কুয়াশার চাদরে ঢাকা ১১ জানুয়ারির সেই দিনটি প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরে উঠেছিল প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে। কালো গাউন ও টুপিতে এক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল ধুপখোলা মাঠে। নির্মাণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার বর্গফিটের বিশালাকৃতির প্যান্ডেল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত স্নাতক, স্নাতকোত্তর, এমফিল, পিএইচডি ও সান্ধ্যকালীন ডিগ্রীধারী শিক্ষার্থীরা যারা জবি থেকে অন্তত একটি ডিগ্রী নিয়েছেন তারা সবাই অংশগ্রহণ করেছে এই সমাবর্তনে। জবি তথ্যানুযায়ী মোট ১৮ হাজার ৩১৭ শিক্ষার্থীর সার্টিফিকেট তৈরি করতে হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে ১৩ হাজার ৭৬২ এবং মেয়ে ৪ হাজার ৫৫৫ জন। সমাবর্তনে ১১ হাজার ৮৭৭ জনকে স্নাতক, ৪ হাজার ৮২৯ জনকে স্নাতকোত্তর, ১ হাজার ৫৯৪ জনকে সন্ধ্যাকালীন স্নাতকোত্তর, ১১ জনকে এমফিল ও ৬ জনকে পিএইচডি ডিগ্রী দেয়া হয়েছে। তবে সমাবর্তনে একজন শিক্ষার্থী কেবল একটি সনদের জন্য রেজিস্ট্রেশন করতে পেরেছেন। যারা এ বছর সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করেনি তারা আর কখনও সমাবর্তনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একাধিক ডিগ্রী অর্জনকারীরা সমাবর্তনের পর ডিগ্রীর সনদ তুলতে পারবেন।
সকাল ৮ থেকে শিক্ষার্থীদের কলোরব বাড়তে থাকে ধূপখোলা মাঠে। এরপর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর জনাব মোঃ আবদুল হামিদ এর শোভাযাত্রা, এরপর জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ১ম সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। সমাবর্তনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর জনাব মোঃ আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি এমপি। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ট্রেজারার অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ। সমাবর্তন বক্তা হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ইমেরিটাস ড. অরুণ কুমার বসাক বক্তব্য প্রদান করেন। তার জ্ঞানগর্ভ আলোচনার উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল- আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের মেধা উন্নত বিশ্বের ছেলেমেয়েদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। আমাদের দেশে অশিক্ষিত এবং স্বল্পশিক্ষিত কারিগর দল মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে বিদেশে রফতানিযোগ্য উন্নত মানের জাহাজ তৈরি করছে। প্রাথমিক ধাপ থেকেই আমাদের শিক্ষক ও অভিভাবকদের অসংযত জীবনধারা, অপ্রতুল প্রশিক্ষণ পরিবেশ ও দুর্বল শিক্ষক আমাদের ছেলেমেয়েদের সাধারণভাবে দুর্বল করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে অনেক পড়াশোনা করেও জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থতা বোধ করছে। তাদের সাধারণ প্রশ্ন, কী করলে সফল হতে পারবে তারা? উত্তরে আমি বলবÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার বিষয়বস্তু হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার দায়িত্ব শিক্ষার্থীর নিজের সমগ্র বিশ্বে একই নিয়ম। এর কারণ শিক্ষার্থীর দুর্বলতায় বিভিন্নতা থাকে। মনে মনে চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রতিকূলতা ও বাধা অতিক্রম করার জন্য পরিশ্রম, বিচার-বুদ্ধি, নিষ্ঠা ও সাহস প্রয়োগ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরা তাঁদের সাধ্যমতো শিক্ষার্থীকে পরামর্শ দেবেন। শিক্ষার্থীর প্রশ্নের উত্তর দেয়ার অক্ষমতা শিক্ষকের জন্য মোটেই লজ্জাকর নয়। সব সময় মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকের বা আলোচকের বক্তব্য শুনতে হবে।
এরপর দুপুর ২টার পর থেকে সকলে ফিরে আসে ক্যাম্পাসে। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত ছিল দিনটি। অনেকেই প্রায় ১০ বছর পরে প্রিয় ক্যাম্পাসে এসেছে। পুরনো বন্ধুদের খুঁজে পেয়ে সবার নানা রঙের স্মৃতিগুলো মনের জানালায় ভাসছিল। এদিনটিতে প্রিয় বন্ধুদের একই ফ্রেমে বন্দী করতে ব্যস্ত ছিল সবাই। ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের একদল বন্ধু যারা এখন বিভিন্ন প্রফেশনে রয়েছে প্রভাষক, শিক্ষক, ব্যবসায়িক, পুলিশ অফিসার, সাংবাদিক, ব্যাংকার এবং গৃহিণী। ধুপখোলা মাঠ থেকে আসার পথে সেলিনা ও লিপি দুই বান্ধবীর কথোপকথনে উঠে আসে পুরনো দিনের স্মৃতি। এখানে কত মুড়ি ভর্তা খেয়েছি। এখন জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নতুন নতুন দোকানে ভরে গেছে রাস্তার পাশ। মনেই হয়নি অনেকদিন পরে তাদের দেখা হয়েছে। অনেকের মতে এতটাই ভাল লেগেছিল সমাবর্তনের দিন যা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। প্রাণতোষ বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর। কাজের ঝামেলায় কেটে যায় সারাদিন। ওইদিন বন্ধুদের কাছে পেয়ে হয়ত ভুলেই গিয়েছিল সে একজন দায়িত্ববান পুলিশ অফিসার। তাই তো সবার মতো সেও হয়েছিল একজন সেলফিবাজ। শিক্ষাজীবনে অনেক সময়ই সহপাঠীরা সবাই একজন আরেকজনকে চিনলেও হয়ত আলাপচারিতা হয় না। কিন্তু ওইদিন একেঅন্যের সঙ্গে কুশলবিনিময় করতে ভুলেনি। সমাবর্তন উপলক্ষে সৃষ্টি হয়েছিল এক অপূর্ব মেলবন্ধন।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: