ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

আকাশের নিচে আরেক আকাশ, আলোয় আলোয় বর্ণিল

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২৪ জুন ২০২০

আকাশের নিচে আরেক আকাশ, আলোয় আলোয় বর্ণিল

রাজন ভট্টাচার্য ॥আকাশের নিচে যেন আরেক আকাশ। যেখানে তারা নেই, আছে রং-বেরঙের আলো। একপাশ থেকে অন্যপাশে আলোর চলাচল। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি এমন মনোরম দৃশ্য। অমাবশ্যার আকাশে চোখ পড়লে সত্যিই নিজেকে থামিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় নেই। হম্ম্। তাই বলছি। একেবারে ধাক্কা খাওয়ার মতো অবস্থা। উপরে যে প্রান্তে চোখ যাবে সবখানেই আলোয় আলোয় যেন পুরো বর্ণিল। এর সঙ্গে যোগ হবে ভঁ ভঁ শব্দ। এমন আকাশ খুব একটা চোখে পড়ার কথা নয়। মনে হতেই পারে আকাশপথের কোন যান। নাকি অন্যকিছু। হ্যাঁ, একেবারেই অন্যকিছু। তা হলো ঘুড়ি। দিনের ঘুড়ি এখন রাতের আকাশজুড়ে অবাধ বিচরণ। বলছি রঙিন ঘুড়ি উৎসবের গল্প। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় নতুন অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে এটি। সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনার রাতের আকাশে এখন এমন চিত্র প্রতিদিনের। বিশেষ করে সদর উপজেলায় এ রকম ঘুড়ি বেশি দেখা মেলে। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পোস্টে দাবি করা হয়েছে, আটপাড়া উপজেলায় সবচেয়ে বড় ঘুড়ি তৈরি করে সফলভাবে ওড়ানো সম্ভব হয়েছে। কিশোর থেকে তরুণ, বৃদ্ধ, গৃহিণী সব বয়সের মানুষ যোগ দেন রাতের ‘ডিজিটাল ঘুড়ি’ উৎসবে। এজন্য প্রস্তুতি চলে দুপুরের পর থেকেই। ব্যাটারি খুলে চার্জ দেয়া থেকে শুরু করে স্থান নির্বাচন, নতুন নতুন লাইন এনে যুক্ত করাসহ খাবারদাবারের ব্যবস্থাও থাকে উৎসবে। অর্থাৎ গ্রামের আবালবৃদ্ধবনিতা সবার কাছেই বিনোদনের এখন বড় মাধ্যম ঘুড়ি ওড়ানো। তাছাড়া কার ঘুড়ি কত বড়, কত বেশি বর্ণিল আলো দেয়, কত সময় আকাশে ওড়ে। এ নিয়ে আলোচনা আর প্রতিযোগিতার যেন শেষ নেই। আছে সুতা কাটার প্রতিযোগিতাও। গ্রামগঞ্জে এখনও ঘুড়ি বলতে দিনের আকাশে ওড়ানোকে বোঝায়। কিন্তু সাধারণ ঘুড়ি প্রযুক্তিবিদরা এক্ষেত্রেও একেবারেই নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা করেছেন। তাতে সফলও হয়েছেন তারা। তাদের মতামত হলো, রাতের আকাশে উড়বে রঙিন ঘুড়ি। ছড়াবে আলোর দ্যুতি। যা সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো। হইচই হবে সবার মধ্যে। শহর থেকে এই নতুনত্বের খবরে গণমাধ্যমে ছুটে যাবে গ্রামের মেঠোপথে। তবে নতুন এই ঘুড়ির প্রকৃত উদ্ভাবক কে, এ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য খুব একটা পাওয়া যায়নি। অনেকেই উদ্ভাবকের দাবিদার। তবে ঘুড়ি প্রযুক্তিবিদদের সবাই গ্রামের সাধারণ, সহজ-সরল খেটেখাওয়া মানুষ। অবসর সময়ে বিনোদনের জন্যই মূলত তারা নতুন ঘুড়ি আবিষ্কারের চিন্তা করেন। এবার ঘুড়ির পর্বে আসা যাক। মূলত বাঁশের চটি, শক্ত সুতা আর প্লাস্টিকের ছাউনি দিয়ে প্রথমে ঘুড়ি তৈরি করা হয়। তার পর এর মাঝখানে যুক্ত করা হয় মোবাইলের ব্যাটারি। ব্যাটারির সঙ্গে চিকন ইলেকট্রিক তার যুক্ত করে ঘুড়ির চারপাশজুড়ে ছোট ছোট মরিচ বাতি বা ফোকাস লাইট, রেডিয়াম দেয়া হয়। যত দামী ব্যাটারি যুক্ত হয় তত বেশি সময় আকাশে আলো দেয়। তবে একবারের চার্জে কমপক্ষে ছয়ঘণ্টা ঘুড়ি ওড়ানো সম্ভব। বেশি সৌখিন লোকজন ইতোমধ্যে একাধিক ব্যাটারি কিনেছেন। আলো নিভে গেলে ঘুড়ি নামিয়ে দ্রæত নতুন ব্যাটারি যুক্ত করে ফের ওড়ানোর প্রতিযোগিতায় শামিল হন। লাইটিংয়ের কাজ শেষ করার পর ওড়ানোর জন্য যুক্ত করা হয় লম্বা সুতা। এর আগে ঘুড়ির সামনের অংশে বাঁকা বাঁশের চটির সঙ্গে প্লাস্টিকের সুতা বে৭ধে দেয়া হয়। ধনুকের মতো বাঁকা এই অংশটির কাজ হলো ডাক তৈরি করা। অর্থাৎ আকাশে ওড়ামাত্রই ভঁ ভঁ শব্দ হতে থাকে। যাকে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘ডাক ঘুড্ডি’। উদ্ভাবকরা জানিয়েছেন, একটি ইলেকট্রিক ঘুড়ি বানাতে ব্যয় হয় কমপক্ষে ৭০০টাকা। আরও আকর্ষণীয় করতে খরচ হয় দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে নতুন এই ঘুড়ির খবর জেনেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। তাই ঘুড়ি বিক্রির অর্ডার আসছে বিভিন্ন জেলা থেকে। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে বুকিং দেয়া হচ্ছে ঘুড়রি জন্য। তৈরি শেষে এসব ঘুড়ি বিশেষ প্রক্রিয়ায় মোড়কজাত করে পাঠানো হচ্ছে কুড়িয়ার সার্ভিসে। নেত্রকোনা সদর উপজেলার চার নং সিংহের বাংলা, আমতলা, সতরশ্রি, চল্লিশা, মৌগাতি, মেদনী, লক্ষীগঞ্জ, দক্ষিণ বিশিউড়া, কাইলাটি, মৌগাতি, রৌহা, মদনপুর, কালিয়ারা, গাবরাগাতি ইউনিয়নে রঙিন ঘুড়ির সবচেয়ে বেশি প্রচলন। এছাড়া বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর, আটপাড়া উপজেলায়ও কমবেশি রঙিন ঘুড়ির খবর ছড়িয়েছে। সিংহের বাংলা ইউনিয়নের বাংলা, নারায়ণপুর, কাউয়ারশি, বিজয়পুর, দিগলা, কান্দুলিয়া, বর্ণি সতরশ্রিসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুড়ে দেখা গেছে, দিনেরবেলায় বেশিরভাগ বাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রস্তুতি। সুতায় শান দেয়া থেকে শুরু করে ঘুড়ি নির্মাণে ব্যস্ত অনেকে। ইরি-বোরো মৌসুম শেষ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কার মধ্যে ভালোয় ভালোয় বাম্পার ফসল ঘরে তোলার পর্ব একেবারেই শেষ। সমাপ্তি হয়েছে ধানসিদ্ধ থেকে শুকানোর কাজও। তাছাড়া করোনাকালে এখন গ্রামের প্রায় সব পরিবারের মানুষের অখÐ অবসর। তাই প্রতিদিন ঘুড়ি উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। রাতে বিলের পাড়, পুকুর পাড়, রাস্তা থেকে শুরু করে খালি মাঠ সবখানেই দলে দলে মানুষের আড্ডা। হাতে হাতে ঘুড়ি আর টর্চ লাইট। এক ঘুড়ি যেন তিনজনের হাতে। কারণ বাতাসে বেশি টান থাকে সুতার। তাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে একাধিক হাত যুক্ত করে ধরে রাখা হয়। তবে ঘুড়ি উৎসবে মাঝে মধ্যে বাদ সাধে বর্ষার মেঘ আর ঝড়োহাওয়া। যেদিন বৃষ্টি থাকে সেদিন আকাশ যেন একেবারেই নিষ্প্রাণ। ঘুড়ি উঠে না। মাঝে মাঝে মেঘ ফুঁড়ে দেখা মেলে তারার। বাতাস কমবেশি থাকলেও লাইট আর ব্যাটারি নষ্ট হওয়ার ভয়ে কেউ আর ঘুড়ি আকাশে ছাড়েন না। এজন্য মন খারাপের শেষ থাকে না অনেকের। আর উৎসুক মানুষও আশাহত হন। যারা সরাসরি উৎসবে অংশ নিতে পারেন না তারা ঘর থেকে বের হয়ে একবার হলেও আকাশে উঁকি দেন। উপভোগ করেন রং-বেরঙের ঘুড়ি। অনেক ঘুড়ির লেজেও দেয়া হয় মরিচবাতি। যা অনেকের কাছে বেশি পছন্দের বা উপভোগের। বাংলা ই্উনিয়নের কান্দারবাড়ির জানে আলম জানালেন, ধান কাটার মৌসুম শেষ হয়ে গেছে। হাতে এখন তেমন কাজ নেই। বিলের নতুন পানিতে আসছে মাছ। দিনেরবেলায় মাছ ধরা হয় অল্প সময়। বাকি সময় ঘুড়ি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। অনেকেই ঘুড়ি বানাতে টাকা দিয়ে বায়না করেছেন। ঘুড়ি তৈরি করে কুরিয়ারে পাঠাচ্ছি বিভিন্ন জেলায়। তিনি জানান, সন্ধ্যা থেকে রীতিমতো উৎসব শুরু হয়। সবাই একসঙ্গে জড়ো হয়ে একের পর এক ঘুড়ি আকাশে ছাড়তে থাকি। তারা ওঠার আগেই আলোয় আলোয় বর্ণিল হয়ে ওঠে আকাশ। লাইটের আলোতে দেখার উপায় নেই আকাশে তারা আছে কি নেই। জানে আলম বলেন, একটি ঘুড়ি তৈরি করতে কমপক্ষে দুদিন সময় লাগে। রাতেও কাজ করতে হয়। ৭০০ থেকে দুই হাজার টাকার বেশি খরচ হচ্ছে একটি ঘুড়ি তৈরি করতে। তরিকুল জানালেন, বাঁশের খরচা খুব বেশি নয়। ব্যাটারি আর লাইটিং করার কাজেই বেশি ব্যয় হয়। সময়ও লাগে বেশি। আর বুদ্ধির খেলাটা এখানেই। তাছাড়া সুতা কেনার জন্য যায় বেশি পরিমাণ অর্থ। কিন্তু আনন্দটা একেবারেই আলাদা। তিনি জানান, ছোট ছোট পাতলা গড়নের রঙিন লাইট যত বেশি যুক্ত করা যায় ঘুড়ি তত সুন্দর দেখায়। তবে ভারি লাইট দেয়া হলে ঘুড়ি বেশি উঁচুতে উঠতে পারে না। বাংলাবাজারের বাসিন্দা চন্দন সেন জানালেন, আমরা প্রতিদিন ঘুড়ি উৎসব দেখতে যাই। অনেক মানুষ এসে ভিড় করেন রাতের ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে। নতুন এই ঘুড়ি মানুষের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হয়েছে।
×