ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পেস বোলিংয়ে নতুন কান্ডারি রাহী!

প্রকাশিত: ১১:৩৪, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 পেস বোলিংয়ে নতুন কান্ডারি রাহী!

মোঃ মামুন রশীদ ॥ রাসেল ডোমিঙ্গো এমনটাই প্রত্যাশা করেছিলেন। তিনি চেয়েছেন দেশের মাটিতে টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের খেলার সংস্কৃতি পাল্টে ফেলতে। তার ইচ্ছা দলে পেস বোলারদের আরও বেশি সুযোগ দেয়া। জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে নামার আগেই বাংলাদেশের প্রধান কোচ জানিয়েছিলেন, শুধু স্পিননির্ভর দল গড়ে সফল না হয়ে পেসারদেরও যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। তাহলেই দেশে বা দেশের বাইরে সবখানে বোলিংয়ে উন্নতি করা সম্ভব হবে দলের জন্য। এ জন্য জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে মিরপুর টেস্টে তিনি দু’জন পেসার নিয়ে নামার কথা জানিয়েছিলেন। পেসারদের কাছে যে প্রত্যাশা করেছিলেন ডোমিঙ্গো তা পূরণ করেছেন আবু জায়েদ রাহী। ক্যারিয়ারসেরা বোলিং করে তুলে নিয়েছেন ৪ উইকেট। প্রায় ৩ বছর পর দেশের মাটিতে এটাই বাংলাদেশী কোন পেসারের সেরা বোলিং নৈপুণ্য। আরেক পেসার এবাদত হোসেন চৌধুরী উইকেট তুলে নিতে না পারলেও দুর্দান্ত বোলিং করে জিম্বাবুইয়ে ব্যাটসম্যানদের রান নেয়াটা কষ্টকর করে তুলেছেন। ডোমিঙ্গো তার পরিকল্পনায় আপাতত সফলই হয়েছেন। আর রাহী ৭১ রানে ৪ উইকেট শিকার করে দেশের পেস বোলিংয়ে নতুন আশার আলো হয়ে উঠেছেন। ঘরের মাটিতে টেস্ট খেলতে নামলেই সাধারণ স্পিনবান্ধব উইকেট গড়ে প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করে বাংলাদেশ দল। সফরকারী দল যেই হোক না কেন স্পিননির্ভর একাদশ গড়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করেছে স্বাগতিকরা। দলগত সাফল্য তুলে আনতে তাই একাদশে বরাবরই একজন করে পেসার নিয়ে খেলেছে বাংলাদেশ। ফর্মুলাটা সুফল বয়ে আনতে পারলেও সর্বশেষ গত বছর নবীন টেস্ট খেলুড়ে দেশ আফগানিস্তানের বিপক্ষে বুমেরাং হয়ে ওঠে। কোন পেস বোলার না নিয়ে ৪ স্পিনারকে নিয়ে একাদশ সাজিয়েছিল বাংলাদেশ। ফলশ্রুতিতে হার দেখতে হয়েছে। তবে ঘূর্ণি আক্রমণে এমনকি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মতো দলগুলোকেও ঘায়েল করতে পেরেছে বাংলাদেশ দল। কোন কোন ক্ষেত্রে স্পিননির্ভর একাদশ গড়ে প্রতিপক্ষকে বধ করার বিষয়ে দ্বিমত করেননি ডোমিঙ্গো। কিন্তু এমনটা করতে গিয়ে উপমহাদেশের বাইরে গিয়ে আর এই স্পিনারদের ওপরেই শুধু ভরসা করা যায়নি। কারণ পেসনির্ভর বাউন্সি উইকেটে অবশ্যই পেসার খেলাতে হয়েছে। তখন ভালমানের ও পরীক্ষিত পেসার খেলাতে গিয়ে উপযুক্ত কাউকে খুঁজে পেতে সমস্যায় ভুগেছে টিম ম্যানেজমেন্ট। সে কারণে নির্দিষ্টভাবে দীর্ঘ সময় কোন পেসারের ওপর আস্থা রাখতে পারেনি বাংলাদেশ দল। ঘরের মাটিতে ৬৩ টেস্টে সবমিলিয়ে ৪১ স্পিনার খেলে ৫৬৯ উইকেট এনে দিয়েছেন। সেখানে মাত্র ৩৩ পেসার খেলে উইকেট নিতে পেরেছেন ২০৭টি। তবে ঘরের বাইরে স্পিনারদের দাপট থাকেনি। বিদেশের মাটিতে ৫৬ টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ দল। ৩৮ জন স্পিনার এই টেস্টগুলো খেলে ২৪৬ উইকেট পেয়েছেন, আর ৩৪ জন পেসার মিলে নিয়েছেন ২৮৪ উইকেট। গত ৫ বছরে টেস্ট দলে ১৪ জন পেসারের যাওয়া-আসার মধ্য দিয়েই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সময়ে ৩১ টেস্টে বাংলাদেশের হয়ে খেলা ১৪ পেসার শিকার করেছেন মাত্র ১০০ উইকেট। তাই ঘরের মাটিতেও স্পিননির্ভর একাদশ গড়ার সংস্কৃতি পাল্টানোর তাগিদ দিয়েছেন ডোমিঙ্গো যেন দেশের বাইরে গিয়ে পেসার সঙ্কটে ভুগতে না হয়। তিনি মিরপুর টেস্ট শুরুর আগে সংবাদ সম্মেলনে এমনকি জানিয়েছিলেন, ৭ নম্বরে ব্যাট করতে পারবেন এবং পেস বোলিংয়েও ভাল এমন কেউ থাকলে ৩ পেসার নিয়েই জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে একাদশ সাজাতেন। ডোমিঙ্গো বলেন, ‘টেস্টে বাংলাদেশের উন্নতির জন্য আমরা সবসমই ঘূর্ণি বোলারদের নিয়ে এগোতে পারব না। আমরা একজন সিমার নিলাম এবং তারপর ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়া গেলাম, তখন বুঝতেই পারব না কোন তিনজন সিমার আমরা খেলাব। কারণ আমরা তো তাদের কোন উইকেটে খেলাইনি। যখন আপনি নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলের বিপক্ষে খেলবেন তখন নির্দিষ্টভাবেই আমরা জানি যে আমাদের দলের মূলশক্তি হচ্ছে স্পিনিং উইকেটে খেলা। কিন্তু আমাদের অবশ্যই ভাল উইকেটগুলোয় খেলা শিখতে হবে, যেন আমাদের সিমাররাও খেলায় ভালভাবে নিজেদের অবস্থানটা নিশ্চিত করতে পারে।’ ডোমিঙ্গো যে চিন্তা নিয়ে দুই পেসার খেলিয়েছেন জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে তাতে সফলতা এসেছে। প্রথমদিনই রাহী ও এবাদত দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। রাহী দুই উইকেট তুলে নেন, এবাদত উইকেট শিকার করতে না পারলেও দুর্দান্ত বোলিং করেছেন। দ্বিতীয়দিনের শুরুতেই রাহী ২ উইকেট তুলে নিয়ে জিম্বাবুইয়ের প্রথম ইনিংসটা বড় হতে দেননি। দীর্ঘ সময় বোলিং করার সক্ষমতাও দেখিয়েছেন দু’জন। টানা কয়েক টেস্টেই তারা দু’জন জুটিবদ্ধ হয়ে খেলছেন। সাফল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে রাহী অনেক এগিয়ে। নিজের টেস্ট খেলার যোগ্যতা ইতোমধ্যেই প্রমাণ করেছেন তিনি। একই সঙ্গে ইনসুইং ও আউট সুইংয়ের দক্ষতায় রাহী দারুণ সফল, আর টানা মিতব্যয়ী বোলিং করা এবং গতির জন্য তারচেয়ে এগিয়ে এবাদত। মিরপুর টেস্টের দলে ছিলেন গতিময় পেসার তাসকিন আহমেদ, বাঁহাতি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান এবং উদীয়মান গতি তারকা হাসান মাহমুদ। কিন্তু ডোমিঙ্গো আস্থা রেখেছেন রাহী ও এবাদতের ওপর। কারণ টানা একসঙ্গে খেললে উন্নতিটা নিশ্চিত। রাহীর নৈপুণ্যের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পর রাহী দেশের বাইরেই খেলেছেন বেশি। ক্যারিয়ারের প্রথম ৪ টেস্টের ৬ ইনিংসে মাত্র ৮ উইকেট পাওয়া রাহী এবার জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে দেশের মাটিতে দ্বিতীয়বার টেস্ট খেলতে নামেন। তাদের বিপক্ষেই ২০১৮ সালে সিলেট টেস্ট খেলে কোন উইকেট নিতে পারেননি তিনি। তবে ক্যারিয়ারের পরবর্তী ৪ টেস্টের মাত্র ৪ ইনিংস বোলিং করা রাহী নিয়েছেন ১২ উইকেট। এর মধ্যে ভারতের বিপক্ষে গত বছর ইন্দোর টেস্টে ১০৮ রানে ৪ উইকেট নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন রাহী। সেটিই ছিল তার সেরা বোলিং, এবার ৭১ রানে ৪ উইকেট নিয়ে নিজের সেরা পারফর্মেন্সকে পেছনে ফেলেছেন। দেশের মাটিতে বাংলাদেশী পেসারদের মধ্যে শাহাদাত হোসেন রাজীবের বোলিং নৈপুণ্য সেরা। তিনি ২০০৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মিরপুরে নিয়েছিলেন ২৭ রানে ৬ উইকেট। এক ইনিংসে পেসারদের সেরা বোলিংয়ের বাকি দুটি নজিরও শাহাদাতের। ২০০৬ সালে বগুড়ায় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৮৬ রানে ৫ এবং ২০১০ সালে ভারতের বিপক্ষে চট্টগ্রামে ৭১ রানে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন। আর কোন বাংলাদেশী পেসার দেশের মাটিতে টেস্টের এক ইনিংসে ৫ উইকেট নিতে পারেননি। তবে ৮ বার ইনিংসে ৪ উইকেট নেয়ার রেকর্ড ছিল যার সর্বশেষটি দেখা গেছে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে মুস্তাফিজের ৮৪ রানে নেয়া ৪ উইকেট। এবার রাহীর সুযোগ ছিল দেশের মাটিতে ১০ বছর পর ইনিংসে ৫ উইকেট নেয়ার, সেটি না পারলেও প্রায় ৩ বছর পর দেশের মাটিতে কোন পেসার হিসেবে ইনিংসে ৪ উইকেট নিয়েছেন তিনি। সবমিলিয়ে সর্বশেষ ৫ ইনিংসে ১৬ উইকেট। এই সময় রাহী ইনিংস প্রতি সবমিলিয়ে বোলিং করেছেন ২৩.৫ ওভার করে। আর সে কারণেই দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের পেস বোলিংয়ে আশার আলো হয়ে উঠেছেন ২৬ বছর বয়সী এ ডানহাতি পেসার।
×