ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়ারী ও রাজাবাজার লকডাউন ঘোষণা হতে পারে আজ

এবার এলাকাভিত্তিক লকডাউন

প্রকাশিত: ২২:১৩, ৭ জুন ২০২০

এবার এলাকাভিত্তিক লকডাউন

নিখিল মানখিন ॥ এলাকাভিত্তিক (জোন) লকডাউন শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী সরকার রেড, ইয়েলো ও গ্রীন -এই তিনটি জোনে চিহ্নিত করবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আধিক্য থাকা এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে তা লকডাউন করে দেবে সরকার। আগামী দু’একদিনের মধ্যে ঢাকায় সীমিত পরিসরে পাইলট করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী হিসেবে এলাকাভিত্তিক লকডাউন শুরু হবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে পরীক্ষামূলকভাবে রাজধানী ঢাকার দুটি ওয়ার্ড লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ওয়ার্ড দুটি হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ড (ওয়ারী) ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২৭ নম্বর ওয়ার্ড (ধানম-ির রাজাবাজার)। রবিবার সকাল থেকে এ দুটি ওয়ার্ড লকডাউন ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছে দুই সিটি কর্পোরেশন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী সপ্তাহে লকডাউন এলাকার পরিধি বাড়ানো হবে। খুব বড় এলাকায় হয়ত এটা করা হবে না। শহরে ওয়ার্ড বা মহল্লাভিত্তিক রেড জোন ঘোষণা করে তা ব্লক করে দেয়া হবে। এবার লকডাউন এলাকায় সবাইকে ঘরে থাকতে হবে। একান্ত প্রয়োজন না থাকলে কেউ বাইরে বের হতে পারবেন না। ওই এলাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব জিনিসের দরকার হবে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। নতুন উদ্যোগ বাস্তবায়নে একটি এ্যাপও তৈরি করা হয়েছে। করোনায় মৃত্যু ও আক্রান্তের উর্ধগতির লাগাম টেনে ধরতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ও করোনা সংক্রান্ত মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মোঃ হাবিবুর রহমান খান শনিবার বিকেলে জনকণ্ঠকে জানান, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সরকারের আন্তরিকতার কমতি নেই। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রতিনিয়ত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে যাচ্ছে সরকার। ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মাত্রা অনুযায়ী রেড, ইয়েলো ও গ্রীনÑএই তিনটি জোনে চিহ্নিত করে লকডাউন দিয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। করোনাভাইরাস সংক্রমণের আধিক্য থাকা এলাকাকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে তা লকডাউন করে দেবে সরকার। আগামী দু’একদিনের মধ্যে ঢাকায় সীমিত পরিসরে এলাকাভিত্তিক পাইলট করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী হিসেবে লকডাউন শুরু হবে। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আগামী সপ্তাহে লকডাউন এলাকার পরিধি বাড়ানো হবে। যে এলাকা রেড জোন ঘোষণা করা হবে, সেই এলাকা সম্পূর্ণ ব্লক রাখা হবে। সেই এলাকায় কেউ ঢুকবেও না, কেউ বেরও হবে না। ওই এলাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় যেসব জিনিসের দরকার হবে তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। অতিরিক্ত সচিব মোঃ হাবিবুর রহমান খান আরও জানান, খুব বড় এলাকায় হয়ত এটা করা যাবে না। শহরে ওয়ার্ড বা মহল্লাভিত্তিক রেড জোন ঘোষণা করে তা ব্লক করে দেয়া হবে। তাই ঢাকায় হয়ত বেশি আক্রান্ত থাকা অনেক এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে। গ্রামে হয়ত জোনিং বাস্তবায়ন কঠিন হবে না, সেখানে মানুষ কম। তবে এটি সফল করতে হলে কমিউনিটির সাপোর্ট লাগবে। স্থানীয় প্রশাসনগুলো কমিউনিটির সহায়তা নিয়েই এটা বাস্তবায়ন করবে। এ্যাপ নিয়ে যারা কাজ করছে, তারা জোনিংটা ইতোমধ্যে করে ফেলেছে, তবে তা প্রকাশ করা হয়নি। পরে হয়ত মিডিয়ায় যাবে, আর যে এলাকাকে রেড জোন ঘোষণা করা হবে, সেখানে মাইকিং হবে, বিভিন্নভাবে প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে জানানো হবে বলে জানান মোঃ হাবিবুর রহমান খান । স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেশি আক্রান্ত এলাকাকে রেড, অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত এলাকাকে ইয়োলো ও একেবারে কম আক্রান্ত বা আক্রান্তমুক্ত এলাকাকে গ্রীন জোন হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। রেড জোনকে লকডাউন করা হবে, ইয়োলো জোনে যেন আর সংক্রমণ না বাড়ে সেই পদক্ষেপ নেয়া হবে। সতর্কতা থাকবে গ্রীন জোনেও। একটি এলাকা চিহ্নিত করে সেখানকার প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে কতজন মানুষ আক্রান্ত রয়েছে, সেই অনুযায়ী রেড, ইয়েলো ও গ্রীন জোনে সেটি পড়বে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী রেড জোনে শুধু ফার্মেসি, হাসপাতাল, নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। প্রতিটি রেড জোনে স্বেচ্ছাসেবক টিম থাকবে, জনপ্রতিনিধিরা সম্পৃক্ত থাকবেন এসব টিমে। স্বেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়া ও মনিটরিংয়ের কাজ করা হবে। আক্রান্ত রোগীকে আইসোলেশনে রাখা এবং আক্রান্ত রোগীর পরিবারকে কোয়ারেন্টাইনে রাখাও নিশ্চিত করা হবে। সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহের জন্য লকডাউন করা হবে। রেড জোনে থাকা মানুষ যাতে বাইরে যেতে না পারে এবং বাইরের লোকজন যাতে সেখানে ঢুকতে না পারে সে জন্য প্রবেশ ও বের হওয়ার সড়কের মুখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেবেন রেড জোনে থাকা বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের করোনা উপসর্গ দেখা দেবে তাদের নমুনা সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করা হবে। রোগী বেশি হলে একাধিক বুথ স্থাপন করা হবে। নমুনা সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয়সংখ্যক দক্ষ টেকনোলজিস্ট নিয়োগ দেয়া হবে। তাদেরও রেড জোন থেকে বের হতে দেয়া হবে না। নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্র বা পাশে থাকা আবাসিক হোটেলে টেকনোলজিস্টদের থাকার ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট সময় কোয়ারেন্টাইনে থাকার পর তাদের রেড জোন থেকে বের হতে হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্রম অবনতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর গত ১ জুন সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মন্ত্রিপরিষদ সচিবসহ সংশ্লিষ্টরা সভায় বসেন। ওই সভা শেষে স্বাস্থ্যমন্ত্রী করোনা সংক্রমণের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন এলাকাকে রেড, ইয়েলো ও গ্রীন জোনে ভাগ করার কথা জানান। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এ্যাপের মাধ্যমে চিহ্নিত করা থাকবে কোন্ এলাকা রেড জোন, কোন্ এলাকা ইয়েলো জোন এবং কোন্টি গ্রীন জোন। আক্রান্তরা সুস্থ হয়ে গেলে, রেড জোন পর্যায়ক্রমে ইয়েলো ও গ্রীন হবে। প্রযুক্তিগত সহায়তার কাজটি করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ও এটুআই। আর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও আইইডিসিআর (রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান) তথ্য সরবরাহ করবে। চলছে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা ॥ করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই টানা ৬৬ দিনের ছুটি শেষে গত ৩১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত বিভিন্ন নির্দেশনা মানা সাপেক্ষে সীমিত পরিসরে সরকারী-বেসরকারী অফিস খুলে দেয়া হয়। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বন্ধ থাকা গণপরিবহনও (বাস, লঞ্চ, ট্রেন) চালু হয়। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানছে না অধিকাংশ মানুষ। ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই জনসমাগমে মিশে যাচ্ছে তারা। স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। সরকারী নির্দেশনা অনুযায়ী সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখছে না মানুষ। বাসার বাইরে হওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে অনেকগুণ। রাস্তাঘাট, অলি-গলি, বাজারসহ সর্বত্রই মানুষের ভিড়। শহরাঞ্চলে ইতোমধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে যানবাহনগুলোর জট। ন্যূনতম সুরক্ষার উপাদান মাস্ক না পরেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনেকে, ঠেলাঠেলি করে বাজার করছেন। কেউ কেউ অপ্রয়োজনীয় আড্ডা দিচ্ছেন। মানুষের এমন ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ দেশের করোনা পরিস্থিতিকে মহামারীর দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকারী- বেসরকারী প্রতিষ্ঠানসহ যানবাহন চালু করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এমন স্বাধীনতা পেয়েই করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ রূপ ভুলে যেতে বসেছেন সাধারণ মানুষ। দেশে প্রতিদিন করোনায় নতুন করে মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড গড়ার বিষয়টি আমলে নিচ্ছেন না তারা। সংক্রমণের চতুর্থ ধাপ মহামারীর দ্বারপ্রান্তে রয়েছে দেশের করোনা পরিস্থিতি। উপসর্গহীন রোগী এবং সন্দেহজনক করোনা রোগীর তথ্য গোপন করার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় করোনার নীরব সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা করার আগ পর্যন্ত রোগী নিজেও করোনার উপস্থিতি বুঝতে পারছেন না। করোনার এমন পরিস্থিতিতে কোন ব্যক্তিই সন্দেহের বাইরে থাকছে না বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
×