ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বগুড়া বায়ুদূষণের অন্যতম নগরীতে পরিণত

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৯ জানুয়ারি ২০২১

বগুড়া বায়ুদূষণের অন্যতম নগরীতে পরিণত

সমুদ্র হক, বগুড়া অফিস ॥ দেখে মনে হবে কুয়াশা। তা কিছুটা ঠিক। তবে এই কুয়াশার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাতাসে উড়ে বেড়ানো দূষিত ধূলিকণা ও রাসায়নিক অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা। যা দূষিত বায়ু। এভাবেই বগুড়া নগরীতে বায়ুদূষণের মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়েছে। এই মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে গিয়ে নগরী ও আশপাশের এলাকায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে এবং অনিয়ন্ত্রিত। বেড়েছে বায়ুদূষণজনিত নানা রোগ ব্যাধি। করোনাকালে সাধারণ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা নিয়ম মেনে ব্যবহার করা হচ্ছে না। ফলে বায়ুদূষণে রোগ ব্যাধি ছড়ানোর মাত্রা খুব একটা কমেনি। এই বিষয়ে একজন চিকিৎসক বলেন, পথ চলাচলে কিছুটা সময়ের জন্য মাস্ক নিচে নামিয়ে রাখলে ও মাস্ক খুলে ফেললে দূষিত বায়ু নাক ও মুখ দিয়ে দ্রুত দেহে প্রবেশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার তৈরি বায়ুর মান সূচকে (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স সংক্ষেপে এ কিউ আই) বাংলাদেশে দূষিত নগরীর অন্যতম তালিকায় স্থান পেয়েছে বগুড়া। বগুড়া নগরীর এ কিউ আই ২০৪ থেকে ২৯০’র মধ্যে ওঠানামা করছে। আন্তর্জাতিক সূচকে বগুড়া নগরীর এই মাত্রা উদ্বেগজনক খুবই অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। নিয়ন্ত্রণ করা না হলে ঘিঞ্জি নগরী বগুড়ার বায়ুদূষণ আরও বেড়ে ভয়ঙ্কর পরিণতিতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে পারে। বগুড়ায় অবস্থিত পরিবেশ অধিদফতরের রাজশাহী বিভাগীয় কার্যালয় এ কিউ আই কেন্দ্র স্থাপন করে প্রতিদিন বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ শুরু হয়েছে। বগুড়ার নগরীর বায়ু সূচক গ্রহণযোগ্য অবস্থায় থাকে না। গত বছর ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিভিন্ন দিনে ঝুঁকিপূর্ণ সর্বোচ্চ মাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৬ দিন। এর আগের দুই মাসে দুদিন, গত বছর জানুয়ারি মাসের ছয়দিন, ফেব্রুয়ারি মাসের আটদিন। এই সময়ে সর্বনিম্ন এ কিউ আই ছিল ২০৪ এবং সর্বোচ্চ ছিল ২৯০। এ কিউ আইয়ের এই মাত্রা ঝুঁকির। গত বছর মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া করোনাকালে প্রথম দিকে যানবাহন চলাচল সীমিত থাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা অনেকটা কমে এসেছিল। বছরের মধ্যভাগ থেকে নতুন স্বাভাবিক অবস্থা শুরু হওয়ায় যন্ত্রচালিত যানবাহনের সংখ্যা পূর্বের স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে চলে আসে। অনেক ক্ষেত্রে বেড়েও যায়। এই অবস্থায় বায়ুদূষণের মাত্রা ফের পূর্বের অবস্থায় ফিরে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা বাতাসে দৃশ্যমান ক্ষতিকর বস্তুকণার উপস্থিতি বিবেচনায় এ কিউ আই ছয়টি ক্যাটাগরি নির্ণয় করেছে। এ কিউ আই ৩০০’র বেশি হলে খুবই বিপজ্জনক। ৫০’র নিচে থাকলে স্বাস্থ্যকর। ৫০ থেকে ১০০’র মধ্যে থাকলে গ্রহণযোগ্য তবে সাবধানতা অবলম্বন দরকার। এ কিউ আই ১০১ থেকে ১৫০’র মধ্যে থাকলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১ থেকে ২০০’র মধ্যে থাকলে সকলের জন্য অস্বাস্থ্যকর। ২০১ থেকে ৩০০’র মধ্যে থাকলে শিশু বয়স্ক এবং অসুস্থ রোগীর জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। এ কিউ আই ৩০০’র বেশি হলে যে কোন মুহূর্তে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। দেশে করোনা পরিস্থিতিতে এ কিউ আই সূচকের মান বিবেচনায় আনলে দেখা যাবে দূষিত বায়ু কোভিড-১৯ আক্রান্তের হারে অন্যতম একটি কারণ হতে পারে। বিশে^র অনেক স্থানে করোনা নিয়ন্ত্রণে বায়ুদূষণকে সহনীয় মাত্রায় আনা হচ্ছে। এছাড়াও উন্নত দেশগুলোতে অনেক আগে থেকেই বায়ুদূষণ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের প্রত্যেক শহর ও নগরীতে সপ্তাহে একদিন পাবলিক গাড়ি (কার) বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়ে বেতার ও টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে বায়ুদূষণ শিশুর স্নায়ুতন্ত্র ও মেধার বিকাশে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। বগুড়ায় যারা বাস করছেন তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে আছে। বগুড়ায় এ কিউ আই ২০০ থেকে ৩০০’র কাছাকাছি থাকায় শিশু থেকে বয়স্ক এবং অসুস্থ রোগী আছে স্বাস্থ্য ঝুুঁকির মধ্যে। অনেক শিশুর মেমোরি লস হচ্ছে বায়ুদূষণের কারণে। বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ রেজাউল আলম জুয়েল বলেন, হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হচ্ছে তার একটি অংশ বায়ুদূষণজনিত রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত। জেলার ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডাঃ সামির হোসেন মিশু জানান, নগরীর তুলনায় গ্রাম পর্যায়ে বায়ুদূষণজনিত রোগীর সংখ্যা কম। জেনারেল হাসপাতাল (মোহাম্মদ আলী হাসপাতাল), উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে বায়ুদূষণজনিত যেসব রোগী আউটডোরে চিকিৎসা নিতে আসে তাদের সাবধানতায় থাকতে বলা হয়। প্রয়োজনে ওষুধ দেয়া হয়। বগুড়ায় বায়ুদূষণের অন্যতম কারণগুলো হলো পৌর এলাকার মধ্যে কয়েকটি ইটভাঁটি। অনেক আবাসিক এলাকায় ভাংড়ি গলানোর ফাউন্ড্রি শিল্প বসেছে। হাল্কা শিল্প লেদ মেশিন বসেছে কয়েকটি এলাকায়। ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিচ্ছে। নগরীতে ছোট যানবাহন চলাচলের সংখ্যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। বর্জ্য ব্যবস্থা এতটাই ভেঙ্গে পড়েছে যে প্রধান সড়কের ধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে ড্রেনের তরল বর্জ্য পড়ে থাকে দিনের পর দিন। নাজুক ড্রেনেজ ব্যবস্থায় সামান্য বৃষ্টিতে প্রধান সড়কে পানি জমে যায়। নিচু এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। রোদ ওঠার পর বাতাসে সকল বস্তুকণা যুক্ত হয়ে বেড়ে যায় দূষণ। নগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া নদী বর্জ্য ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ভবন নির্মাণের সময় রাস্তার ধারে ইটভাঙ্গা মেশিনে খোয়া তৈরি হয়। ইটের ও বালির ট্রাক শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল করে। সকল ক্ষুদ্র বস্তুকণা উড়ে নগরীর বায়ুকে দূষণ করে। এ ছাড়াও বগুড়া উত্তরবঙ্গের মধ্য নগরী হওয়ায় প্রতিদিন ১১ জেলার ভারি যানবাহন চলাচলে ধুলা উড়িয়ে বায়ুদূষণ করছে। পরিবেশ অধিদফতরের রসায়নবিদ জানান, বাতাসে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পার্টিক্যাল পলুশন) ১০ মাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিটারে ৫০ গ্রাম যা বগুড়ার বায়ুকে যারপর নেই দূষিত করছে।
×