসমিন জাহানকে বেকসুর খালাস দেন। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শ্যামপুরে লাবনী নামের এক গৃহকর্মীর গায়ে গরম ভাতের মাড় ঢেলে নির্যাতন চালানোর অভিযোগে গৃহকর্ত্রী মারিয়া সুলতানাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু আদালতে দেয়া কদমতলী থানার চার্জশীটে ওই গৃহকর্মী ছাড়া আর কোন সাক্ষীর নাম নেই বলে জানা গেছে। ২৭ মার্চ রাতে শাহআলীর প্রিয়াঙ্কা হাউজিংয়ে নির্যাতনের শিকার হন গৃহকর্মী বুলি। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে গৃহকর্তা এবিএম হাসানুজ্জামান ও গৃহকর্ত্রী রেহেনা আক্তারকে আসামি করে ২০১৭ সালের ৪ জুলাই আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে শাহআলী থানা পুলিশ। কিন্তু পরে আসামিপক্ষ দুই লাখ টাকার বিনিময়ে বাদীপক্ষের সঙ্গে আপোস করে ফেলে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোর্শেদ জনকণ্ঠকে বলেন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় যদি দৃশ্যমান বিচার হতো এবং সেটি অল্প সময়ে হলে এসব কমে আসতো। বিচার বিভাগে মামলাজটের কারণেও অনেক সময় মামলা নিষ্পত্তিতে দেরি হয়। আবার নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চার্জশীট আসতে অনেক সময় লেগে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী সাক্ষী হাজির করতে পারেন না। কিংবা সমঝোতা করে ফেলেন। তখন পুলিশেরও কিছু করার থাকে না। সমঝোতা না করে ভুক্তভোগীরা যদি বিচার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখেন এবং বিচারটা হোক- এই প্রত্যয় থাকে তাহলে গৃহকর্মী নির্যাতন কমে আসবে। গৃহকর্মী নির্যাতনের প্রতিকারের ব্যাপারে রাজধানীতে পুলিশের ভূমিকা প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশংসনীয়। মামলা দায়ের, আসামি আটকে তৎপর থাকে পুলিশ। কিন্তু তদন্ত থেকে পরবর্তী পর্যায়ে আর এগোয় না। পুলিশ, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে বিষয়টি গুরুত্ব দিলে এমন ঘৃণিত কাজে জড়িত সকলকে শাস্তি পেতেই হবে বলে মনে করছেন নগরবাসী। তবে গৃহকর্মী নির্যাতনের অনেক মামলায় পুলিশের সাক্ষী হাজির করাতে কিংবা চার্জশীট দিতে দেরি হয় বলেও ওই মামলার বিচার কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়। এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের ডিআইডি (মিডিয়া) হায়দার আলী খান জনকণ্ঠকে বলেন, একটি ঘটনার সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চার্জশীট দেয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যখন সেটির রায় হতে ১০-১২ বছর লেগে যায় তখন সাক্ষীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অনেকে দেশের বাইরে চলে যান কিংবা মারাও যান। এমনকি ঘটনার ভুক্তভোগীও এক সময় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। একপর্যায়ে সমঝোতা করে ফেলেন। তবে গৃহকর্মী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতরা যত প্রভাবশালী হোক না কেন পুলিশ তাদের আইনের আওতায় আনছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫-১৬ সালের ত্রৈ-মাসিক বাংলাদেশ লেবার ফোর্স সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশে গৃহস্থালি কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৬৯ হাজার। যার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ নারী। এদের মধ্যে ৬৯.৬ শতাংশ শ্রমিক শহরে এবং প্রায় ৩৭.৩ শতাংশ শ্রমিক গ্রামাঞ্চলে কাজ করে। তবে শ্রমিকদের ২৩টি সংগঠনের সাধারণ ধারণা অনুযায়ী, বর্তমানে ২০ লাখের বেশি মানুষ গৃহকর্মে নিয়োজিত। গৃহকর্মীদের নিয়োগ, বেতন কাঠামো, কাজের সময় বরাবরই অনিশ্চিত ছিল। তাই ২০১৫ সালে ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণনীতি’ করা হয়। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের জন্য একটি মনিটরিং সেল করা হলেও প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে কার্যত কিছুই হয়নি। তবে এটি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের গৃহকর্মী বিষয়ক কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেলের সদস্য ড. ওয়াজেদুল ইসলাম খান। নির্যাতন চলছেই ॥ প্রায়ই গৃহকর্মী নির্যাতন, হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়। নির্যাতনের ঘটনায় যত প্রভাবশালী ব্যক্তি জড়িত থাকুক না কেন তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অল্প সময়ে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনছে। এতকিছুর পরও থেমে নেই গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা। চলতি বছরেও জনদৃষ্টি কাড়া কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ শনিবার বিকেলে হাতিরঝিল উলন রোডের একটি বাসায় হাজেরা বেগম (৩০) নামের এক গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে চিত্রনায়িকা একা’কে আটক করে পুলিশ। ট্রিপল নাইনে কল পেয়ে একার বাসায় গিয়ে গৃহকর্মীকে উদ্ধারের সময় তার বাসা থেকে মাদক উদ্ধারের কথাও জানায় পুলিশ। গৃহকর্মী নির্যাতন ও মাদক মামলায় রবিবার তাকে আদালতে প্রেরণ করলে তাকে কারাগারে পাঠায় আদালত।
×