ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘরমুখো মানুষের ঢল ও পশুর হাট বাড়াতে পারে সংক্রমণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাড়ি চালাতে চান বাসমালিকরা

ঈদে সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধের চিন্তাভাবনা

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৭ জুলাই ২০২০

ঈদে সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধের চিন্তাভাবনা

রাজন ভট্টাচার্য ॥ করোনা সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দুই মাসের বেশি সময় দেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ছিল। স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে ৩১ মে থেকে সারাদেশে গণপরিবহন সীমিত পরিসরে চলাচল শুরু হয়েছে। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে নৌ-সড়ক, রেলসহ আকাশপথে দেয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। প্রতি আসনে একজন যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে বাস। মালিকদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বাড়ানো হয়েছে ৬০ ভাগ বাসের ভাড়া। করোনা সংক্রমণ রোধে আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় সারাদেশে গণপরিবহন বন্ধের চিন্তা করছে সরকার। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরাও প্রাণঘাতী ভাইরাস কোভিড প্রতিরোধে ঈদের সময় বাস বন্ধ রাখার পক্ষে। তারা বলছেন, ঈদে গণপরিবহনে ঘরমুখো মানুষের ঢল ও পশুর হাট সংক্রমণ অনেক বেশি মাত্রায় বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, এখন গণপরিবহন চালু হলেও যাত্রী কম। অর্ধেক আসন পূরণ হচ্ছে না। বিশেষ করে দূরপাল্লার পরিবহনের ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতি বেশি। তাই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঈদের সময় বাস চালাতে চান তারা। তখন অর্ধেক আসনে যাত্রী নিশ্চিত পাওয়া যাবে এমন আশা থেকেই বাস চালানোর পক্ষে সবাই। গত আট মার্চ প্রথম দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপর ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি গণপরিবহন লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। অর্থনীতির চাকা সচল রাখা ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার প্রয়োজনীয়তার কথা বলে সাধারণ ছুটি তুলে নিয়ে ৩১ মে থেকে গণপরিবহনও চালু করা হয়েছে। এরপর থেকে বাড়ছে করোনার রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা। তাছাড়া রোজার ঈদে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত যানবাহনে বাড়ি যাওয়াও সুযোগ নিশ্চিত করা হয়েছিল। যদিও এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন করোনা প্রতিরোধে গঠিত সরকারী জাতীয় কমিটির সদস্যদের অনেকেই। একদিনে আরও ৩ হাজার ২০১ জনের মধ্যে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় দেশে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৬১৮ জনে। সোমবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, তাতে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৯৬ জন। আইইডিসিআরের অনুমিত হিসেবে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি রোগী ও বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের মধ্যে আরও ৩ হাজার ৫২৪ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। এ নিয়ে সুস্থ রোগীর সংখ্যা ৭৬ হাজার ১৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বুধবার দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির এই সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন। করোনা নিয়ে গবেষণায় নিয়োজিত ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য বলছে, সংক্রমণ বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮ তম। এই প্রেক্ষিতে গত রবিবার এক ব্রিফিংয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সরকারকে এখন করোনার সংক্রমণ রোধ ও অসহায় মানুষের প্রোটেকশন, বন্যাকবলিত ১২টি জেলার মানুষের সুরক্ষা এবং আসন্ন ঈদে মানুষের ভিড় এড়ানো এই তিনটি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। রোজার ঈদে মানুষের অবাধ চলাচল, ভিড় সংক্রমণের মাত্রাকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কোরবানির ঈদে এ সমাগম ও ভিড় যে কোন মূল্যে এড়াতে হবে। নিজেদের বেঁচে থাকার স্বার্থেই এটা করতে হবে। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় ঘরমুখো মানুষের স্রোত সামলাতে গণপরিবহন বন্ধ রাখার পক্ষে সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কর্মকর্তারা বলছেন, গণপরিবহন চালু থাকলে ঘরমুখো মানুষের চাপে করোনার সংক্রমণ বেশি হতে পারে। তাই প্রতিরোধে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানে থেকে উৎসব পালনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হতে পারে। তবে সবকিছু নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির ওপর। আগামী তিন আগস্ট ঈদ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই হিসেবে সময় আরও প্রায় একমাস। এই সময়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর গতি প্রকৃতির ওপর নির্ভর করবে গণপরিহন চলবে কি, চলবে না। এদিকে আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় গণপরিবহন চলাচল করবে কিনা সে বিষয়ে পরিবহন মালিক শ্রমিক নেতাদের অনেকেই অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোন সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মালিকরা সরকারের দেয়া সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়ম মেনেই ঈদে বাস চলাচলের পক্ষে। ঈদে পরিবহন চলাচলের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াত করা সাকুরা পরিবহনের ম্যানেজার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোজার ঈদের সময় পরিবহন বন্ধ ছিল। তবে এখন অর্ধেক যাত্রী নিয়ে বাস চলাচল করছে। এই নিয়মেই যদি কোরবানির ঈদের সময় পরিবহন চলাচল করতে নির্দেশনা দেয়া হয় তাহলে আমরা সে অনুযায়ী বাস চালাব। এছাড়া ঈদে যাত্রী পরিবহনে সব ধরনের প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে। ঢাকা-কক্সবাজার রুটের সেন্টমার্টিন পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, গত রোজার ঈদে বাস চলাচল বন্ধ ছিল, যে কারণে আমাদের ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছিল। আমি বলব ঈদ-উল- আজহায়ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার, তাহলে আমরাও বাসের সংখ্যা বাড়াব। যেন কোন ধরনের ঝুঁকির মুখে যাত্রীরা না পড়েন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বর্তমানে ৬০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি ও অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলাচল করছে দেশের গণপরিবহনগুলো। আমরা চাই সরকার ঈদের সময়েও এই একই নিয়মেও যদি পরিবহন চলাচলের নির্দেশনা দেয় তাহলে আমরা সেভাবেই তা পালন করব। তিনি বলেন, ঈদের সময় আমরা সবাই দেখেছি যাত্রীদের অতিরিক্ত চাপ দেখা যায়। তাই এই সময়ে করোনার ঝুঁকিও রয়েছে। তবে এ ঝুঁকি থেকে রক্ষায় আমরা বাসের সংখ্যা বাড়াব। আমরা চাই সরকারের দেয়া সব নির্দেশনা মেনে গাড়ি চালাতে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর বলছেন, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখা গেছে, সংক্রমণের হার অনেকটা স্থিতিশীল। ভাইরাসের রিপ্রোডাকশন রেট যাকে আর-নট বলা হয়, বাংলাদেশে গত দু সপ্তাহে এই হার ১-এর নিচে নেমে এসেছে, যেটা একটা পজিটিভ সাইন। আর নট দিয়ে বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেন একজন মানুষ কতজনকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা রাখে। ডাঃ আলমগীর বলছেন, বাংলাদেশে আর নট-এর হিসাব থেকে তারা মনে করছেন একজন আক্রান্ত ব্যক্তির যেহেতু এখন একজনের কম লোককে সংক্রমিত করার আশঙ্কা, সেটা আশাব্যঞ্জক। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা যেটা দেখছি, সবগুলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একসঙ্গে কার্যকর রাখলে জুলাইয়ের শেষ নাগাদ সংক্রমণ কমতে শুরু করবে। তবে তিনি এটাও আশঙ্কা করছেন, ঈদ-উল-আজহার সময় গরুর হাট এবং ঈদে বাড়ি যাওয়া-আসার প্রবণতা আবার বাড়লে সংক্রমণের এই স্থিতাবস্থা আবার উর্ধগতিতে রূপ নিতে পারে। আমরা একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়ে যেতে পারি। ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে যদি কোরবানি ঈদে গরুর বাজার এবং মানুষের দল বেঁধে বাড়ি যাওয়া চলে- সেটা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তখন আমরা আরেকটা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারি। আবারও রোগীর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, এখানে দুইটি বিষয় মিলিয়ে প্রভাব পড়বে, যার ওপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়া বা কমার বিষয়গুলো অনেকাংশে নির্ভর করবে। তিনি বলছেন, রাজাবাজারের মতো যেসব এলাকায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন করা হচ্ছে, সেটা যদি একসঙ্গে অনেকগুলো জায়গায় কার্যকর করা যায়, রোগীদের আইসোলেশনে রাখা যায়, তাহলে হয়তো সংক্রমণ রোধে সেটা সহায়তা করবে। কিন্তু কোরবানির হাটের কারণে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার আবার একটা ঝুঁকি তৈরি হবে। যারা গরু নিয়ে এসব হাটে আসবেন, তাদের মাধ্যমে যেমন রোগ আসতে পারে, তাদের মাধ্যমে সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে যেতে পারে। তেমনি যারা গরু কিনতে যাবেন, তাদের মাধ্যমেও সংক্রমণ অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে যেতে পারে। ফলে সংক্রমণের পরিস্থিতি কি দাঁড়াবে, সেটা বোঝার জন্য ঈদ-উল-আজহা পার হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
×