ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সাবিহা রহমান

বসন্ত এসেছে প্রকৃতিতে

প্রকাশিত: ২২:০৪, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বসন্ত এসেছে প্রকৃতিতে

‘এসো এসো বসন্ত, ধরাতলে আনো মুহুর্মুহু নব তান, আনো নব প্রাণ, নব গান, আনো গন্ধমদভরে অলস সমীরণ, আনো বিশ্বের অন্তরে অন্তরে, নিবিড় চেতনা।’ কবিগুরু“ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্তের কাছে চেয়েছেন অনেক কিছু। নব প্রাণ, উচ্ছ্বাস আর নব চেতনা বসন্ত ছাড়া কোথায় পাওয়া যাবে। বাংলার প্রকৃতিতে বসন্তের রাজকীয় আবির্ভাব প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের মনকেও আন্দোলিত করে গভীর আবেশে। সে জন্যই বুঝি বসন্তই ঋতুরাজ। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঋতুর পালাবদল হয়ত আগের মতো চোখে পড়ে না। তবে বাংলাদেশ এখনও ষড়ঋতুর দেশ। এখনও ঋতুর পালাবদলে পাল্টে যায় আমাদের জীবনযাপনের ধরন। এখনো প্রকৃতি আর মনকে নানা রঙে সাজিয়ে বসন্তের আগমন ঘটে। বাঙালীর জীবনযাপনে, আচার-আচরণে, পালা-পার্বণে বসন্তের প্রভাব অনেক। একেই ইট-কাঠ-পাথরের নগর, তাতে আবার শত নাগরিক ব্যস্ততা। ঋতুরাজ বসন্তের অপরূপ রূপের খোঁজ করার সময় কোথায়। তবুও অন্তরলোক যেমন কান পেতে থাকে কোকিলের ডাক শুনতে, তেমনি থেমে থাকে না বসন্ত বরণের নানা আয়োজনও। আধুনিককালে এসে আমরা ফাল্গুনের প্রথম দিনটিতেই নির্দিষ্টভাবে বসন্তবরণ উতসব পালন করছি। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহর-বন্দর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা উৎসব-আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্ত বরণ হয়। পাশাপাশি গ্রামের মতো শহরেও এখন বসন্ত মেলার আয়োজন হয়। এদিকে, বাংলার নিজস্ব রীতিতে বসন্তবরণ এখন আর বাংলাদেশের সীমানায় আটকে নেই। প্রবাসের নানা প্রান্তে প্রবাসী বাঙালীরা বসন্ত বরণের নানা আয়োজনের চেষ্টা করেন এখন। বিশ্বের নানা দেশের অধিবাসীরা অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে বাঙালীর সুদৃঢ় সাংস্কৃতিক শক্তিকে। বসন্তে উৎসবের ঐতিহ্য প্রকৃতির বিচিত্র রূপ বাংলার সংস্কৃতিকে বিশিষ্ট মর্যাদায় ভূষিত করেছে। বসন্ত এই রূপ বৈচিত্র্যেই অংশ। বসন্ত বরণের জন্য বাঙালীর জীবনে সুনির্দিষ্ট কোন দিন ছিল না, ফাল্গুন-চৈত্র মাসে গ্রামের ঘরে ঘরে নানা উৎসব লেগে থাকত। সে উৎসবগুলোর বিবর্তিত রূপই আজকের বসন্তবরণ উৎসব। প্রাচীনকাল থেকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও জাতি-ধর্মের মানুষ নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্তবরণ করে আসছে। প্রাচীন বাংলার একটি জনপ্রিয় বসন্ত উৎসব হচ্ছে দোল ও রাস উৎসব। ফাল্গুন মাসের শুক্লা দ্বাদশীতে দোল উৎসব হতো। এদিন তরুণরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে রং খেলতেন। দোল ও রাস উৎসব মূলত বাংলার বৈষ্ণবসম্প্রদায়ের উৎসব। এখনও রাস উৎসব দোল পূর্ণিমা উপলক্ষে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে মেলা বসে। বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের ভবানীপুরের রাস মেলা খুবই বিখ্যাত। এখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজ শিল্পীদের সমাগম ঘটে। লোকজ গায়করা কীর্তনসহ বিভিন্ন লোকসঙ্গীত পরিবেশন করেন। বরিশালের কুয়াকাটায় রাসপূর্ণিমায় মেলা বসে। বসন্তকালের এসব মেলায় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু সামগ্রী কিনতে পাওয়া যায়। এ ছাড়া হস্তশিল্পজাত অনেক সামগ্রীও পাওয়া যায় এসব মেলায়। দূর-দূরান্ত থেকে লোক ও কারুশিল্পীরা তাঁদের পসরা নিয়ে আসেন। দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও যেসব রাস মেলা হয়, তার মধ্যে বিখ্যাত সাতক্ষীরার শ্মশানঘাট মেলা, দেবহাটা রাস মেলা, ফরিদপুরের রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ জেলার রাস মেলা প্রভৃতি। গোপালপুর ও শ্যামনগরের দোল মেলাও বিখ্যাত। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ ও নদীয়ায় বসন্তকালে রাস মেলা বসে। কৃষ্ণ নগরের ও কালনার রাস মেলা ও দোল উৎসবের বয়স ৩০০ বছরেরও বেশি। এ ছাড়া কোচবিহারের করিমপুর, কাটিহার, কোরা ও লাভপুরের রাস মেলাও ঐতিহ্যবাহী। বসন্তকালে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে চড়কপূজার আয়োজন হয় শ্রীচৈতন্যের স্মরণে। চড়কপূজা উপলক্ষেও বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা বসে। চড়কের মেলায় সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন রকম খেলা ও বাজির কৌশল পরিবেশন করেন। মেলায় কীর্তন, যাত্রা, পালাগান ও পুতুলনাচের আসর বসে। রাস মেলায় কবিগানের আসরও খুব জনপ্রিয়। এভাবে নানা ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের মধ্য দিয়ে পুরো বসন্তকালকে বরণ করা হতো। যদিও সময়ের আবর্তে দোল উৎসবের জাঁকজমক আয়োজন কমে গেছে অনেকটাই। এই উৎসব অনুষ্ঠান বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং বাঙালীর একান্ত নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য। আবহমানকাল ধরে চলে আসা এ উৎসবগুলো মূলত বসন্তকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হতো। প্রকৃতি ও প্রেমের মেলবন্ধন বসন্ত প্রেম প্রকৃতি ও সৌন্দর্যের মেলবন্ধনের ঋতু। বাংলা কবিতা, উপন্যাসে নানারূপে নানাভাবে বসন্তের আবির্ভাব ঘটেছে। কখনও জীবনের আকুল আহ্বান, কখনও নব প্রাণের উন্মাদনা, কখনও চিরায়ত বাংলার রূপ, এ রকম নানারূপে বসন্তের জয়গান এসেছে বাংলা সাহিত্যে। বসন্ত মানেই যেন কেবল ফুল আর ফুল। গাছে গাছে নতুন পাতা, আমের মুকুল। কোকিলের নিরলস কণ্ঠের কুহু কুহু গান। তীব্র শীতে ঝিমিয়ে পড়া প্রকৃতি যেন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠে বসন্তে। শিমুল, পলাশ চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, মাধবী, বকুলসহ নানা রঙের বাহারি ফুল পাখ-পাখালির মেলায় নিজের অস্তিত্বকে মহাসমারোহে জানান দেয় ঋতুরাজ। বসন্তের এই রূপ কিছুটা কমে গেলেও, বসন্তের আবেদন কমেনি মোটেই। নাগরিক বসন্তে হয়ত কোকিলের সুমধুর কুহু কুহু নেই, নেই হরেক ফুলের ম ম গন্ধ। কিন্তু তারুণ্যের জয়গান আছে। নব স্বপ্নের উন্মাদনা আছে। আছে তারুণ্যের বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। তাই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অমর কবিতার মতোই ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত।’
×