ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জাল টাকা তৈরিতেও নিপুণ কারিগর প্রতারক সাহেদ

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ১৬ জুলাই ২০২০

জাল টাকা তৈরিতেও নিপুণ কারিগর প্রতারক সাহেদ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট প্রদান, অর্থ আত্মসাতসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপ ও রিজেন্ট হাসপাতাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম ওরফে মোঃ সাহেদকে গ্রেফতারের পর নানা ধরনের তথ্য উদ্ঘাটিত হচ্ছে। সর্বশেষ বুধবার তার বাসায় পাওয়া গেছে জাল টাকা। র‌্যাব এখন তাকে জাল টাকা তৈরিরও নিপুণ কারিগর হিসেবে সন্দেহে রেখে তদন্তে নেমেছে। যদিও গত ৬ জুলাই থেকে প্রকাশ্যে আসে সাহেদের পৃষ্ঠপোষকতায় রিজেন্ট হাসপাতালসহ তার কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চলে একের পর এক অনিয়ম। প্রতারণা করতে এমন কোন শাখা বা সেক্টর বাকি রাখেননি সাহেদ। তার বিচরণ ছিল প্রতারণার প্রতিটি স্তরেই। এরই মধ্যে র‌্যাবের কর্মকর্তাদের সংগ্রহ করেছেন সাহেদের প্রতারণার বিস্তার তথ্য। যা তদন্ত করছে একাধিক টিম। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা দৈনিক জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, সাহেদ মহাপ্রতারক। সব সেক্টরেই তার প্রতারণা রয়েছে। এছাড়াও সাহেদ ঠগবাজি ও মিথ্যাচারেও অন্যতম। দেশে মহামারী করোনাকালে যিনি চিকিৎসাসেবা নিয়ে প্রতারণা করতে পারেন সে নিজের স্বার্থের জন্য সব করতে পারেন। তার এমন প্রতারণার কারণে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিললাহ বলেন, সাহেদ একজন উঁচুমানের প্রতারক। তিনি বিভিন পন্থা অবলম্বন করে ছদ্মবেশ ধারণ করে আত্মগোপনের চেষ্টা করছিলেন। তার বাড়ি সাতক্ষীরা হলেও তিনি বাড়ি না গিয়ে বিভিন্ন গাড়ি পরিবর্তন করে আশপাশে ঘুরছিলেন। অবৈধভাবে পার্শ্ববর্তী দেশেও তিনি অনুপ্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। সাহেদকে গ্রেফতারের জন্য আগে থেকেই সীমান্ত এলাকাগুলোতে র‌্যাবের নজরদারি ছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, রিজেন্ট গ্রুপের মালিক সাহেদ করিম ওরফে সাহেদের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা শহরের পলাশপোল এলাকায়। তবে বাপ দাদার বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বশিরহাটে। সাহেদ ১৯৯৮ সালে সাতক্ষীরা সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে তার দাদার বাসায় থাকতেন তিনি। পিলখানায় রাইফেলস স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। এরপর আর লেখাপড়া করেননি সাহেদ। সাহেদের বাবার নাম সিরাজুল করিম। মা সাফিয়া করিম ছিলেন সাতক্ষীরা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সাহেদের ঠগবাজি, প্রতারণা, মিথ্যাচার এবং নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ ছিলেন পরিবারসহ এলাকার লোকজন। ধীরে ধীরে চাপাবাজি আর প্রতারণা লিপ্ত তিনি। নানা প্রতারণার মাধ্যমে কয়েক বছরেই কোটি টাকার মালিক হন সাহেদ। ২০১০ সালে হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে সাহেদ করিমের মা মারা যান। সাহেদের যত প্রতারণা ॥ বিএনপির নেতা পরিচয়ে ২০০৭ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের অনুমোদন নেন সাহেদ করিম। তবে তিনি ওই সময় হাসপাতাল করেননি। চালাতেন ক্লিনিক। সরকার পরিবর্তনের পর তিনি আবার ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দেয়া শুরু করেন। গত পাঁচ বছর ধরে সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ (রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র) নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালাতেন সাহেদ। নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। এমএলএম ব্যবসা প্রতারণা-২০০৯ সালের জুলাই মাসে প্রতারণার মামলায় সাহেদ গ্রেফতার হয়েছিল। তখন কয়েকমাস জেলে খেটেছেন তিনি। তবে প্রতারণা থামেনি, বরং মাত্রা বেড়ে যায় তার। ২০১০ সালের দিকে সাহেদ ধানম-ি এলাকায় বিডিএসকিকওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলেন। ২০১১ সালে শতশত গ্রাহকদের কাছ থেকে ৫শ’ কোটি টাকা আত্মসাত করেন। প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে গা ঢাকা দেন। ওই সময় এমএলএম কোম্পানির সব গ্রাহক তাকে মেজর ইফতেখার করিম নামে জানতেন। এরপর ‘বিডিএস কুরিয়ার সার্ভিসে’ চাকরির নামে অনেক আবেদনকারীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয় এই প্রতারক সাহেদ করিম। ২০১১ সালে তাকে প্রতারণা মামলায় আবারও গ্রেফতার হয়েছিল। টাকার বিনিময়ে দ্রুত জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর এমএলএম প্রতারণায় আত্মসাত করা টাকা দিয়ে রিজেন্ট গ্রুপের নামে ব্যবসা শুরু করেন। ক্যাসিনো কারবার ॥ প্রতারণার পাশাপাশি ক্যাসিনো কারবারেও জড়িত ছিল সাহেদ। ক্যাসিনো কিংস খালেদ ও জিকে শামীমের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। মাঝে মধ্যে উত্তরা, গুলশান ও মতিঝিলে গিয়ে ক্যাসিনো খেলতেন। বাটপারিতে সাহেদ পটু ॥ নিজে বিএনপির নেতা পরিচয়ে দিলেও সরকার পরিবর্তন হলে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় ব্যবহার করতেন তিনি। এছাড়াও তিনি নিজেকে কখনও অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও গোয়েন্দা সংস্থার আবার কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। ‘নতুনকাগজ’ নামে একটি আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা খুলে নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টক শো’তে অংশ নিতেন সাহেদ। এরপর থেকে নিজেকে বড় সাংবাদিক বলে পরিচয়ও দিতেন অনেকের কাছে। কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তুলতেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর করে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এরপর তার হাসপাতাল, অফিস, ও বাসার দেওয়ালে সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙ্গিয়ে রাখতেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে তোলা ছবিকে পুঁজি করেই রিজেন্ট গ্রুপের মালিক সাহেদ অপকর্ম করে বেড়াতেন। রোগী থেকেও টাকা নিয়েছে, সরকার থেকেই ক্ষতিপূরণ চেয়েছে ॥ করোনা বিশেষায়িত হাসপাতাল হিসেবে করোনা রোগীদের কাছ থেকে কোন ফি নেয়ার কথা চুক্তি ছিল না। তারপরও টাকা নিয়েছে। র‌্যাব অভিযানে গিয়ে দেখেছে, রিজেন্ট রোগী প্রতি দেড়লাখ, দুইলাখও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা বিল আদায় করত। পাশাপাশি ‘রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে’ এই বাবদ সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ বিল জমা দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল। অধিদফতর হয়ে সেই বিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রায় অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় ছিল। তবে এখনও কোন অর্থ ছাড় হয়নি। যত প্রতারণার মামলা ॥ সাহেদের বিরুদ্ধে রাজধানীর ধানম-ি, উত্তরাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ৬০টির মামলা রয়েছে। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড থেকে ছয় কোটি টাকা ঋণ নেয়ার নথিতে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মুহাম্মদ শহীদ বলে পরিচয় লেখা রয়েছে। এ বিষয়ে আদালতে দুটি মামলা রয়েছে, যা এখনও চলমান। ব্যাংকিং সেক্টরেও তার প্রতারণার চাল ছিল। কোটি টাকা ঋণ নিয়ে এখন পর্যন্ত একটি টাকাও পরিশোধ করেননি এই প্রতারক।
×