ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রেকর্ডময় দ্বিশতকে মুশফিকের ফেরা

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রেকর্ডময় দ্বিশতকে মুশফিকের ফেরা

মোঃ মামুন রশীদ ॥ বীরদর্পে ফিরে আসা একেই বলে! জাতীয় দলের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন নান্নু বলেছিলেন, নিজেকে প্রমাণ করেই টেস্ট দলে ফিরতে হবে মুশফিকুর রহীমকে। টেস্টে সর্বশেষ ১০ ইনিংসে মাত্র দুই ফিফটি পাওয়ার পর তাকে নিয়ে এমনটা বলতেই পারে যে কেউ! আর যেহেতু পাকিস্তান সফরে মাঝে এক টেস্ট খেলেননি মুশফিক! তাই ঘরোয়া প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে সক্ষমতা প্রমাণ করেই জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে নামেন। ব্যাট হাতে অনেক রেকর্ডের পাতা ওলট-পালট করে মোক্ষম জবাবও দিলেন। ক্যারিয়ারের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকালেন। ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক মহাতারকাকে ছাড়িয়ে স্পর্শ করেছেন আরও বড় তারকাদের রেকর্ড। ৩টি করে ডাবল সেঞ্চুরি স্যার ভিভ রিচার্ডস, সনাথ জয়াসুরিয়া, ক্রিস গেইল, গ্যারি কার্স্টেনদের আছে। এ তালিকায় মুশফিকের পেছনে পড়ে গেছেন স্যার গ্যারি সোবার্স, গ্রাহাম গুচ, ভিভিএস লক্ষণ, ইনজামাম-উল-হক, হানিফ মোহাম্মদের মতো মহা তারকাদের। এদিন অপরাজিত ২০৩ রান করার পথে তিনি এখন টেস্ট ক্রিকেটে দেশের পক্ষে সর্বাধিক রানের মালিক হয়েছেন তামিম ইকবালকে পেছনে ফেলে। উইকেটকিপিং ছাড়ার পর প্রথম শতক, ক্যারিয়ারের সপ্তম শতকে তিনি পেছনে ফেলেছেন মোহাম্মদ আশরাফুলকে (৬ সেঞ্চুরি)। গড়েছেন আরও নানা রেকর্ড। বাংলাদেশ দলের সঙ্গে সঙ্গে ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ মুশফিকের ব্যাটেও যেন ব্যর্থতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছিল। মাঝে হ্যামস্ট্রিং ইনজুরির কারণে প্রথম শ্রেণীর ঘরোয়া আসর বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগেও (বিসিএল) প্রথম রাউন্ড খেলেননি। সবমিলিয়ে বাংলাদেশ দলের নির্বাচকরা অসন্তোষ নিয়েই বলেছিলেন, আবার টেস্ট দলে ফিরতে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে মুশফিককে! কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোও জানিয়েছিলেন মাঝে হুট করে এক টেস্টের জন্য সমন্বয়ে পরিবর্তন আনা কষ্টকর। সম্প্রতিই পাকিস্তান সফরে যাননি নিরাপত্তা শঙ্কায়, খেলা হয়নি রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে। সে কারণেই মুশফিকের ওপর বিরক্তি নিয়ে তারা এমন মন্তব্য করেছিলে। আর মুশফিক হয়তো মনে মনে করেছিলেন ‘পণ’। অথচ সর্বশেষ ভারত সফরেই দুই টেস্টে অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন তিনি, যেখানে পুরো দলের অবস্থা ছিল বিভীষিকাময়। তবু বিসিএলে খেলতে নেমে ১৪০ রানের ইনিংস উপহার দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন। ফিটনেসের প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটিং দক্ষতার আরেকবার দৃষ্টান্ত। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তাই ফেরেন তিনি। রবিবার ম্যাচের প্রথম দিন মাত্র ৩২ রানে অপরাজিত ছিলেন। ততক্ষণে অধিনায়ক মুমিনুল হকের সঙ্গে তার চতুর্থ উইকেটে জুটি দাঁড়িয়েছিল ৬৮ রানের। তৃতীয় দিন তারা সেই জুটিকে বাড়িয়ে করেছেন ২২২ রানের। তারা ব্যাট করেছেন চা বিরতির সোয়া এক ঘণ্টা আগ পর্যন্ত। এর আগে চতুর্থ উইকেটে টেস্টে বাংলাদেশের সেরা জুটি ছিল ২৬৬ রানের। সেটিও মুশফিক-মুমিনুল করেছিলেন জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষেই ২০১৮ সালের নবেম্বরে মিরপুরেই। মুমিনুল সাজঘরে ফেরার সময় মুশফিকের রান ছিল ১২৭। মাত্র ১৬০ বলে ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরি পাওয়ার পর দ্রুতবেগে ব্যাট চালিয়েছেন তিনি। আর তাতেই ক্যারিয়ারের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরির দিকে এগিয়ে যান মুশফিক। ২০১৮ সালে মিরপুরে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে অপরাজিত ২১৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন, তারপর আর কোন সেঞ্চুরির দেখা পাননি মুশফিক। মাঝের ১০ ইনিংসে মাত্র দুটি অর্ধশতক পেয়েছিলেন। এবার সেই জিম্বাবুইয়েকে পেয়েই যেন নিজেকে স্বরূপে আবির্ভূত করলেন। মোহাম্মদ মিঠুনের সঙ্গে পঞ্চম উইকেটে মাত্র ২৭ এবং ষষ্ঠ উইকেটে লিটনের সঙ্গে এরপর ১১১ রানের জুটি গড়েন তিনি। ততক্ষণে ডাবল সেঞ্চুরির কাছে চলে গেছেন মুশফিক। লিটন অবশ্য তার আগেই আউট হয়ে যান। এরপর তাইজুল ইসলাম উইকেটে যোগ দিলে তাকে নিয়েই ক্যারিয়ারের তৃতীয় ডাবল সেঞ্চুরি আদায় করে নেন মুশফিক। সেজন্য তাকে ৩১৫ বল ও ৪৩৪ মিনিট ব্যাট করতে হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরই ইনিংস ঘোষণা করে দেয় বাংলাদেশ। দেশের পক্ষে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিটি শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে গল টেস্টে হাঁকিয়েছিলেন। এরপর জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ২০১৮ সালে মিরপুরে অপরাজিত ২১৯ রানের যে ইনিংস খেলেছিলেন তা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। এখন আবার মিরপুরেই খেললেন একই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আরেকটি ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস। মুশফিক অপরাজিত থাকেন ৩১৮ বলে ২৮ চারে ২০৩ রানে। বাংলাদেশের পক্ষে এটি টেস্টে পঞ্চম ডাবল সেঞ্চুরি। মুশফিকের ৩টি ছাড়াও আছে সাকিবের ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৭ সালে ২১৭ এবং খুলনায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ২০১৫ সালে তামিমের ২০৬। টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৩টি করে ডাবল সেঞ্চুরি আছে ভিভ রিচার্ডস, কার্স্টেন, জয়াসুরিয়া, স্টিফেন ফ্লেমিং, গেইল ও স্টিভেন স্মিথসহ অনেকেরই। তাদের রেকর্ড স্পর্শ করার পথে মুশফিক পেছনে ফেলেছেন হানিফ মোহাম্মদ, সোবার্স, ইনজামাম, এবি ডি ভিলিয়ার্স, ভিভিএস লক্ষণ, ভিনু মানকড়, গুচ, মার্চ টেইলর, মাইক আথারটন, ম্যাথু হেইডেনসহ অনেক বড় তারকাদেরই। তাদের টেস্ট ক্যারিয়ারে আছে ২টি করে ডাবল সেঞ্চুরি। উইকেটকিপিং ছাড়ার পর প্রথম সেঞ্চুরি করেছেন এবার মুশফিক। টেস্ট রানে ছাড়িয়ে গেছেন তামিমকে, সেঞ্চুরি সংখ্যায় আশরাফুলকে। আশরাফুলের টেস্ট শতক ছিল ৬টি। এখন মুশফিকের ৭। তার ওপরে আছেন তামিম ও মুমিনুল ৯টি করে শতক হাঁকিয়ে। আর এর মাধ্যমে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক রানের মালিক হয়ে গেছেন তিনি। ৭০ টেস্টের ১৩০ ইনিংসে মুশফিকের রান এখন ৪৪১৩। তার পেছনে পড়া তামিমের রান ৬০ টেস্টের ১১৫ ইনিংসে ৪৪০৫। এছাড়া তিন ফরমেটের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রানের দিক থেকে মুশফিক ছাড়িয়ে গেছেন সাকিবকে। তিন ফরমেটে মোট ৩৩৮ ম্যাচ খেলে সাকিবের রান ১১ হাজার ৭৫২। আর ৩৭০ ম্যাচ খেলে মুশফিকের রান ১১ হাজার ৭৭৮। এখন তার অবস্থান এক্ষেত্রে দ্বিতীয়। সবচেয়ে বেশি তামিমের- ৩৩৭ ম্যাচে ১২ হাজার ৯৫৭। তিন ফরমেটে সেঞ্চুরি সংখ্যায়ও সাকিবকে ছুঁয়েছেন মুশফিক। উভয়ের মোট আন্তর্জাতিক শতক ১৪টি। এক্ষেত্রে তামিম শীর্ষে ২১ শতক হাঁকিয়ে। তবে মিরপুরে তামিমের রানকে পেছনে ফেলেছেন মুশফিক। তামিমের রান মিরপুরে ১৭ টেস্টে ১১৬৬। মুশফিকের এখন ১৯ টেস্টে ১১৮১। ১৭ টেস্টে ১৩১৩ রান করে সবার ওপরে সাকিব। একইসঙ্গে অধিনায়ক, উইকেটকিপার এবং দলের অপরিহার্য ব্যাটসম্যান- এমন চাপের কারণে তাকে প্রথমে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপর পুরোপুরি ছেড়েছেন উইকেটকিপিংও। অথচ এক্ষেত্রে চমকপ্রদ একটি তথ্য আছে। ক্যারিয়ারে যে ৭ শতক হাঁকালেন মুশফিক তার মধ্যে অধিনায়ক হিসেবেই ৪টি। সেই ৪ সেঞ্চুরি আবার দেশের বাইরে হাঁকিয়েছেন। অধিনায়কত্ব না করে বাকি যে ৩টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন সবই দেশের মাটিতে। মিরপুর টেস্টে যা করলেন তাতে হয়তো নিজেকে প্রমাণ করার আর কিছুই বাকি থাকল না ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ খ্যাত এই ব্যাটসম্যানের।
×