ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকায় সংক্রমণ বেড়ে দ্বিগুণ

প্রকাশিত: ২৩:০১, ২৪ জুন ২০২১

ঢাকায় সংক্রমণ বেড়ে দ্বিগুণ

অপূর্ব কুমার ॥ রাজধানী ঢাকার করোনা পরিস্থিতির দ্রæত অবনতি ঘটছে। গত চার দিনে সংক্রমণের হার বেড়েছে দ্বিগুণ। গত ২৪ ঘণ্টায় বেড়েছে শতাংশ। কয়েকদিন ধরেই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল ঢাকার সংক্রমণ। এই সংক্রমণ রোধে কঠোরভাবে বিধিনিষেধ প্রতিপালন ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি। স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ঈদের পর ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে সংক্রমণ বাড়লেও এখন সারাদেশেই আশঙ্কাজনক হারে সংক্রমণ বাড়ছে। খোদ আইসিডিডিআরবির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমানে ঢাকা শহরে করোনা সংক্রমণের ৬৮ শতাংশই ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে হচ্ছে। এই ভ্যারিয়েন্টের কারণেই সপ্তাহের ব্যবধানে সংক্রমণের গতি উর্ধমুখী। রোগী শনাক্তের হার বাড়ার পাশাপাশি রাজধানীর কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড়ও বাড়ছে। প্রতিদিনই আগের দিনের তুলনায় ভর্তি হতে যাওয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আইসিইউগুলোতে রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। একদিনের ব্যবধানে ঢাকাতে করোনা সংক্রমণ আগের দিনের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। বুধবার মহানগরসহ ঢাকা জেলায় ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ হারে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। দিনটিতে মোট ১৩ হাজার ২৪০টি নমুনা সংগ্রহের বিপরীতে মোট ২ হাজার ৬৪ রোগী শনাক্ত হয়। গত মঙ্গলবার রোগী শনাক্তের হার ছিল ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ। আগের দিন সোমবার ঢাকা মহানগরে শনাক্তের হার ছিল ১১ দশমিক ৭৩ শতাংশ। ২০ জুন এই হার ছিল ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ১৯ জুন রোগী শনাক্তের হার ছিল ১৪ দশমিক ১৬ শতাংশ। ১৮ জুন করোনা শনাক্তের হার ছিল ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ১৭ জুন এই হার ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ ছিল। ১৬ জুন রোগী শনাক্তের হার ছিল ১০ দশমিক ৫৬ শতাংশ। আগের সপ্তাহেও পুরোটা নিয়ন্ত্রণে না থাকলে রোগী শনাক্তের হার এতটা উর্ধমুখী ছিল না। সারাদেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় রাজধানীর সঙ্গে সারাদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে মঙ্গলবার থেকে আশপাশের সাত জেলায় কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়। সড়ক, রেল ও নৌপথ সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র ও নন-কমিউনিকেবল ডিজিজের (এনসিডিসি) পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ রোবেদ আমিন বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যু ক্রমেই বাড়ছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে বিভিন্ন বিভাগে করোনার সংক্রমণ সর্বোচ্চ ৮৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত ১৪-২০ জুন পর্যন্ত মাত্র এক সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৪০০ জনেরও বেশি মানুষের। তার মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর উর্ধগতি রোধে কঠোরভাবে লকডাউন (বিধিনিষেধ) প্রতিপালন এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় লকডাউন প্রতিপালনে প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। রোবেদ আমিন বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং হাসপাতালের সেবাদান সুশৃঙ্খল রাখার উদ্দেশ্যে ঢাকার চারপাশে লকডাউন দেয়া হয়েছে। করোনা সংক্রমণ কমিয়ে আনার জন্য চলমান লকডাউন ও বিধিনিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য সবাইকে অনুরোধ করা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা আছেন, প্রয়োজনে তাদের কঠোর হতে হবে। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে উর্ধমুখী সংক্রমণ পরিস্থিতিতে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য, হাসপাতালে সেবাদানের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য সহায়ক জনবলের প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে। নিত্যদিন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। এর ব্যতিক্রম হলে করোনা পরিস্থিতি চরম বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকলেও পরে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় সংক্রমণের হার অনেক বেশি। গত এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন বিভাগে সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যানে পরিবর্তন এসেছে। তিনি বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে রংপুর বিভাগে ৮৬ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে প্রায় ৫০ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪২ শতাংশ, ঢাকা বিভাগে ১৪ শতাংশ, খুলনা বিভাগে প্রায় ৫০ শতাংশ ও ময়মনসিংহে প্রায় ৬২ শতাংশ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু রাজশাহী বিভাগে সংক্রমণ বর্তমানে কিছুটা কম, প্রায় ১৩ শতাংশ। গত ১৪-২০ জুন পর্যন্ত করোনায় ৪৩০ জনের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ১২০ জন, রাজশাহী বিভাগে ৯০ এবং ঢাকা বিভাগে ৮৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ অসীম কুমার নাথ বলেন, করোনা আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। তবে আগের সপ্তাহের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে খুব বেশি বাড়েনি। এখন প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ জন করে করোনা রোগী ভর্তি হচ্ছেন। আমাদের সাধারণ ৩০০ বেডের মধ্যে মঙ্গলবার বেডে রোগী আছে ১২৯ জন। সোমবার ছিল ১২১ জন, রবিবার দিন ছিল ১১৫ জন। এছাড়া ২৪টি আইসিইউ (ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট) বেডে ২৩ জন রোগী ভর্তি আছেন। আক্রান্ত বাড়লেও এখনও এ হার খুব বেশি নয় উল্লেখ করে হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, ভয়াবহ প্রভাব ঠেকাতে সতর্ক হতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। যদি আক্রান্তের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ে আর পরিস্থিতি আস্তে আস্তে অবনতি হয়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাবে। কারণ সঠিক সময়ে আমরা পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন পাচ্ছি না। তাই বিধিনিষেধ বা লকডাউনের চেয়ে বড় কথা- সবাইকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরতে হবে। এ বিষয়টিতে বেশি জোর দেয়া জরুরী। তিনি জানান, চলতি মাসের শুরুতে প্রতিদিন গড়ে ৭০ জনের মতো করোনা রোগী চিকিৎসা নিতেন, এখন তা ১০০ ছাড়িয়েছে। এক সপ্তাহ ধরে গড়ে ১০০-এর বেশি রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। ভর্তির হার জুন মাসের শুরুতে ছিল ৫-৬ জন; এখন বেড়ে প্রতিদিন ১০-১২ জনে দাঁড়িয়েছে। করোনার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডাঃ অসীম কুমার জানান, সার্বিকভাবে বলতে গেলে পরিস্থিতি ভাল মনে হচ্ছে না। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এখানে এক জেলা থেকে অন্য জেলার যোগাযোগ খুব বেশি। মানুষ অনেক মুভমেন্ট করে। তার মানে যতই কড়াকড়ি করা হোক, রোগটা ছড়াবেই। যেভাবে রোগী বাড়ছে তা অব্যাহত থাকলে এ মাসের শেষে বা জুলাইয়ের শুরুর দিকে আমাদের জন্য খারাপ সময় আসতে পারে বলেও আশঙ্কা তার। আর এ জন্য সতর্ক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখছেন না এই চিকিৎসক। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে রোগী বাড়ছে ॥ রাজধানীতে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ায় রোগীর চাপ আবারও বাড়তে শুরু করেছে রাজধানীর উত্তরায় কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারী হাসপাতালে। ২২ দিনের ব্যবধানে হাসপাতালটিতে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে। বুধবার সকালের দিকে হাসপাতালটির জরুরী শাখা থেকে এসব তথ্য জানানো হয়। হাসপাতালের আইসিইউ ইউনিটের দায়িত্বে থাকা এ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিভাগীয় প্রধান ডাঃ মোঃ আসাদুজ্জামান বলেন, এক সপ্তাহের ব্যবধানে আইসিইউ বেডের ওপর চাপ বেড়েছে। চালু থাকা ১০টি আইসিইউ বেডেই রোগী ভর্তি রয়েছে। পরিস্থিতি অনেকটা আগের মতো ভয়াবহ হওয়ার পথে। এখনই আমাদের সবাইকে সাবধান হতে হবে। হাসপাতালের জরুরী শাখা সূত্র জানায়, চলতি মাসের ১ তারিখ ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ২৮ জন। বুধবার সকাল ৮টা পর্যন্ত মোট ৬৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছেন। পাশাপাশি ১০ জন রয়েছেন আইসিইউ বেডে। সবমিলিয়ে সংখ্যাটা ৭৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
×