ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ॥ সমস্যা ও সমাধান

প্রকাশিত: ০৮:৩৭, ১৬ এপ্রিল ২০২০

উচ্চতর আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ॥ সমস্যা ও সমাধান

(গত মঙ্গলবারের পর) এরপর বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসে বাংলাকে সরকারী কাজকর্মে ব্যবহার করার নির্দেশনা দেন। ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ পত্রিকায় এই মর্মে সংবাদ প্রচারিত হয়ের্ছিল যে, ‘তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ইউসুফ আলী বলেছেন ‘জীবনের সর্বস্তরে বাংলা চালুর প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে।’ ১৯৭২ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ‘দ্য বাংলা একাডেমি অর্ডার’ ১৯৭২ জারি করেন। এ আদেশ বলে ‘কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ বাংলা একাডেমির সঙ্গে সমন্বিত হয় এবং কাউ›িসলের নাম পরিবর্তন করে ‘কার্যনির্বাহী পরিষদ’ করা হয়। বাংলা একাডেমির প্রধান নির্বাহী হিসেবে মহা-পরিচালক পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি অফিস আদালতে ব্যবহার ও অনুশীলনের জন্য পরিভাষার একটি ছোট কোষ প্রকাশ করে। ১৯৭৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য দ্রুততর কার্যক্রম গ্রহণ এবং সুচিন্তিত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিষয়গুলোতে পরিভাষার উপযুক্ত সমস্যা ও এর সমাধানের জন্য শিক্ষক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের আহ্বান জানিয়েছেন। ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি ‘প্রশাসনিক পরিভাষা’ প্রকাশ করে। (সূত্র : সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহারে প্রশাসনিক নির্দেশনা- মোঃ মোস্তফা শাওন-১৪-১৫) ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১২ মার্চ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি কঠোর নির্দেশ জারি হয়— ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। বাংলা আমাদের জাতীয় ভাষা। তবুও অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, স্বাধীনতার তিন বছর পরেও অধিকাংশ অফিস-আদালতে মাতৃভাষার পরিবর্তে বিজাতীয় ভাষায় নথিপত্র লেখা হচ্ছে। মাতৃভাষার প্রতি যার ভালবাসা নেই দেশের প্রতি যে তার ভালবাসা আছে এ কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষার পরেও বাংলাদেশের বাঙালী কর্মচারীরা ইংরেজী ভাষায় নথিতে লিখবেন এটা অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উচ্ছৃঙ্খলা চলতে দেওয়া যেতে পারে না। এ আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধাসরকারী অফিসসমূহে কেবল বাংলার মাধ্যমে নথিপত্র ও চিঠিপত্র লেখা হবে। এ বিষয়ে কোনও অন্যথা হলে উক্ত বিধি লঙ্ঘনকারীকে আইননানুগ শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করা হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতের কর্তা ব্যক্তিগণ সতর্কতার সঙ্গে এ আদেশ কার্যকর করবেন। তবে বিদেশী সংস্থা বা সরকারের সঙ্গে পত্র যোগাযোগ করার সময় বাংলার সঙ্গে ইংরেজী অথবা সংশ্লিষ্ট ভাষায় একটি প্রতিলিপি পাঠানো প্রয়োজন। তেমনিভাবে কোনও সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের সময়ও বাংলার সঙ্গে অনুমোদিত ইংরেজি বা সংশ্লিষ্ট ভাষার প্রতিলিপি ব্যবহার করা চলবে। এ আদেশ অবিল¤ে¦ কার্যকর হবে।’ (সূত্র : সরকারী কাজে বাংলা ব্যবহারে প্রশাসনিক নির্দেশনা- মোঃ মোস্তফা শাওন-১৪-১৫) বঙ্গবন্ধু তাঁর এই দৃঢ় নির্দেশনাতে দুইবার অফিস-আদালত শব্দ দুটি একসঙ্গে ব্যবহার করেছেন; তাঁর কথার ব্যাখ্যা করার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবুও বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই তাঁর প্রদত্ত ব্যাখ্যা করা অংশটুকু পড়লে বোঝা যায় তিনি কার্যালয় বা দফতরে ব্যবহারের ভাষার কথা বলেছেন। কেননা তাঁর এ নির্দেশে অফিস-আদালত এক সঙ্গে উল্লেখ করলেও কোথাও তিনি বলেননি যে এখন থেকে বিচারকরাও এ নির্দেশ পালন করবেন। বরং লেখা আছে ‘বাঙালী কর্মচারীরা’ এবং অফিস-আদালতের ‘কর্তা ব্যক্তিগণ’। আফিস-আদালত শব্দগুচ্ছ বঙ্গবন্ধু ব্যবহার করেছেন হয়তোবা কথার একটি প্রচলিত ভঙ্গিমা হিসেবে। ১৯৭৫ এর ২৩ অক্টোবর একটি আদেশপত্রে বলা হয়, - ‘বাংলা রাষ্ট্রভাষা। পূর্বেই আদেশ দেওয়া হয়েছে যে, সরকারী নথি এবং চিঠিপত্র বাংলায় লেখা হবে। এই আদেশ দেওয়া সত্ত্বেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কোন কোন সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধা-সরকারী দফতরসমূহে এখন পর্যন্ত ইংরেজীতে নথি এবং চিঠিপত্র লেখা হচ্ছে। ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের এই প্রবণতা অনভিপ্রেত। অতএব পুনরায় এই মর্মে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে যে, সকল সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং আধাসরকারী দফতরে বাংলায় নথি ও চিঠিপত্র লেখা হবে। বিদেশের কোনও সরকার বা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনে বাংলার সঙ্গে অনুমোদিত ইংরেজী বা সংশ্লিষ্ট ভাষায় প্রতিলিপি ব্যবহার চলবে। তবে কোন বিদেশী সরকার বা সংস্থার সঙ্গে পত্র যোগাযোগ ইংরেজীতে করা যাবে।’ বহুবার অনেক আদেশ নির্দেশ জারির মাধ্যমে সরকারী কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের তাগিদ দিয়ে অনেক পরিপত্র সরকারী কার্যালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে। তবে অবাক হই যখন দেখি যে, সরকারী কার্যালয়গুলোতে বাংলা ব্যবহারের জন্য ১৯৭৯ এর ১২ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে যে আদেশটি জারি হয় সেটি ছিল ইংরেজী ভাষায়। আদেশটি ছিল নিম্নরূপ : Ô(a) the Bengali language is an integral part of our nationalism and was a key element in our struggle for independence. The failure to use and apply the language at all levels of national life is a sad commentary in our declared intentions and sincerity. All work and files concerning the cabinet and ministries may be conducted in Bengali from now onwards. Report on command over the mother tongue should be made a part of the ACR of each officer. (b) Stress should laid on preparing the coming generation from there very elementary school-level for application and use of Bengali in all activities of life and living. A responsible committee may be formed to ensure preparation of text books in simple and lucid Bengali, rather than the difficult language in which many school text books have been written. Imposing the use of the language from the top will not bear fruit unless adequate preparation is made at the base level. (c) The report of the national Education committee is being awaited pending receipt of which no further committee should be set up. A number of steps have been taken to expand the use of Bengali in practical life. Instructions at college and university level are being given usually in Bengali and the students have an option to appear in the exemption in English also. In the armed services and police, the word of command has been changed into Bengali. The PSC may conduct the examination in Bengali which will influence the university and the officers to adopt wider use of Bengali. The departmental examinations and the in-service training programmers of Govt, employees may also be conducted in Bengali. With sincerity of purpose, it will not be difficult to use Bengali at all official levels. The language itself will develop and grow in quality with practice. The language must rid itself of the grip of the ‘pundits’ and must reach for the people. That is why it can be made simple effective and progressive.” (সূত্র ঃ ঐ-পৃষ্ঠা-16-17) ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানের ৩নং অনুচ্ছেদের বিধানকে পূর্ণরূপে কার্যকর করার উদ্দেশ্যে ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’ প্রণীত হয়। এতে বলা হয়- (১) এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সকল ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্য অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে; (২) কোন সরকারী অফিস, আদালত, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কোনও কর্মস্থলের কোন ব্যক্তি বাংলা ভাষা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তা হলে তা বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে; (৩) যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন, তা হলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তার বিরুদ্ধে সরকারী কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে; এবং (৪) সরকার সরকারী গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দ্বারা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করতে পারবে। চলবে... লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২
×