ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

টেন্ডারবাজিতে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন সাহেদ

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ১২ জুলাই ২০২০

টেন্ডারবাজিতে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন সাহেদ

আজাদ সুলায়মান ॥ নানা কৌশলে প্রতারণা করে মানুষকে সর্বস্বান্ত করাই ছিল রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদের পেশা। রিজেন্ট কেভিএস লিমিটেডের নাম করে বিভিণœ প্রকল্প থেকে টেন্ডার বাগিয়ে নিতেন প্রতারক সাহেদ। পরে ওই টেন্ডার চড়াদামে অন্যত্র বিক্রি করে ফায়দা লুটত। আবার মাঝে মধ্যে নিজেই টেন্ডারের কাজে সক্রিয় থাকত। ওপর মহলের নাম ভাঙ্গিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কাজ বাগিয়ে নেয়াই ছিল অন্যতম হাতিয়ার। এমনকি বিভিন্ন সেতুতে বালু ও পাথর সাপ্লাই দেয়ার কাজ পেয়েছিলেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে অন্তত ২০ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীকে রাস্তায় নাামিয়ে দিয়েছেন সাহেদ। ওইসব ব্যবসায়ীদের অন্তত ৫০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন সাহেদ। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা টাকা দাবি করলে প্রাণনাশের হুমকি দিতো। রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে এ ধরনের তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব। তাদের দেয়া তথ্যমতে- তদন্তকারীরা শনিবার উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের রান্না ঘর থেকে কম্পিউটারের হাডডিস্ক উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোতেই পাওয়া যাবে করোনার সমস্ত নকল সনদ ও অপকর্মের গুরুত্বপুর্ণ তথ্য। কয়েকজন ব্যবসায়ী দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেছেন, অত্যন্ত সম্মোহিনি কায়দায় সাহেদ মানুষকে বশীভূত করার কৌশল জানত। এমনও ব্যবসায়ী আছেন-৫ বছর ধরে টাকা পাওনা রয়েছেন। টাকা দাবি করলেই মেরে ফেলার হুমকি। তার সঙ্গে সার্বক্ষণিক থাকে দুর্ধর্ষ অপরাধী। র‌্যাব ও পুলিশের শীর্ষ কর্তাদের দোহাই দিয়ে এসব অপকর্ম চালায় সাহেদ। এসব অভিযোগে গত ৬ জুলাই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালটিতে অভিযানের সময় করোনার চিকিৎসার নামে নকল সনদ বাণিজ্য ও রোগীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে সিলগালা করা হয়। টনক নড়ার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরও হাসপাতালটির সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। র‌্যাবের তদন্তেও বেরিয়ে আসছে সাহেদের বিস্ময়কর উত্থানের কাহিনী। করোনা মহামারীর সুযোগে সাহেদ নিজেকে স্বাস্থ্যখাতের অন্যতম মাফিয়া হিসেবে গড়ে তোলার নেপথ্যে সবটাই ছিল নিপুণ প্রতারণার কৌশল। ভুক্তভোগীরা তাদের প্রতারিত হওয়ার অসংখ্য অভিযোগ র‌্যাব সদর দফতরে জানাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে ফোনের পর ফোন রিসিভ করতে হচ্ছে র‌্যাবকে। গত দশ বছর ধরেই সাহেদ নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছিলেন। তার ভয়ে কেউ কথা বলতে পারত না। সাহস করে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে র‌্যাব বা পুলিশ দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করত। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের ব্যবহার করতেন। এমনকি সচিবালয়ে তার অবাধ চলাফেরা ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে ভাগিয়ে নিতেন। পরে ওইসব টেন্ডার চড়াদামে অন্য কোন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতেন। টেন্ডারের পাশাপাশি ইট, বালি ও পাথরের সাপ্লাই দিতেন সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রের নামী-দামী লোকদের দোহাই দিয়ে টেন্ডার ভাগিয়ে নিতেন। এই প্রসঙ্গে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল সারোয়ার বিন কাসেম বলেছেন, সাহেদ কিছুতেই দেশত্যাগ করতে পারবে না। তাকে ধরতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে। সাহেদ ইন্টারন্যাশনাল বাটপার। মানুষের ঠকানো ছাড়া তার কোন কাজ ছিল না। অনেক ব্যবসায়ীর টাকা মেরে দিয়েছেন সাহেদ। বিভিন্ন মান্যগণ্য ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি তোলে ওইসব ব্যবসায়ীদের হুমকি ধমকি দিতে বলে অভিযোগ আছে। পাথর ব্যবসায়ী জুলফিকার আলী বলেন, বিভিন্ন সেতুতে বালি ও পাথর সাপ্লাই দিত সাহেদ। তার কাছে ৪০ লাখ টাকা পাওনা আমার। টাকা দাবি করলে পুলিশ ও র‌্যাব দিয়ে হুমকি দিতো। তার সঙ্গে র‌্যাব-পুলিশের ভাল সম্পর্ক ছিল। উত্তরায় রিজেন্ট অফিসে একবার গিয়েছিলাম টাকা আনতে। কিন্তু সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে সাহেদ আমাকে একটি রুমে আটকে রাখে। মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে বলে- আর যদি টাকার জন্য আসি তাহলে জীবন এখানেই শেষ করে দিবে। তিনি আরও বলেন, সে প্রায় বলতো মন্ত্রী-মিনিস্টার, আইজিপি, র‌্যাবের ডিজিসহ সবাই আমার লোক। আমার অনেক শক্তি। তোদের মতো লোক আমার কিছুই করতে পারবি না। তুই কোন টাকা পাবি না। সাহেদ তার প্রতিষ্ঠানের নামে টেন্ডার ভাগিয়ে অন্য জায়গায় বেশি দামে বিক্রি করত। একই কথা বলেছেন পাথর ব্যবসায়ী জাহিদুল আলম। তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের নাম ড্রিম রোড স্টোন। এক দালালের মাধ্যমে সাহেদের সঙ্গে পরিচয় হই বছর তিনেক আগে। তখন সে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলত। এমনভাব নিতো এই পৃথিবীতে সে ছাড়া আর ভাল মানুষ নেই। ২ বছর আগে আমাকে জানায়, আমি টেন্ডারের কাজ পেয়েছি। অনেক পাথর লাগবে। পরে তার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হই। সরল বিশ^াসে ৩২ লাখ টাকার মাল দেই। কিন্তু একটি টাকাও দেয়নি। টাকা চাইলেই প্রাণনাশের হুমকি দিতো। তার প্রতিটি কাজই ছিল প্রতারণা। আমাদের মতো অন্তত বিশ জনের ৫০ কোটি টাকা মেরে দিয়েছে প্রতারক সাহেদ। এদিকে রিজেন্টের আইটি শাখার প্রধান তারেক শিবলী রিমান্ডের প্রথম দিনেই চমকপদ তথ্য দিয়ে চলেছেন। তদন্তকারী সংস্থাদের জিজ্ঞাসাবাদে তারেক জানিয়েছে, করোনা রোগীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের বিল দিতে বাধ্য করেছে। চেয়ারম্যান সাহেদের নির্দেশেই আমরা এসব করেছি। গত তিন মাসে প্রায় তিন কোটি টাকা আয় করেছি। ভুয়া পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করেছেন মানুষের সঙ্গে। সে একটা এমএলএম কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল, যার জন্য জেলও খেটেছেন। জাল করেই করেনা সার্টিফিকেট দেয়া হতো। এটিই করে অনেক টাকা আয় হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম করতেন তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শনিবার র‌্যাব ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, রিমান্ডে থাকা আসামিদের কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। ওরা সাহেদের সমস্ত অপকর্ম সম্পর্কে অবগত। গত ৭ জুলাই র‌্যাব উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালানোর আগ মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলামত নষ্ট করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। প্রথমেই তারা কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক খুলে সেগুলো রান্না ঘরে লুকিয়ে রাখে। শনিবার ওই রান্না ঘর থেকেই উদ্ধার করা হয় অনেকগুলো হার্ডডিস্ক। এগুলো এখন কম্পিউটারে সংযোজন করে খতিয়ে দেখতে হবে কতগুলোর রোগী নকল করোনা পরীক্ষায় প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এভাবে মানুষের কাছ থেকে কত টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে সেগুলোও জানা যাবে। রিমান্ডে থাকা শিবলীর তথ্যমতে- সাহেদ সব সরকারের আমলেই এভাবে ধরাছোয়ার বাইরে ছিল। তার সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল বিএনপির আমলেও। সে সময় রাজাকার মীর কাসেম আলী ও গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের সঙ্গেও সখ্যতা ছিল। ২০১১ সালে ধানম-ির ১৫ নম্বর রোডে এমএলএম কোম্পানি বিডিএস ক্লিক ওয়ান নামে প্রতারণার ব্যবসা খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাত করে। এই রকম কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তার। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা লোন নিয়েছে। উত্তরার ৪,৭ ও ১৩ নম্বর সেক্টরে ভুয়া শিপিং ব্যবসার নাম করে অনেকের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ধরনের প্রতারণার বিষয়ে তার পরিবারও জানত। বাবাকে নিয়েও প্রতারণা ॥ বাবার করোনা নিয়ে প্রতারণার ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সাহেদের বাবা গত বৃহস্পতিবার রাতে মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যালে মারা যান। শুরুতে বাবার খোঁজ নিলেও রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর সিলগালা করে দেয়ার পর আর বাবার খোঁজ নেয়নি সাহেদ। শুধু তাই নয়, খোঁজ নেননি মারা যাওয়ার পরও। পরে অবশ্য তার ভাড়া বাসার কেয়ারটেকার ও গাড়ি চালককে পাঠিয়ে বাবার লাশ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। বাবা সিরাজুল করিমকে ভর্তি করাতে গিয়ে সাহেদের প্রতারণার কথা নিশ্চিত করেছেন মহাখালীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ আশীষ কুমার চক্রবর্তী। গণমাধ্যমকে তিনি জানান, গত ৪ জুলাই সিরাজুল করিমকে তাদের হাসপাতালে ভর্তি করেন সাহেদ। সিরাজুল করিমের বয়স ছিল প্রায় ৭০ বছর। ভর্তি করার সময় সাহেদ জানান, তার বাবার কোভিড-১৯ সংক্রমণ নেই। বাবার করোনা পরীক্ষার ভুয়া প্রতিবেদন দেয়ার কথা জানিয়ে ডাঃ আশীষ জানান, আমাদের বলা হয়েছিল, এর আগে তিনটি পরীক্ষায় সিরাজুল করিমের কোভিড-১৯ নেগেটিভ আসে। তিনটি সনদও দেখানো হয়। কিন্তু তার লক্ষণ দেখেই মনে হয়েছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত। আমাদের এখানে পরীক্ষায় তার কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে। হাসপাতালটির চিকিৎসক আজিজুর রহমান জানান, সাহেদের বাবার করোনা পজেটিভ আসলে তাকে আমরা ফোন দেই। আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেহেতু আপনার হাসপাতাল কোভিড রোগীদের জন্য সেখানে আপনার বাবাকে নিয়ে যান। কিন্তু সাহেদ অপারগতা প্রকাশ করেন। বলেন তার ওখানে চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। তার ফুসফুসে সংক্রমণ ছিল। অবস্থা খারাপ হলে দুদিন আগে তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হয়। এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার মারা যান তিনি। ভর্তির পর প্রথম দুই দিন সাহেদ তার বাবাকে দেখতে এসেছিলেন। তবে ৬ জুলাইয়ের পর থেকে এখানে তাদের আর কেউ আসেননি। সমাজসেবক ভাবত স্বাস্থ্য অধিদফতর ॥ এত দাপট থাকা সত্ত্বেও সাহেদকে চিনতেন না স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সামনাসামনি দেখাও হয়নি কখনও। তবে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির শুরুর দিকে স্বাস্থ্য অধিফতরের সম্মেলন কক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক সভায় বেসরকারী হাসপাতালের প্রতিনিধি হিসেবে সাহেদকে প্রথম চোখে পড়ে তাদের। এর আগে অবশ্য তাকে বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় আলোচক হিসেবে দেখেছিলেন। ওই সময় বেসরকারী হাসপাতালগুলো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। এ সময় রীতিমতো ‘সমাজসেবক’ হিসেবে আবির্ভূত হন সাহেদ। তিনি দেশ ও জাতির স্বার্থে তার মালিকানাধীন উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল দুটিতে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানে রাজি হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কয়েকজন কর্মকর্তা সাহেদের সম্পর্কে এসব তথ্য জানান।
×