শংকর কুমার দে ॥ বোমা ফাটানোর মতো ভয়ঙ্কর খবর ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীজুড়ে সাইবার অপরাধ জগতে। কম্পিউটার কারসাজি করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে অন্তত এক লাখ নারীর নগ্ন ছবি। গোয়েন্দা বিষয়ক কোম্পানি সেনসিটি রিপোর্ট করেছে যে, ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৪ হাজার ৮৫২ নারীকে টার্গেট করা হয়েছে। অনলাইনে অন্তত এক লাখ নারীর নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়ার খবরটি দাবানলের মতোই ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো ঢাকার সাইবার অপরাধ জগতেও। বিষয়টির ওপর নজরদারি শুরু করেছে বলে সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের দাবি।
গোয়েন্দা বিষয়ক কোম্পানি সেনসিটি রিপোর্ট করেছে, গত বছর বন্ধ করে দেয়া একটি এ্যাপের ক্র্যাকড ভার্সনের এডমিন ইংরেজী অক্ষর পি দিয়ে নগ্ন ছবিগুলো প্রকাশ করে বলেছে, এটা বিনোদন। এতে কোন সহিংসতা নেই। কেউ কাউকে ব্ল্যাকমেলও করবে না। গুনগতমানের দিক দিয়ে এসব ছবির বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই বলে নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়া এডমিনের দাবি। এই সংখ্যক নারীকে নগ্ন করে তাদের ছবি প্রকাশ্যে ছেড়ে দেয়ার মতো ঘটনার বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তাধীন।
পুলিশের সাইবার তদন্ত সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, কম্পিউটারে কারসাজি করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়া কমপক্ষে এক লাখ নারীর নগ্ন ছবির বিষয়টি রীতিমতো হৈচৈ ফেলে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, যেটা বাংলাদেশের মানুষজন, এটা দেখে যে কারো চোখ আকাশে ওঠার কথা। কিন্তু এসব ছবি ভুয়া। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ছবিকে ব্যবহার করে কম্পিউটার কারসারির মাধ্যমে নগ্ন করে ফেলা হয়েছে ওসব নারীকে। এরপর সেই ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টেলিগ্রামে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে নারীদের পোশাক খুলে নেয়া হয়েছে। যাদেরকে এভাবে টার্গেট করা হয়েছে, তার মধ্যে কিছু আছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক। সংবাদ মাধ্যম ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং-বিবিসি‘র প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরেছে বলে ঢাকার সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
গোয়েন্দা বিষয়ক কোম্পানি সেনসিটি কম্পিউটারে নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়ার এসব তথ্য ধরে ফেলেছে বলে দাবি করেছে। সেনসিটির খবরে বলা হয়েছে, কিন্তু নারীর পোশাক খুলে এভাবে নগ্ন করছে যারা, তারা একে নিতান্তই একটি বিনোদন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। যে সফটওয়্যার ব্যবহার করে এসব করা হয়েছে তা যাচাই করেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি। কিন্তু দুর্বল ফল এসেছে তাতে। সেনসিটি দাবি করেছে এক্ষেত্রে ‘ডিপফেক বট’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ডিপফেকস হলো কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট। কখনও কখনও তা বাস্তবতাভিত্তিক ছবি ও ভিডিও তৈরি করে বাস্তব টেমপেটের ওপর ভিত্তি করে। এর অন্যতম একটি ব্যবহাররীতি হলো সেলিব্রেটিদের ভিডিও ক্লিপ দিয়ে ভুয়া পর্নোগ্রাফিক ভিডিও তৈরি করা।
গোয়েন্দা বিষয়ক কোম্পানি সেনসিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জর্জিও পাত্রিনি বলেছেন, এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ছবি ব্যবহার করে তাকে নগ্ন করে ফেলার বিষয়টি তুলনামূলকভাবে নতুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্মুক্ত রাখা হয় এমন যে কারও ছবিই এই চক্রের টার্গেটে পড়তে পারেন। কৃত্রিম এই বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত ‘বট’টি থাকে টেলিগ্রাম চ্যানেলের ভেতরে। তাকে ব্যবহারকারী একজন নারীর ছবি পাঠিয়ে দিলেই কয়েক মিনিটের মধ্যে তার একটি নগ্ন ডিজিটাল ছবি বেরিয়ে আসে। এর জন্য বাড়তি খরচ করতে হয় না।
বেশ কিছু ছবি নিয়ে যাচাই করেছে সংবাদ মাধ্যম বিবিসি। ব্যবহার করেছে সব রকম অপশন। কিন্তু কোনটিই পরিপূর্ণ বাস্তবসম্মত দেখায় না। এ ধরনের একটি এ্যাপ গত বছর বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে করা হচ্ছে, ওই এ্যাপের একটি ‘ক্র্যাকড ভার্সন’ রয়ে গেছে। এই সার্ভিসের প্রশাসক বা এডমিন নিজেকে শুধু ইংরেজী অক্ষর ‘পি’ দিয়ে প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ওই এডমিন বলেছে, আমি তেমন কিছু কেয়ার করি না। এটা হলো একটা বিনোদন, যেখানে কেন সহিংসতা নেই। এতে কেউ কাউকে ব্ল্যাকমেল করবে না। কারণ, যেসব ছবি তৈরি করা হচ্ছে গুণগতমানের দিক দিয়ে তা অবাস্তব।
গোয়েন্দা বিষয়ক কোম্পানি সেনসিটির রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর থেকে এসব নারীকে নগ্ন করে তাদের ছবি প্রকাশ্যে ছেড়ে দেয়া শুরু করা হয়েছে এবং এ বছরও তা অব্যাহত আছে। ছদ্মনামের বা ভুয়া এডমিন থেকে নারীর এই ধরনের নগ্ন ছবি কম্পিউটারে ছড়িয়ে দেয়া বন্ধ করা না গেলে তা ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারে। তবে এসব বন্ধ করাটা খুবই জটিল ও কঠিন। একটা এ্যাপ বন্ধ করে দেয়া হলে আবার নতুন করে ছদ্মনামে বা ভুয়া এ্যাপ তৈরি করে তা করা হচ্ছে, এটা খুবই বিপজ্জনক।
পুলিশের সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, পৃথিবীজুড়েই তথ্য-প্রযুক্তির সহজলভ্যতার কারণে দেশে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোনের ব্যবহার যত বাড়ছে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্য মাধ্যমগুলোয় এই অপরাধের প্রবণতা বেশি। সাইবার অপরাধ এবং প্রযুক্তির নিরাপদ ব্যবহার নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম এ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন দেশের সাইবার অপরাধ নিয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গবেষনা থেকে জানা যায়, শতকরা প্রায় ৫২ ভাগ অভিযোগই আসে নারীদের থেকে? সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। কম্পিউটারে সুপার ইম্পোজ ছবি এবং পর্নোগ্রাফির মতো ভয়াবহ অভিযোগ এখন শুধু দেশেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। কম্পিউটার কারসাজি করে অনলাইনে অন্তত এক লাখ নারীর ভুয়া নগ্ন ছবি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে খবরটি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার পর ঢাকার সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগও নজরদারি শুরু করেছে বলে জানা গেছে।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: