ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলোচনা, বৈঠক আর নীতিমালায় আটকা করোনার র‌্যাপিড টেস্ট

প্রকাশিত: ২২:৪৩, ২৬ আগস্ট ২০২০

আলোচনা, বৈঠক আর নীতিমালায় আটকা করোনার র‌্যাপিড টেস্ট

রশিদ মামুন ॥ দ্রুত করোনা শনাক্তে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করলেও অজানা কারণে বাংলাদেশ সেই পথে হাঁটছে না। দ্রুত পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন দেশ দ্রুত বেশি সংখ্যক পরীক্ষা করে সুস্থ এবং আক্রান্ত মানুষকে আলাদা করে ফেলেছে। এরপর আক্রান্তদের সুস্থ করার পাশাপাশি সুস্থ মানুষকে নতুন করে সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করে করোনা নির্মূল করেছে। বাংলাদেশে আলোচনা, বৈঠক আর নীতিমালা প্রণয়নের মধ্যেই আটকে রয়েছে র‌্যাপিড টেস্টিং। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সোমবার স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন, র‌্যাপিড টেস্টের দিকে এখনই সরকার যাচ্ছে না। কে যাচ্ছে না এর কোন ব্যাখ্যা অবশ্য তিনি দেননি। সরকার গঠিত পরামর্শক কমিটির সদস্য ডাঃ ইকবাল আর্সলান বলেন, আমরা বলেছিলাম করোনা শনাক্তে এন্টিজেন কিট ব্যবহার করার জন্য। এটির একেবারে তৃণমূলে করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। অতিদ্রুত এখানে করোনা শনাক্ত করা যায়। এখানে যেসব রোগীর নেগেটিভ আসবে অথচ সন্দেহজনক তাদের আমরা আরটিপিসিআর ল্যাবে পরীক্ষা করাতে বলছি। অন্যদিকে রোগ শনাক্ত এবং রোগীর চিকিৎসার বদলে নিকট অতীতে দেশে কি পরিমাণ মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়েছেন সে বিষয়ে একটি ধারণা পাওয়ার জন্য এ্যান্টিবডি পরীক্ষার কথা বলেছিলাম আমরা। এখন উনারা কেন অনুমোদন দিচ্ছে না কার কথায় বা পরামর্শে সেটা এলে উনারাই বলতে পারবেন। দ্রুত শনাক্ত অথবা করোনা হয়ে যাওয়ার পর কোন ব্যক্তির শরীরে এ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না তা দেখার জন্য এ্যান্টিবডি, এন্টিজেন এবং আরটি ল্যাম্প কিট রয়েছে। দেশে এর একটিও ব্যবহার করা হয় না। কেউ কেউ এ ধরনের কিটের অনুমোদন চাইতে গেলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর মার্কিন খাদ্য এবং ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ (এফডিএ) এর অনুমোদন নিয়ে আসতে বলছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে এখনও তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনাই করছেন। জানা গেছে, নীতিমালা প্রণয়নে ঠেকে রয়েছে কোভিড-১৯ এ এ্যান্টিবডি কিটের ব্যবহার। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোভিড-১৯ শনাক্তে সহজ এবং অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়ের পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে বহু আলোচনার পর একটি নীতিমালা প্রণয়ন হলেও কিট ব্যবহারের কোন অনুমোদন দেয়া হয়নি। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ছাড়াও অনেক উন্নত দেশ করোনা প্রতিরোধী কার্যক্রমে সহজ পরীক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সেখানে বাংলাদেশ এককভাবে জটিল আরটিপিসিআর পদ্ধতির বাইরে আর কোন পদ্ধতিতে যেতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। করোনা ডট গভ ডট বিডি সোমবার যে কোভিড-১৯ এর তথ্য দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে শেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৩ হাজার ৩৮২টি পরীক্ষা হয়েছে। এরমধ্যে শনাক্ত হয়েছেন দুই হাজার ৪৮৫ জন। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টেস্টে শনাক্তের হার ১৮ দশমিক ৫৬ ভাগ। অন্যদিকে করোনা শনাক্তের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার ৩৮ জনের পরীক্ষা হয়েছে। এই পরীক্ষায় দুই লাখ ৯৭ হাজার ৮৩ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। অর্থাৎ মোট পরীক্ষায় ২০ দশমিক ৪০ ভাগ মানুষের শরীরে করোনা সংক্রমণ পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা শনাক্তে বেশি বেশি পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থাও সব মানুষকে পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে। কিন্তু আমাদের এখানে সংক্রমণের মাত্রা অনুযায়ী পরীক্ষা না হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মুখপত্র উপপরিচালক আইয়ূব হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা কিট অনুমোদন দেয়ার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছি। কিন্তু কিটগুলো ব্যবহার করবে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তাদের আবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। সঙ্গত কারণে মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতর যখন কিট ব্যবহারের জন্য সম্মিলিত নিয়ে আমাদের জানাবে আমরা এর অনুমোদন দেব। করোনা শনাক্তে এ্যান্টিবডি পরীক্ষাকে এখনও খুব গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বলছে না বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা। কোন ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ্যান্টিবডি কিটে এর ফলাফল পাওয়া যায় না। করোনা সংক্রমণের সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা অর্থাৎ এ্যান্টিবডি তৈরি হয়। এই সময়ে পরীক্ষা করে যদি দেখা যায় কারও শরীরে এ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে ধরে নিতে হবে তিনি করোনা আক্রান্ত। তবে করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা থেরাপি দিতে এ্যান্টিবডি পরীক্ষা হওয়া জরুরী। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষ ভাইরাস আক্রান্ত হলেও তার শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হলে কোন উপস্বর্গ দেখা নাও দিতে পারে। কিন্তু পরীক্ষায় তার শরীরে এ্যান্টিবডির অস্তিত্ব পাওয়া যেতে পারে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের হেমাটোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও প্লাজমা থেরাপির জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান ডাঃ এম এ খান বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী কোভিড-১৯ আক্রান্ত অনেকের শরীরে পর্যাপ্ত এ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না। সে ধরনের দাতার প্লাজমা নিয়ে কোন লাভ হবে না। তাই এই প্লাজমা নেয়ার আগে জানতে হবে দাতার প্লাজমায় প্রয়োজনীয় এ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা। এজন্য এ্যান্টিবডি টেস্ট জরুরী। এ্যান্টিবডি কিটের বিষয়ে নানা আলোচনা শুরু হলে জুনের একেবারে শেষ দিকে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর একটি কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি জুনেই একটি নীতিমালা চূড়ান্ত করে। এই নীতিমালা অনুযায়ী এ্যান্টিবডি টেস্টের অনুমোদন পাওয়ার জন্য অন্তত ২০ প্রতিষ্ঠান তাদের কিটের নমুনা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে জানিয়ে দেয়। তবে এখনও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলে রয়েছে। ওই নীতিমালায় বলা হয়, অপব্যবহার রোধে শুধু ল্যাবরেটরিতে এই কিট ব্যবহারের অনুমতি দেয়া যাবে। কিটের মোড়কে লেখা থাকতে হবে ‘দিস ইজ নট এ ডায়াগনস্টিক কিট, দিস কিট উইল বি ইউজড অনলি ফর ডিটেক্টিং এ্যান্টিবডি, নট ইন একিউট স্টেজ।’ এসব কিট ‘পয়েন্ট অব কেয়ারে’ ব্যবহার করা যাবে না। জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার এন্টিজেন কিটের অনুমোদনের বিষয়ে আলোচনা করছে। তবে আগেই এ্যান্টিবডি কিটের নীতিমালা হয়েছে বলে জানান। তবে আরটি ল্যাম্প কিটের বিষয়ে তিনি কিছু জানাতে পারেনি। এন্টিজেন কিটের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণের শুরুর দিনই শনাক্ত করা সম্ভব। ভারত অনেক আগে থেকেই এন্টিজেন কিট ব্যবহার করছে। নাকের থেকে রসের নিয়ে নমুনা নিয়ে এখানে এন্টিজেন পরীক্ষা করা হয় যে এন্টিজেন সার্স কোভ ২ ভাইরাসে মেলে। এ পরীক্ষা সাধারণ ল্যাবরেটরিতে হয় না এবং এর রেজাল্ট তাড়াতাড়ি মেলে। রেজাল্টে দেখা গেছে এই কিটের ৯৯ দশমিক তিন শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ ক্ষেত্রে সঠিক নেগেটিভ ফল দিচ্ছে। পজিটিভের ক্ষেত্রে এর সাফল্য ৫০ দশমিক ছয় থেকে ৮৪ শতাংশ, যা ভাইরাল লোডের উপর নির্ভরশীল। তবে এই কিটের সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। একবার নমুনা ওই কিটে সংগ্রহ করার পর তা এক ঘণ্টা কার্যকর থাকে। ফলে যেখানে নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে সেখানেই পরীক্ষা করে ফেলতে হবে। কোন নমুনায় এন্টিজেনের মাত্রা যদি টেস্টের সংবেদনশীলতার কম হয় বা নমুনার মান খারাপ হয় তাহলে নেগেটিভ টেস্ট রেজাল্ট আসতে পারে। অন্যদিকে করোনার পরীক্ষায় আরও একটি পদ্ধতি হিসেবে আরটি ল্যাম্প পদ্ধতিকেও বিভিন্ন দেশে গুরুত্ব দিচ্ছে। এই পদ্ধতিতেও দ্রুত করোনা শনাক্ত করা সম্ভব। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি এ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জেবা ইসলাম সিরাজ এই পদ্ধতিতে গবেষণাগারে ভাল ফলাফল পেয়েছেন বলে দাবি করেন। একই সঙ্গে তিনি এই কিটের অনুমোদনের জন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরে যোগাযোগ করেন। তবে সেখান থেকে তাকে জানানো হয় মার্কিন এফডিএ’এর অনুমোদন নিয়ে আসতে তাহলে দ্রুত তারা অনুমোদন দেবে। এফডিএ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ^বিদ্যালয়ে পরীক্ষার জন্য এটি অনুমোদন দিয়েছে বলে জানান তিনি। অধ্যাপক ড. জেবা ইসলাম সিরাজ বলেন, অন্য দেশ দ্রুত পরীক্ষা করছে। আমাদেরও দ্রুত পরীক্ষা করা যায় এমন ব্যবস্থা করা উচিত।
×