ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

নাজমুল মৃধা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ আবির উচ্ছ্বাসে রঙিন সমাপ্তি

প্রকাশিত: ১২:৪৮, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ॥ আবির উচ্ছ্বাসে রঙিন সমাপ্তি

কবিগুরু তাঁর কবিতায় বলেছেন- ‘যাবার দিনে এই কথাটি বলে যেন যাই, যা দেখেছি, যা পেয়েছি তুলনা তার নাই।’ যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছেন এবং ক্যাম্পাসকে ভালবেসেছেন তাদের চেয়ে বেশি এই কথার তাৎপর্য অন্য কেউ বুঝবে না। বিশ্ববিদ্যালয় হলো বৃন্দাবন! এখানে মধু এবং বিষ দুটোই আহরণ করা যায়। তবে এখানে মধুর আধিক্যই বেশি। বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেক, ঐক্য, আনন্দ, উচ্ছ্বাস, সাফল্যসিঁড়ি এসব যেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গর্ভজাত সন্তান। এই কয়েকটি শব্দের বাস্তব রূপকে তখনই উপলব্ধি করা যায় যখন ক্যাম্পাস ছেড়ে যাবার সময় হয়। বিদায় বেলায় পেছনে ফেলে আসা সুন্দর মুহূর্তগুলো বারবার হৃদয়ে ধাক্কা দেয়- কথায় আছে বর্তমানের দুঃখের চেয়ে অতীতের সুখগুলোই মানুষকে বেশি আক্রান্ত করে! জীবন সুন্দর, তার চেয়ে বেশি সুন্দর হয়তো বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বে কি না থাকে? প্রেম, ভালবাসা, বিশ্বাস, আস্থা, আনন্দ, বেদনা, সাহায্যসিঁড়ি সবকিছুই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের ৬১তম আবর্তনের শিক্ষার্থীদের ভাবনাটাও তেমনই। তাদের ব্যাচের নাম উদ্দীপ্ত-৬১। গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গছে তাদের। বিদায় তাদের হাতের নাগালে। স্নাতকোত্তর শেষ হলেই যাবার সময় হয়ে যাবে। স্নাতক পরবর্তী তাই আনন্দ র‌্যালি হয়ে গেছে জমজমাট আয়োজনের মাধ্যমে। চারবছরের সমস্ত বিশ্বাস এবং আনন্দের বহির্প্রকাশ যেন এই র‌্যালি। র‌্যালিতে যতটা আনন্দ ছিল ততটা ছিল বিদায়ের আতঙ্ক। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি যে ক্যাম্পাসে তারা এসেছিল কাঁচা দেহে আকাশছোঁয়া স্বপ্ন নিয়ে কে জানত সেদিন শেষ হতে বেশিদিন লাগবে না! মনে হচ্ছে যেন এইতো সেদিন এলাম। হৈ হুল্লুর আর আনন্দে কেটে গিয়েছে চারটি বছর। এর মধ্যে কতকিছু ঘটে গিয়েছে। দীর্ঘ পাঁচ বছরের ভালবাসার সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক বিদায় দিতে তারা নানা আয়োজন করলেও সেখানে ছিল সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার শূন্যতা। ছিল আপন রক্তের না হয়েও রক্তবন্ধন ভালবাসার বিচ্ছেদের জ্বালা। হবেই না বা কেন? বিভাগের বান্ধবীদের সঙ্গে একই ছাদের নিচে থেকে জমেছে কত স্মৃতি। একরাশ হাসি, আড্ডা, তামাশা, মান-অভিমান ছিল চার বছরের আবেগ আর ভালবাসা। বিদায় উপলক্ষে তারা ক্যাম্পাসে ভ্যানগাড়িতে সাউন্ড বক্স বাজিয়ে আবির মাখামাখি করছিল হয়তো। কিন্তু মনের কোণে কী এক শূন্যতা বার বার তাদের ধাক্কা দিচ্ছিল। একই ব্যাচের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমানের পা সেদিন পিচঢালা রাস্তায় বার বার আটকে যাচ্ছিল। তার মতো হয়তো আরও অনেকের। কে জানে হয়তো তারা ভিতরে ভিতরে ডুকরে কেঁদেছে তখন। তাদের মনে হচ্ছিল ক্যাম্পাস থেকে তাদের বিদায় যেন গাছের সবুজ পাতার ধূসরতায় সিক্ত। বিদায় মলিনতায় ধূসর পাতার মতো হয়ে উঠছিল মন। অনুভূতিটা কেমন খর্ব হয়ে যাবে। আর যাদের সঙ্গে দেখাও হবে না কথাও হবে নাÑ তারা কেমন থাকবে? কেউ কেউ হয়তো অনেক ভাল থাকবে, কেউবা মন্দ। আবার কেউবা রাতের আকাশের তারা হয়ে মিটমিট করে জ্বলবে। নষ্টালজিক এই জীবনে কেউ হয়তো কারোর কথা ভাববে না কিন্তু বয়সের ভারে সবাই যেদিন দূরে ঠেলে দিবে সেদিন হয়তো দুরন্ত যৌবনের এসব স্মৃতিই হবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের রূপকথার গল্পকাহিনী। এমন ভাবনাই ভাবছিল বাংলা বিভাগের ২০১৫-১৬ সেশনের শিক্ষার্থীরা। উদ্দীপ্ত-৬১ ব্যাচের এসব আয়োজনে ছিল জমজমাট র‌্যালি, ফ্লাশমোভ, ফটো সেশন, রং খেলা, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা এবং নৈশভোজ। এসব আয়োজনকে আরও রঙিন করে তুলেন নৈশভোজে অতিথি হয়ে আসা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি প্রফেসর ড. সরকার সুজিত কুমার, সহযোগী অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খানম, সহকারী অধ্যাপক তানিয়া তহমিনা সরকার, মাহমুদা আকতার, মনোরমা ইসলাম প্রমুখ। সেদিন আনুষ্ঠানিক নৈশভোজের পর সবাই ভাবছিল হয়তো ক্লাসের সবাই আর এভাবে সুট-বুট, শাড়ি পরে আর একত্রিত হওয়া যাবে না। সজল নয়নে ভাসছিল রঙিন ভুবন পেছনে ফেলার ব্যাকুলতা। আলোর ভুবন থেকে এক চিলতে আলো নিয়ে অন্ধকারে আলো জ্বালাবার অনিশ্চিত মশাল হাতে ছড়িয়ে পড়া। কে জানে কতটুকু আলো তারা দিতে পারবে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে। কঠিন, তবুও তারা জানে অতীতকে পেছনে ফেলেই চলতে হবে সামনে।
×