ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পলিই বড় সমস্যা

ফেরিঘাটে সঙ্কটে দুর্ভোগ চরমে

প্রকাশিত: ২২:০০, ১৯ অক্টোবর ২০২০

ফেরিঘাটে সঙ্কটে দুর্ভোগ চরমে

রাজন ভট্টাচার্য ॥ কখনও নাব্য সঙ্কট। মাঝে মাঝে তীব্র পানির স্রোত। কখনও ফেরি নষ্ট থাকে। প্রবল স্রোতের কারণে ঘাট ভেঙ্গে যাওয়ায় ফেরি চলাচল ব্যাহত হয়। দু’পাড়ে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজটের। ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় আটকে থাকতে হয় যানবাহনসহ যাত্রীদের। গুরুত্বপূর্ণ রোগী পারাপারেও বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেই। প্রায় পাঁচমাস ধরেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সবকটি ফেরিঘাটে চলছে এ ধরনের অচলাবস্থা। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতের উজান থেকে প্রতিবছর ১২০ কোটি টন পলি এসে পড়ছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীগুলোতে। এরমধ্যে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ ভাগ পলি ড্রেজিং করা হয়। এজন্য দ্রুত সময়ে নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নাব্য সঙ্কটের। যা দিন দিন আরও প্রবল হচ্ছে। তাছাড়া গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলো মধ্যাঞ্চলমুখি হওয়ার কারণে পলি সাগরে যাওয়ারও সুযোগ নেই। নদী ভাঙ্গনের কারণে মাটিতে নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। সাধারণত ভাঙ্গন প্রবণ নদীগুলোতে স্রোত বেশি। দ্রুত পলি ছড়িয়ে যায়। আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নদীগুলোতে পানি বেশি হয়। তখন স্রোত অস্বাভাবিক হওয়ায় দ্রুত পলি এসে জমা হয়। অথচ নদী ভাঙ্গন রোধ করা যাচ্ছে না। দেশের নয়টি ফেরিঘাটে এখন ৫০টি ফেরি চলাচল করছে। এরমধ্যে বেশিরভাগই পুরনো। কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে এসব ফেরি সচল রেখে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। মেরামত করার দিনই ফের ফেরি নষ্ট হওয়ার নজির অহরহ। এক্ষেত্রে ফেরিঘাট সচল রাখতে দ্রুত আধুনিক ও শক্তিশালী ফেরি কেনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। নদীর নাব্য রক্ষায় নিয়মিত ড্রেজিং করার পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ঘাটগুলোতে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়ারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। নদী ভাঙ্গন ঠেকাতে নিতে হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবার দেশে দীর্ঘ মেয়াদী বন্যা হয়েছে। ফলে ঘাটগুলোতে দুর্ভোগ বেড়েছে বেশি। এখন প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তুলনামূলকভাবে এ বছর বর্ষা এসেছে একটু আগে ভাগেই। শেষ হচ্ছে দেরিতে। অর্থাৎ শীত মৌসুম উকি দিলেও বৃষ্টিপাত থামছে না। জানতে চাইলে নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে মাওয়া ঘাটে সমস্যা আরও বেড়েছে। কারণ সেতুর ক্ষতির আশঙ্কায় পিলারের চারপাশে জমে থাকা বালু ড্রেজিং করতে দেয়া হচ্ছে না। ব্যবহার করা যাচ্ছে না পাশের চ্যানেলটিও। ফলে এই ঘাটের ফেরিগুলোকে ঘুরে যেতে হচ্ছে। নাব্য সঙ্কট দেখা দিচ্ছে বারবার। তিনি বলেন, রো রো ফেরিতে সবচেয়ে বেশি যান পারাপার করা যায়। নাব্য সঙ্কটের কারণে এখন টানা ফেরি (ছোট ফেরি) চলাচল করছে। তাই ঘাটে যানবাহন পারাপার স্বাভাবিক না হওয়ায় যানজটের ভোগান্তি বাড়ছে। তিনি বলেন, সকল ফেরিঘাট সচল রাখার জন্য সবার আগে নিয়মিত ড্রেজিং নিশ্চিত করার পাশাপাশি পলি অপসারণ করতে হবে। সূত্রে জানা গেছে, দেশে এখন নয়টি ফেরিঘাট রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চারটি ঘাটের মধ্যে রয়েছে, পাটুরিয়া (দৌলতদিয়া), পাটুরিয়া (কাজিরহাট), মাওয়া (শিমুলিয়া-চরজানাযাত), চাঁদপুর (শরীয়তপুর), ভোলা (লক্ষীপুর)। পাটুরিয়া মাওয়া ঘাট হয়ে ঢাকা থেকে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার মানুষ সড়কপথে চলাচল করেন। পাটুরিয়ায় তীব্র স্রোতের কারণে প্রায়ই ব্যাহত হয় ফেরি পারাপার। মাওয়ায় উল্টো সমস্যা, সেখানে নাব্য সঙ্কটের কারণে আটকে যায় ফেরি। বিগত পাঁচমাসের প্রায় প্রতিদিনই গুরুত্বপূর্ণ সবকটি ফেরিঘাটে সমস্যার কথা শোনা গেছে। কখনও বেশি। কখনও কম। বেশি স্রোতের কারণে টানা সপ্তাহব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ঘাটে দুর্ভোগের চিত্রও লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী মানিকগঞ্জে পাটুরিয়া ঘাট পার হতে দুই ধাপে প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাকের অন্তত ৩০ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। দেখা যায়, শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে স্বল্প পরিসরে ফেরি চলাচল করায় পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌ রুটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোট গাড়ি ও পরিবহন বাস পারাপার করা হলেও আটকা পড়েছে কয়েকশ’ সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক। পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় যানবাহনের চাপ কমাতে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে ৭ কিলোমিটার আগেই আটকে দিচ্ছে শিবালয় থানা পুলিশ। এ সকল ট্রাকগুলোকে উথুলী সংযোগ পার হতে ১৩ থেকে ১৫ ঘণ্টা সময় লাগছে। সিরিয়াল অনুযায়ী ঘাট এলাকায় প্রবেশের পর ওজন স্কেল, টিকেট কাউন্টার থেকে টিকেট সংগ্রহ ও ফেরি পেতে সময় লাগছে আরও ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা। এতে করে পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুট পার হতে আসা ট্রাক শ্রমিকদের ভোগান্তি বেড়েছে। মংলাগামী সিলিন্ডার গ্যাস বহনকারী অনির নামের এক ট্রাকচালক বলেন, ঢাকা থেকে গতকাল (শনিবার) রাত ১০টার দিকে উথুলী সংযোগ সড়কে সিরিয়ালে আছি। এখন সকাল সাড়ে ১০টা বেজে গেলেও সংযোগ সড়ক পার হতে পারি নাই। সংযোগ সড়ক পার হয়ে ঘাট এলাকায় ফেরি কখন পাবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বেনাপোলগামী ট্রাকচালক তরিকুল জানান, শনিবার সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত উথুলী সংযোগ সড়কেই আছি। কখন ঘাটে যাব, ওজন স্কেল করাব আর কখন টিকেট নেব। এ ঘাট এলাকাতেই কেটে যাচ্ছে প্রায় দুই দিন। শিবালয় থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ কবির জানান, পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় যানবাহনের বাড়তি চাপ এড়াতে উথুলী সংযোগ সড়কে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাকগুলো সিরিয়ালে রাখা হয়েছে। ঘাট এলাকা থেকে যানবাহনের চাপ কমলে সিরিয়াল অনুযায়ী ট্রাকগুলো ছাড়া হবে। উথুলী সংযোগ সড়ক থেকে আরিচা ঘাট এলাকা পর্যন্ত দু’শ ট্রাক রয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশন (বিআইডব্লিটিসি) আরিচা কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মোঃ সালাম হোসেন জানান, শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি নৌরুটে স্বল্প পরিসরে ফেরি চলাচল করায় এ রুটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। ছোট গাড়ি ও পরিবহন বাসের চাপ কম থাকলেও ঘাট টার্মিনালে তিন শ’ সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে। পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে ১৭টি ফেরি দিয়ে যানবাহন ও সাধারণ যাত্রী পারাপার করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। সম্প্রতি টানা দ্বিতীয় দিনের মতো শুক্রবারও মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ও মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি নৌপথে ফেরি চলাচল বন্ধ ছিল। পদ্মার লৌহজং ও শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে উজান থেকে নেমে আসা পলিতে চ্যানেলে নাব্য-সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করায় এই নৌপথে ছোট-বড় সব ফেরি এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। বিআইডব্লিউটিএ বলছে, ১৩টি ড্রেজার দিয়ে পলি অপসারণের কাজ চলছে, তবে নাব্য-সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
×