ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মিঠুনের লড়াকু অর্ধশতক

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০

 মিঠুনের লড়াকু অর্ধশতক

মোঃ মামুন রশীদ ॥ পাকিস্তানের মাটিতে দীর্ঘ ১৭ বছর পর টেস্ট খেলতে নামার আগে শঙ্কা ছিল বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং নিয়ে। কারণ, রাওয়ালপিন্ডিতে খেলতে নামার আগে সেখানে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেনি সফরকারীরা। তাই দলের প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গোও এটিকে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য আদর্শ নয় বলে দাবি করেছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে দলের ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিকুর রহীম এবং সাকিব আল হাসানও দলে অনুপস্থিত। স্বাগতিকদের বিপক্ষে তাই ব্যাটিং নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। সেটি সত্য হয়েছে, প্রথম দিনেই চরম বিপর্যয় ঘটেছে বাংলাদেশ দলের। বড় কোন স্কোর গড়তে পারেনি কোন ব্যাটসম্যান। ব্যতিক্রম ছিলেন মোহাম্মদ মিঠুন, তিনি ৬ নম্বরে নেমে অর্ধশতক হাঁকান। ৬৩ রানের লড়াকু ইনিংস খেলে সাজঘরে ফেরার আগে ১৪০ বল খেলেছেন এবং দলের রানকেও নিয়ে গেছেন দু’শ পেরিয়ে। ক্যারিয়ারের সবেমাত্র দ্বিতীয় টেস্ট ফিফটি এটি তার। বর্তমান দলের ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনিই পাকিস্তানের মাটিতে প্রথম অর্ধশতকের দেখা পেলেন। ২০০৩ সালে সর্বশেষবার পাকিস্তানের মাটিতে টেস্ট খেলেছে বাংলাদেশ দল। সেবার ৩ টেস্টের সিরিজ খেলে সফরকারীরা খালেদ মাহমুদ সুজনের নেতৃত্বে। মুলতান টেস্টে প্রায় জয়ের কাছাকাছি গিয়ে শেষ পর্যন্ত হেরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু ১৭ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে আবার টেস্ট খেলতে নামার আগে সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাটুকু গড়ে তোলা নিয়েও ছিল সংশয়। কারণ দীর্ঘদিন পাকিস্তানে গিয়ে না খেলা এবং অপরিহার্য দুই ব্যাটসম্যান মুশফিক ও সাকিব দলে না থাকা। গত বছর ৫ টেস্ট খেলে সবই হেরেছে বাংলাদেশ। পরাজয় দেখতে হয়েছে নবীন টেস্ট খেলুড়ে দল আফগানিস্তানের বিপক্ষেও। আবার ভারত সফরে নবেম্বরে আরও বড় ভরাডুবি হয়েছে বাংলাদেশ দলের। দুই টেস্টেই তৃতীয় দিনে গিয়ে হেরেছে তারা। ব্যাটিংয়ে পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছেন ব্যাটসম্যানরা। তবে মুশফিক একাই কিছুটা ভাল খেলেছিলেন বরাবরের মতোই। সেই ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ ছিল এবার ব্যাটসম্যানদের। কিন্তু রাওয়ালপিন্ডিতে দলের ব্যাটিং স্তম্ভ মুশফিক নিজেই অনুপস্থিত। যদিও ভারতে না খেলা তামিম ইকবাল দলে ফিরেছেন এবং পাকিস্তানে যাওয়ার আগে ৩৩৪ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেছেন লঙ্গার ভার্সন বাংলাদেশ ক্রিকেট লীগে (বিসিএল)। তাই কিছুটা আশা ছিল হয়তো ভাল কিছু পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু মুশফিকের অভাবটা অধিনায়ক মুমিনুল হক সৌরভ নিজেই প্রকাশ করেছিলেন। সেই অভাবটা শুক্রবার টের পেয়েছে বাংলাদেশ দল। রাওয়ালপিন্ডিতে খেলতে নেমে তামিম (৩), অভিষেক হওয়া সাইফ হাসান (০) দ্রুতই সাজঘরে ফিরে যান। এরপর দলে ফেরা নাজমুল হোসেন শান্ত ও মুমিনুল প্রতিরোধ গড়েন ঠিকই, তবে তা ৫৯ রানের জুটি হওয়ার পর ভেঙ্গে যায়। মুমিনুল ৩০ রান করে বিদায় নেন। এরপরও শান্ত দীর্ঘ সময় টিকে ছিলেন। ব্যর্থতার মধ্যে তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ দল। কিন্তু তিনিও ৪৪ রান করার পর সাজঘরে ফেরেন। ৯৫ রানে শীর্ষ ৪ ব্যাটসম্যান আউট হয়ে যাওয়ার পর ক্রিজে আসেন মিঠুন। ক্যারিয়ারে আগের ৭ টেস্ট খেলে তেমন ভাল কিছু করতে পারেননি তিনি। ১৭.৫৩ গড়ে মাত্র ২২৮ রান করতে পেরেছিলেন একটিমাত্র অর্ধশতকে। মুশফিক দলে থাকলে হয়তো একাদশেই জায়গা পেতেন না। কিন্তু এদিন ৬ নম্বরে নেমে দারুণ ব্যাটিং করেছেন। প্রথমে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে মাত্র ২২ রানের জুটি হতেই তা ভেঙ্গে গেছে। দলীয় ১০৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে চরম বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ দল। পরে লিটন দাসের সঙ্গে দারুণ এক জুটি গড়ে দলের বিপর্যয় এড়াতে থাকেন মিঠুন। টানা ১৫ ওভার তারা জুটিবদ্ধ থেকে বিপদের মুখে আশার আলো হয়ে ওঠেন। কিন্তু ষষ্ঠ উইকেটে তাদের ৫৪ রানের জুটি ভেঙ্গে যায় লিটন ৩৩ রানে এলবিডব্লিউ হয়ে সাজঘরে ফেরার কারণে। তখন দলীয় রান মাত্র ১৬১! স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে শুধু মিঠুন একপ্রান্তে অপরাজিত। মূলত তিনি একাই লড়াই চালিয়েছেন এরপর। তবে তাকে দারুণ সঙ্গ দেন তাইজুল ইসলাম। স্বীকৃত ব্যাটসম্যান না হয়েও মিঠুনের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ৫৩ রানের গুরুত্বপূর্ণ একটি জুটি গড়ে তোলেন। আর এতেই বড় ধরনের বিপদ থেকে বেঁচে যায় বাংলাদেশ দল। দলীয় রান পেরিয়ে যায় দু’শ। তারা ৮০ বল মোকাবেলা করেছেন দু’জন মিলে। এতেই ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় অর্ধশতক পেয়ে যান মিঠুন। তিনি সেজন্য ১৩৭ বল খেলেন। তাইজুল ৭২ বলে ২৪ রান করার কারণেই মিঠুন অর্ধশতকটি পেয়েছেন। আর দলের জন্যও তা সুফল বয়ে এনেছে। প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ দলের একমাত্র হাফসেঞ্চুরিয়ান হওয়ার কারণে মিঠুনের এই অর্ধশতকটিই জ্বলজ্বল করে জ্বলেছে। শেষ পর্যন্ত মিঠুনও ১৪০ বলে ৭ চার, ১ ছক্কায় ৬৩ রানে তরুণ পেসার নাসিম শাহের শিকার হন। আর শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। এর আগে ৬৭ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন মিঠুন ২০১৮ সালে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে মিরপুরে অভিষেক টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে। এরপর ৬ টেস্ট ও ১১ ইনিংসে তার সেরা ব্যাটিং নৈপুণ্য ছিল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গত বছর মার্চে ওয়েলিংটনে ৪৭ রানের ইনিংস। এছাড়া বাকি ১০ ইনিংসে এমনকি ৩০ রানও করতে পারেননি তিনি। দলের এমন ভরাডুবির পেছনে কারণও ছিল। রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে নামার আগে পাকিস্তানের পরিবেশে নিজেদের খাপ খাওয়াতে কোন প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ পায়নি বাংলাদেশ দল। ভারতের বিপক্ষে দুই টেস্টে হেরে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করে বাংলাদেশ কোন প্রস্তুতি ম্যাচ ছাড়াই খেলতে নেমে। এ বিষয়ে ডোমিঙ্গোর আক্ষেপ ছিল, ‘এটা আদর্শ কিছু হতে পারে না। কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে টেস্ট খেলার অন্তত সাত-আট দিন আগে সফরে যাওয়া উচিত। প্রস্তুতি ম্যাচ খেলা, দুইদিন অনুশীলনের সুযোগ। সাধারণত এটাই আদর্শ টেস্টের আগে।’ রাওয়ালপিন্ডিতে টেস্ট খেলতে মঙ্গলবার রাতে পাকিস্তানের উদ্দেশে দেশ ছাড়ে বাংলাদেশ দল। বুধবার সকালে পাকিস্তানে পৌঁছে বৃহস্পতিবার মাত্র একটা দিনই অনুশীলন করে সফরকারীরা। আর শুক্রবারই টেস্ট খেলতে নেমে যায় বাংলাদেশ। ডোমিঙ্গো তাই বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানে গিয়ে কিছুটা অনুশীলন করেই টেস্ট খেলতে নেমে পড়তে হবে। আমরা বুধবার সকালে পাকিস্তান পৌঁছাব, বৃহস্পতিবার অনুশীলন, শুক্রবার ম্যাচ। এটা আসলে ভাল প্রস্তুতি হতে পারে না।’ সেই প্রস্তুতি ঘাটতিই দেখা গেল প্রথম দিন। মিঠুন ছাড়া আর কেউ সফল হতে পারলেন না।
×