ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনায় সব তছনছ

চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিপাকে সাধারণ রোগী

প্রকাশিত: ০৯:৪১, ২৫ এপ্রিল ২০২০

  চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিপাকে সাধারণ রোগী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ প্রতিদিন দেশে বাড়ছে করোনা রোগীর সংখ্যা। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যু। আক্রান্ত ও মৃত্যু বিবেচনায় অনেক দেশকে ছাপিয়ে এখন বাংলাদেশের অবস্থান। আগামী দিনগুলোতে রোগীর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। সব মিলিয়ে করোনায় চারদিকে আতঙ্কের শেষ নেই। এরমধ্যে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন হাসপাতালে জরুরী সেবা না পাওয়ার অভিযোগ করছেন অনেকেই। আবার যেসব হাসপাতাল করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত সেসব হাসপাতাল থেকে সাধারণ রোগী বের করে দেয়ারও অভিযোগ মিলেছে। সেইসঙ্গে করোনার বাইরে অন্য কোন রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। এ কারণে রীতিমতো বিপাকে সাধারণ রোগীরা। প্রশ্ন হলো সাধারণ রোগীরা কোথায় যাবে? কোথায় মিলবে তাদের চিকিৎসা সেবা? অনেকের সরকারী হাসপাতাল ছাড়া বিকল্প নেই। বেসরকারী হাসপাতালে গিয়ে রোগীদের ফেরত আসার নজির অহরহ। করোনা আতঙ্কের কারণে চিকিৎসার অবহেলার অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে। অবহেলায় রোগী মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে বেশ কয়েকটি। মুগদা জেনারেল হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার সরকারী এই হাসপাতালটি ঢাকার এক অংশের মানুষের চিকিৎসার নিরাপদ ঠিকানা। ঢাকার বাইরে থেকেও গুরুতর রোগী এখানে আসেন নিয়মিত। গত সপ্তাহে এই হাসপাতালে করোনা ইউনিট চালু ও এ রোগের চিকিৎসার ঘোষণা আসে সরকারের পক্ষ থেকে। এবার প্রস্তুতির পালা। রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ঘোষণা আসার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য রোগীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়। বলা হয় করোনা রোগী ভর্তি হলেও অন্য ইউনিটে থাকা সাধারণ রোগীরা সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে যায় সব বিভাগে। এই অবস্থায় বেশিরভাগ রোগী ছাড়পত্র নিয়ে বাড়ি চলে যান। অনেকেই না বলে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। তবে কোন পক্ষ থেকে এই আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে তা জানা যায়নি। রোগীরা জানিয়েছেন, আতঙ্কে রোগীর সংখ্যা কমে গেলে এক পর্যায়ে অন্যদের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিদায় করে দেন। ফলে এই হাসপাতালটি এখন কার্যত সাধারণ রোগী শূন্য। হাসপাতাল সংলগ্ন আহাম্মদবাগ এলাকার বাসিন্দা আশরাফ জানালেন, আমিও ভর্তি ছিলাম মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু করোনা রোগী ভর্তির খবরে আতঙ্ক ছড়ায় পুরো হাসপাতালজুড়ে। অনেকেই স্বেচ্ছায় চলে আসেন। আমিও। সেখানে করোনার বাইরে আর কোন চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে না বলে অন্যদেরও বিদায় করা হয়েছে। এখন আমার কি হবে। আমি তো দিনদিন শুকিয়ে যাচ্ছি মোটা দাগে অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসা নেয়ারও ক্ষমতা নেই। বিশ্বরোডে হেলথ এইড হাসপাতালে যোগাযোগ করার পর সেখান থেকে জানানো হয়েছে, করোনার কারণে ডাক্তাররা আসেন না, তাই সেবা কার্যক্রম বন্ধ। করোনা রোগের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর থেকেই রাজধানীর ইস্কাটনের এইচপিআরসি হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ। সেখানেও রোগীদের বিদায় করে দেয়া হয়েছে। অথচ দেশের নিউরোলজি সমস্যায় ভোগা রোগীদের এই হাসপাতালটি অন্যতম ভরসার জায়গা। এদিকে করোনাকালে সব মানুষের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে মাঠে নামছে ভোক্তা অধিকার ফোরাম। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ সাধারণ রোগের চিকিৎসা না পেলে বেশি অসহায় বোধ করবেন। দুর্বল হবেন মানসিক দিক থেকেও। ফলে কমবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। তাই সকলের জন্য সব ধরনের চিকিৎসাসেবা হাসপাতালগুলোতে নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন সবাই। এজন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আরও বেশি নজরদারি বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছেন তারা। রাজধানীর শাহবাগে বারডেম জেনারেল হাসপাতাল। এখানে ডায়াবেটিক রোগীদের সেবা দেয়া হয়। সাধারণ সময়ে হাসপাতালের বহির্বিভাগে এবং মূল ফটক ঘিরে শত শত রোগী থাকেন। শুক্রবার হয় সবচেয়ে বেশি রোগী। সকালে দেখা গেছে মূল ফটকের সামনে কয়েকজন রোগী হুইল চেয়ারে বসা। হাসপাতালে নিয়মিত চেকআপের জন্য আসা মানুষের ভিড় এখন একেবারেই নেই। রোগীরা বলছেন, সেবা সঙ্কুচিত করা হয়েছে। যারা এসেছেন তারাও সেবা পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। গত আট মার্চ দেশে প্রথম করোনার রোগী শনাক্ত হয়। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে গত ২৬ মার্চ থেকে চলছে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি। যে কারণে পরিবহনসহ সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ। যদিও স্বাস্থ্যসেবা, পণ্য পরিবহন, ব্যাংক এবং গণমাধ্যমের মতো কয়েককটি খাত চালু আছে। স্বাস্থ্যসেবার অংশ হিসেবে সরকারী হাসপাতাল চালু আছে। বেসরকারী হাসপাতালের সমিতিরও দাবি তাদের হাসপাতাল চালু আছে। বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে জরুরী বিভাগে ডাক্তার নার্স থাকলেও, যেহেতু হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বসছেন না এবং তাদের প্রাইভেট সেবা বন্ধ। সে কারণে সাধারণ রোগ কিংবা ক্রনিক অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে কোন অসুস্থতায় ভোগা মানুষের চিকিৎসা প্রায় বন্ধ রয়েছে। কিন্তু রোগবালাই তো থেমে নেই। করোনা আতঙ্কে সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসা অবহেলায় এক তরুণীর মৃত্যুর অভিযোগ করেছেন তার স্বজনরা। তারা জানান, ১৬ মার্চ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসক নার্সদের অবহেলায় কানাডা ফেরত নাজমা আমিন (২৪) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। মৃত নাজমার বাবা আমিনুল্লাহ জানান, ১০ মাস আগে তার মেয়ে কানাডা গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। চলতি মাসের ৯ মার্চ দেশে ফেরেন। পেটের ব্যথার জন্য তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ২১৯ নম্বর ওয়ার্ডে তাকে ভর্তি করা হয়। তিনি বলেন, শনিবার দুপুরে নতুন শিফ্টের এক নার্স এসে নাজমার সঙ্গে কথা বলে সে কানাডা ফেরত শুনেই ওয়ার্ডে তাকে করোনা রোগী বলে সবাইকে জানাতে থাকেন। সঙ্গে সঙ্গে ওয়ার্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর আর কোনো নার্স, ডাক্তার, স্টাফ তার কাছে আসেননি। তখন তার করোনা টেস্ট করা হয়। ওইদিনই বিকেল ৫টায় আইইডিসিআরের রিপোর্টে তার করোনা নেগেটিভ পাওয়া যায়। তবে তার আগেই দুপুর ১টায় তার মৃত্যু হয়। পরে তার মৃতদেহ আমাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চিকিৎসক, নার্স, স্টাফদের অবহেলায় তার মেয়ের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ তার। গত ১০ এপ্রিল করোনাভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে রাজধানীর শ্যামলীর ঢাকা শিশু হাসপাতালে চিকিৎসকের অবহেলায় হোসেইন (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে স্বজনরা। মৃত শিশুটির চাচা মোঃ পিয়াস বলেন, গত ২ এপ্রিল খেলাধুলা করার সময় খাট থেকে পড়ে তার পা ভেঙ্গে যায়। পায়ে ব্যথার সঙ্গে গত তিন দিন ধরে পেটে গ্যাসের কারণে সে বাথরুমেও যাচ্ছিল না। এই অবস্থায় নয় এপ্রিল রাতে মিরপুর ১০ নম্বরের একটি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার পর কোন উন্নতি হয়নি। পরদিন মিরপুর-২ নম্বরে শিশু হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসকেরা জানান, শিশুটির রক্তের চাপ কমে পেটে ব্যথার কারণে শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। এই অবস্থায় শুক্রবার বেলা ১২টার দিকে ঢাকা শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। ২২ মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় এক ব্যক্তির মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। মৃতের পরিবার বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে চিকিৎসা দিতে দেরি হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে। অথচ, পরীক্ষার পর তার করোনা নেগেটিভ এসেছে। মৃত ব্যক্তির নাম মোঃ আবু তালেব। তিনি ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা থানার কামারগ্রামের মৃত আবদুল মালেক সরদারের ছেলে। রোগীর ভর্তি বিপত্তি ॥ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর অনেক হাসপাতালই অন্য স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে আসা রোগী ভর্তিতে আপত্তি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক কর্মকর্তা মোঃ জাকির হোসেন জানান, তার হৃদরোগাক্রান্ত মাকে নিয়ে ছয়টি হাসপাতাল ঘুরে সপ্তম হাসপাতালে ভর্তি করাতে সক্ষম হন। মার্চে রোগীর হার্টে রিং পরানো হয়েছিল। কিন্তু তিন সপ্তাহ পরে মুখে ঘা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন হোসেনের মা। সাধারণ রোগের চিকিৎসা প্রায় বন্ধ ॥ করোনা রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রোগ শনাক্তে নমুনা সংগ্রহ এবং করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের সংখ্যাও বাড়াচ্ছে সরকার। কিন্তু বিশেষায়িত বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সেবা দেয়া কার্যত বন্ধ রয়েছে। যদিও কিছু বেসরকারী হাসপাতাল দাবি করছে তাদের কার্যক্রম চলছে, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। এমনকি সরকারী হাসপাতালেও রোগী ভর্তি করা হচ্ছে না। ডাক্তার-রোগী পাল্টাপাল্টি অবস্থান ॥ এমনিতেই জনসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তার ও সেবাকর্মীর সংখ্যা অনেক কম। সরকারী হিসাবে রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১ লাখ ২ হাজার ৯২৭ জন। এছাড়া রেজিস্টার্ড নার্স ৫৬ হাজার ৭৩৪ জন। স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রোগীর উপচে পড়া ভিড় দেখা যায় সব সময়। বর্তমান অবস্থায় সেবা নিয়ে চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ রয়েছে। রোগীর অভিযোগ, হাসপাতালের জরুরী বিভাগেও তারা সেবা পাচ্ছেন না। সেই সঙ্গে বেসরকারী ক্লিনিক ও বহু হাসপাতাল বন্ধ। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর স্বাস্থ্য সেবার এই পরিস্থিতিতে এপ্রিল মাসের শুরুতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, কোন হাসপাতাল যদি ইমার্জেন্সিতে আসা রোগীকে চিকিৎসা না দেয়, তাহলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। পরে এপ্রিলের নয় তারিখে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন বিএমএভুক্ত ৬৯টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টা সব রোগের চিকিৎসা সেবা দেবে হবে বলে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মোঃ এনামুর রহমান, যিনি বাংলাদেশে বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল সমিতিরও একজন নেতা।
×