ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য মো. লুৎফর রহমানের ইন্তেকাল

প্রকাশিত: ১৬:২০, ২৯ জুন ২০২০

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্য মো. লুৎফর রহমানের ইন্তেকাল

স্টাফ রিপোর্টার, যশোর অফিস ॥ না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন সাবেক জাতীয় ফুটবলার ও স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য মো. লুৎফর রহমান। আজ সোমবার সকাল ৮.৪৫ মিনিটে যশোরে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে ব্রেইন স্ট্রোক করার পর থেকে নিজ বাড়িতেই ছিলেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য মো. লুৎফর রহমান। প্যারালাইসিস হয়ে যাওয়া ৬৯ বছর বয়সী লুৎফর রহমানের চিকিৎসা হচ্ছিল না ঠিকমতো। বিষয়টি জানার পর বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের জুলাই মাসে লুৎফর রহমানের চিকিৎসা এবং অন্যান্য সহযোগিতা বাবদ ৩০ লাখ টাকা প্রদান করেছিলেন। গত ১৫ জুলাই লুৎফর রহমানের স্ত্রী মাজেদা রহমানের হাতে ৫ লাখ টাকার চেক এবং ২৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র তুলে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। মো. লুৎফর রহমানের বাসা যশোর শহরের লোন অফিস পাড়ায়। অসুস্থ হওয়ার পর থেকে যশোরে নিজের বাসাতেই শয্যাশায়ী ছিলেন। তিনি এক পুত্র ও এক কন্যার জনক। নিজে ফুটবলার হলেও লুৎফরের একমাত্র ছেলে তানভীর খেলছেন ক্রিকেট। সোমবার বিকালে নামাজের জানাজা শেষে সদরের ঘুরুলিয়া গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। লুৎফর রহমান যশোর শহরের লোন অফিস পাড়ার ১৯৫১ সালে জন্মগ্রহণ কারেন। তার বাবা বরকতুল্লাহ ও মাতা রাবেয়া বেগম। লুৎফর রহমান ছোটবেলা থেকে ফুটবল এবং হকি খেলায় আগ্রহী ছিলেন। যশোর জিলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় ফুটবল খেলায় শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের পুরস্কার পান। তিনি ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত যশোর জেলা ফুটবল দলের হয়ে নিয়মিত খেলায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া তিনি ১৯৬৮তে পূর্ব পাকিস্তান বোর্ড দলের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্মিলিত বোর্ডের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন। ১৯৬৯ এ ঢাকা ওয়ারী ক্লাবে যোগ দেন এবং ১৯৭০ সালে দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তখন দেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টিতে খেলোয়াড়দের ডাক দিয়ে সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নিলেন কয়েকজন তরুণ- আলী ইমাম, প্রতাপ, প্যাটেল, জাকারিয়া পিন্টু, আশরাফ ও মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ১৬টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে ভারতীয় মুদ্রার ৩ লাখ টাকা তুলে তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কাছে দিয়েছিলেন। ১৬টি খেলার মধ্যে ১২টি খেলায় জয়লাভ করেন। সব থেকে গৌরবময় খেলাটি ছিল ২৪ জুলাই ভারতের নদীয়া স্টেডিয়ামে। ওই দিন ছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের প্রথম খেলা। খেলোয়াড়রা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নিয়ে তারা মাঠ যাবে। এরপর মাঠে আনুষ্ঠানিক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের তালে তালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার উত্তোলন করতে হবে। বিষয়টি নদীয়া ক্রীড়া সমিতিকে যথাসময়ে অবহিত করা হয়। এই খেলাকে উপলক্ষ করে নদীয়া স্টেডিয়ামে ব্যাপক ফুটবলপ্রেমী জড়ো হয়েছিল। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার মারফত খেলার বিষয়ে অবহিত হয়ে কুষ্টিয়া জেলা থেকে উৎসাহী ক্রীমামোদীরা বিপুল সংখ্যায় মাঠে সমবেত হলেন। কিন্তু সমস্যা বাঁধলো বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজানো ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন নিয়ে। ভারতের সরকার তখন বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। খেলার নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু পতাকা ও জাতীয় সংগীতের বিষয়ে নিষ্পত্তি ছাড়া বাংলাদেশের ফুটবল দল মাঠে নামবে না কিছুতেই। অবশেষে নদীয়ার জেলা প্রশাসক স্বপ্রণোদিত হয়ে ভারত ও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন ও জাতীয় সংগীত বাজানোর বিষয়ে সম্মত হয়। সেদিন পিন্টু-প্রতাপের হাতে ধরা মানচিত্রখচিত পতাকা উড়লো বিদেশের মাটিতে। এই খেলার মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথমবারের মত বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে অন্য একটি স্বাধীন দেশের পতাকার সমমর্যাদায় উত্তোলিত হয়। এ ঘটনার পর নদীয়ার জেলা প্রশাসক সাময়িক বরখাস্ত হন এবং নদীয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার এ্যাফিলিয়েশন বাতিল করা হয়। কিন্তু এ সংস্থার নজিরবিহীন ঘটনা রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুলভাবে উৎসাহিত করে।
×