ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাহাত রাব্বানী

অনুভূতির অবগাহনে

প্রকাশিত: ১২:১৬, ৩১ জানুয়ারি ২০২০

অনুভূতির অবগাহনে

‘সবাই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’ বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। কে কবি, কে অকবি তা সময়ই বলে দেয়। আমাদের এই সময়টা সাহিত্যের জন্য বড্ড বেশি অস্থির। অনেকটা অনুৎপাদনেরও। পঞ্চাশ, ষাটের দশকে বাংলা কবিতা হয়েছে সবচেয়ে বেশি আলোচনার, সবচেয়ে বেশি সমৃদ্ধ। এই সময়ে যাঁরা বাংলা কবিতাকে এগিয়ে নিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন আমরা শেষ পর্যন্ত তাঁদেরই মনে রাখি। এই সময়কালে আমরা পেয়েছি শহীদ কাদরী, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, হেলাল হাফিজ, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো শক্তিশালী কবিদের। এরপরের সময়গুলো বাংলা কাব্যসাহিত্য হয়ে ওঠে অনেকটা রসকষহীন। এই সময়গুলোতে কাব্যসাহিত্যে অনেক তরুণ প্রাণের পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেলেও, শেষ অবধি তাদের অনেককেই নেতৃত্ব দেয়ার এই জায়গায় পাওয়া যায়নি। প্রযুক্তিবান্ধব এই সময়ে লেখালেখির পরিমাণ বাড়লেও উৎকর্ষতায় বাড়েনি। ঝরে গেছেন অনেকেই। কেউ কেউ টিকে আছেন। নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই কেউ কেউ আমাদের নিরাশায় নিমজ্জিত হতে দিচ্ছেন না। হতাশ করছেন না। তাদের মধ্যে আলফ্রেড খোকন অগ্রগণ্য। জীবনানন্দের ভাষায় কবি। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে নিজস্ব ভঙ্গিমায় কবিতা করেছেন তিনি। নব্বইয়ের শুরু থেকেই রসকষহীন কবিতায় তিনি প্রাণ দিয়েছেন। কবিতা বিমুখ পাঠককে করেছেন কবিতার সমঝদার। তার কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতি, মানুষের নানাবিধ চিন্তাভাবনা, প্রেম-বিরহ, রোমান্টিকতা, অনুভূতির মিশ্রণ। সমকাল কিংবা ইতিহাস, ঐতিহ্য প্রকাশে গভীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন কবি আলফ্রেড খোকন। আলফ্রেড খোকন অনুভূতির অবগাহনে লাভ করেন ঐশ্বরিক তৃপ্তি। তার সমসাময়িক কবিরা যখন কবিতায় কেবল আবেগের কথা বলেন, তখন আলফ্রেড খোকন সমাজ, বাস্তবতা, অনুভূতিকে একত্র করে নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে তৈরি করেছেন কবিতার নতুন কাঠামো। তার বক্তব্য ঋজু। শব্দের অপব্যবহার তিনি করেননি কবিতায়। ‘আমাদের ফড়িঙেরা, গাছ-পাতা-ফুল, মেঘের বাঙালি বিকেলবেলা চৈত্রের সন্ধ্যায় জামাইয়ের খুনসুটি আর ওই দূরে রাজবাড়ী মেলা কেমন লজ্জা পেয়ে মৃদু হয়ে উঠবে না- ‘বলো?’ হু হু করে ট্রেন যায় পেছনেরা ডাক দেয় : ‘চলো’ পৌষে আমের ক্ষেত রকমারি সাইনবোর্ডে লেখা; ট্রেনের কামরা থেকে নির্জনতা ঝাঁপ দেয়- একা।’ নিঃসঙ্গতার কথা আলফ্রেড খোকন বলেন তার কবিতায়। অন্যান্য কবিদের মতোন নয়। অনেকটা ইঙ্গিতধর্মী। এই ইঙ্গিতধর্মিতা তার কবিতাকে করে তোলে ব্যঞ্জনাময়। আর এখানেই আলফ্রেড খোকনের কবিতা পাঠ হয়ে ওঠে মুগ্ধতায় পূর্ণ। তার কবিতার যে ভাষা, যে চিত্রÑ তা তার নিজস্ব স্টাইল। আমাদের অনেকের প্রিয়কবি জীবনানন্দ দাশের বরিশালে কবি আলফ্রেড খোকনের জন্ম, এক নয় সাত একে। বেড়ে ওঠাও বরিশালের আলো বাতাসে। তার কবিতার ভাষাও জীবনানন্দের মতো নির্জন। তবে জীবনানন্দের ভাষা নয়। কবি আলফ্রেড খোকনের কবিতায় জীবনানন্দীয় এ ভাষা প্রসঙ্গে বরেণ্য সাংবাদিক রাজীব নূরের একটি মন্তব্য আমরা উদ্ধৃত করতে পারিÑ ‘ধান, নদী, খাল নিয়ে জীবনানন্দের যে বরিশাল, সেই বরিশালে বসে আমারই বয়সী কেউ কবিতা লিখছে, যার কবিতার ভাষা ভীষণ জীবনানন্দীয়, তার প্রতি একটা কৌতূহল তো থাকবেই। খোকনের ভাষা জীবনানন্দীয় তবে সে কোনকালেই জীবনানন্দের অনুকারক ছিল না, এমন কী শুরুর সময়টাতেও। জীবনানন্দের আলো-অন্ধকার আর খোকনের আলো-অন্ধকার এক নয়। জীবনানন্দের সন্ধ্যা, চাঁদ খোকনের কাছে এসে বদলে গেছে, বদলে যায়। এমন কী, ধানসিঁড়ি আর কীর্তিনাশাও। জীবনানন্দ দাশ থেকে বহুলপঠিত ‘অন্ধকার’ মনে করিÑ ‘গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর ছল ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার;/তাকিয়ে দেখলাম পা-ুর চাঁদ বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া/গুটিয়ে নিয়েছে যেন কীর্তিনাশার দিকে।’ আলফ্রেড খোকন থেকে পড়িÑ ‘অথচ কোত্থেকে অন্ধকার-হাওয়া এসে তুলে নেয়/আর ক্রমশ দৃশ্যের রঙ থেকে আরও বেশি ফিকে/হয়ে যায় আমাদের বধূটির লালপেড়ে শাড়ি;/ দৃশ্যত এই রঙে আমরা পালক হয়ে ভেসে যাই/ দৃশ্যত হাড়ের ভেতর উদ্যত খড় হয়ে উঠি...’ খোকনের অন্য একটি কবিতাÑ ‘সন্ধ্যায় তাকে মনে রাখবে না জেনেও তো এসেছিলে খুব ভালবেসে/তারও কোন মানে নেই জেনে আঁধারের হাত থেকে/আমিও নিয়েছি সেই অস্ফুট স্বর ম্লান পাথর ডেকে;/কানে তার পরিয়েছি রূপকথা রাত্রির প্রথম প্রহর,/যেখানে বসেছে সে-; তারও তলে মনের মোহর।’ বরিশালের বিএম কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা এ কবি নিজের কর্মজীবন শুরু করেন সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে। সংবাদপত্রের মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি টেলিভিশনে কাজ শুরু করেন। আলফ্রেড খোকন একটি অনিয়মিত সাহিত্যের কাগজ সম্পাদনা করেন। তার সম্পাদনায় অনিয়মিতভাবে সাহিত্যের কাগজ ‘নন্দন’ প্রকাশ পেতে শুরু করে ১৯৯৩ সাল থেকে। তার প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যেÑ ‘উড়ে যাচ্ছে মেঘ’, ‘সম্ভাব্য রোদ্দুরে’, ‘মনে আসছে যা যা’, ‘ফাল্গুনের ঘটনাবলী’, ‘মধু বৃক্ষ প্রতারণা বিষ’, ‘সে কোথাও নেই’, ‘আলের পাড়ে বৈঠক’ এবং ‘সাধারণ কবিতা’ উল্লেখযোগ্য। তবে আলফ্রেড খোকন বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্প থেকে প্রকাশিত প্রথমগ্রন্থ ‘বেঁধে যাই পরস্পর, গেঁথে যাই পরস্পর’ কে স্বীকার করেন না; যা তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছ থেকে জানা যায়। তিনি তার পরিচিতির কোথাও ‘বেঁধে যাই পরস্পর, গেঁথে যাই পরস্পর’ নামে প্রকাশিত বইটির কথা উল্লেখ করেন না, সর্বত্রই ১৯৯৯ সালে শ্রাবণ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘উড়ে যাচ্ছ মেঘ’ তার প্রথম কবিতার বই হিসেবে উল্লেখিত। শ্রাবণ প্রকাশনীর প্রথম বইও এটি। ‘মানুষের অভিজ্ঞতা এবং ভাষার জগতে প্রচুর কল্পিত সংস্থান অনুসরণ করে একটি কবিতার প্রাণভূমি নির্মিত হয়। তার উপরে যেমন থাকতে পারে খোলা আকাশ, আবার আকাশের বন্দীদশাও। তৃতীয় বিশ্বের সঙ্গে প্রথম বিশ্বের বিরোধী অংশগুলোর মতোই কবিতা। আবার তোমার আমার মধ্যকার বিরোধÑ যা অতৃপ্তিতে রচিত, তার মধ্যেও যেমন কবিতা জন্ম, তেমনি কবিতার মৃত্যুও নিহিত। কবিতা নিশ্চিতভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত, রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি, মেরামতহীন, ভেঙ্গে যাওয়া ব্যক্ত কিংবা অব্যক্ত বোধের সঙ্গে আমাদের সংযুক্ত করে। প্রাচুর্যের ডাইনিং স্পেসে বসে কফি খাওয়ার মতো কোন বিলাসিতা, আর যাই হোক- কবিতা নয়। মানবতার স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার সংগ্রামে সবচেযয়ে আকর্ষণীয় এবং আকর্ষক ক্ষেত্র কবিতা।’Ñ কবি আলফ্রেড খোকন তার এমন কাব্যদর্শনের প্রাকরণিক স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন প্রায় প্রত্যেকটি কবিতাগ্রন্থে। দৃশ্যকল্প তার কবিতায় অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। যা পাঠকের বোধকে শাণিত করে, আন্দোলিত করে। ‘আশ্চর্য একটা তারিখ চেয়ে আছে গণিতের খাতার ভেতর পুরনো একটা ফুলের পাপড়ি যেমন প্রিয়তম বইয়ের পৃষ্ঠায় চাপা পড়ে বছর বছর আশ্চর্য একটা তারিখ চেয়ে আছে ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠার উপর মোনালিসার মতো অনেক বছর ধরে চেয়ে আছে চোখের ভেতর আশ্চর্য একটা মুখ এই দিকে চেয়ে আছে শতাব্দী থেকে শতাব্দীর পর পুরনো শেলফে যেমন দগদগে ক্ষত থাকে যেমনটা থাকে তোমার মনের ভেতর।’ তার সমসাময়িক অনেক কবিই যখন ছন্দবিমুখ তখনও আলফ্রেড খোকন গদ্য ছন্দের পাশাপাশি অন্যান্য ছন্দ নিয়ে খেলেছেন তা তার কবিতা পাঠেই বুঝতে পারি। ব্যক্তি অভিজ্ঞতাকে নানা ব্যঞ্জনায় তিনি কবিতা করেছেন। প্রেম, সমাজ, মানবতা, অনুভূতির ক্ষেত্রে কবি সবসময়ই বাস্তববাদী। পাঠকের ভেতর একটা কৌতূহল বা জিজ্ঞাসা তৈরি করে দেয় তার কবিতা। এখানেই কবি আলফ্রেড খোকন হয়ে ওঠেন এক ঘোরের নাম। তার কবিতার গীতলধারা আমাদের কবিতা পাঠে আরও বেশি আগ্রহী করে।
×