ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সারওয়ার আলীর স্ত্রীর সাবেক গাড়িচালকের নেতৃত্বে হামলা হয়

প্রকাশিত: ১০:৪৩, ২৪ জানুয়ারি ২০২০

  সারওয়ার আলীর স্ত্রীর সাবেক গাড়িচালকের নেতৃত্বে হামলা হয়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি ও ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডাঃ সারওয়ার আলীর স্ত্রীর কাছ থেকে আশাতীত ভাল ব্যবহার না পাওয়ার সূত্রধরে তার বাসায় হামলার ঘটনাটি ঘটে। তাদের ভয় দেখাতে এবং তাদের বাসা থেকে টাকা পয়সা স্বর্ণালঙ্কার লুট করতেই ডাঃ সারওয়ার আলীর স্ত্রীর সাবেক গাড়িচালক শেখ নাজমুল ইসলামের নেতৃত্বে হামলা হয়। হামলার ঘটনার দায়েরকৃত মামলার প্রধান আসামি শেখ নাজমুল ইসলামসহ চার জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। এ নিয়ে হামলার সরাসরি জড়িত পাঁচ জন গ্রেফতার হলো। ইতোমধ্যেই তারা আদালতে হামলার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। আরও দুই জন পলাতক রয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের দেয়া জবানবন্দীর বরাত দিয়ে এমনটা জানিয়েছে পিবিআই। গত ৫ জানুয়ারি রাত সাড়ে দশটার ঢাকার উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের বাসায় ডাঃ সারওয়ার আলীর ওপর হামলার ঘটনাটি ঘটে। এ ঘটনায় গত ৬ জানুয়ারি ডাঃ সারওয়ার আলী তার বাসার দারোয়ান মোঃ হাসান ও আগের গাড়িচালক নাজমুলসহ অজ্ঞাত ৪/৫ জনের বিরুদ্ধে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-১০। মামলায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়। ঘটনার দিনই পুলিশ বাড়িটির কেয়ারটেকার হাসান ও ডাঃ সারওয়ার আলীর বর্তমান গাড়িচালক হাফিজকে আটক করে। এছাড়া গত ১৩ জানুয়ারি পিবিআই ভোর ছয়টার দিকে ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে হামলায় অংশ নেয়া ফরহাদকে (১৮) গ্রেফতার করে। ফরহাদের পিতার নাম মোঃ শহীদুল্লাহ। বাড়ি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা থানাধীন আনন্দপুর গ্রামের কাশেম মোড়লের বাড়িতে। সে ইতোমধ্যেই হামলায় অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। ফরহাদ হামলায় অংশ নেয়া প্রত্যেকের পরিচয় প্রকাশ করে। গত ২২ জানুয়ারি দুপুর দুইটার দিকে পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ বশির আহমেদের সার্বিক তদরকিকে পিবিআইয়ের একটি বিশেষ দল অভিযান চালায়। অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রোর উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মোঃ তরিকুল ইসলাম। তাকে সহযোগিতা করেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক জুয়েল মিঞাসহ আরও কয়েকজন। তারা লুঙ্গি পরিধান করে শ্রমিকের বেশে প্রথমেই মামলার প্রধান আসামি শেখ নাজমুল ইসলামকে (৩০) গাজীপুর জেলার শালনা থেকে গ্রেফতার করে। তার পিতার নাম শেখ নুরুল আমিন। বাড়ি বাগেরহাট সদর জেলার পাড়কুর্শাইল গ্রামে। নাজমুলের তথ্য মোতাবেক ওই দিনই বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে উত্তরা থেকে গ্রেফতার করা হয় নাজমুলের চাচাতো ভাই শেখ রনিকে (২৫)। এছাড়া আরেক আসামি মোঃ মনির হোসেনকে (২০) ঢাকার দক্ষিণ খান থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার পিতার নাম নুর মোহাম্মদ, বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল থানাধীন বরমা কাকচর গ্রামে। সর্বশেষ বাগেরহাট থেকে ওইদিনই রাতেই মোঃ ফয়সাল কবির (২৬) নামের আরেক আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। তার পিতার নাম শেখ মনিরুজ্জামান। তার বাড়ি শেখ নাজমুলের একই গ্রামে। তাদের কাছ থেকে হামলায় ব্যবহৃত আলামত উদ্ধার হয়। পলাতক রয়েছে আরও দুই আসামি মল্লিক ওরফে সুমন ও নুর মোহাম্মদ। বৃহস্পতিবার পিবিআইয়ের ধানম-ি ৪ নম্বর সড়কের প্রধান কার্যালেয় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তদন্তকারী সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার। তিনি আরও জানান, ২০১৭ সালের জুনে শেখ নাজমুল ইসলাম ড্রাইভার হিসেবে ডাঃ সারওয়ার আলীর বাড়িতে কাজ নেয়। সে ৯/১০ মাস কাজ করে। ড্রাইভার হিসেবে চাকরি করাকালে ডাঃ সারওয়ার আলীর স্ত্রী ডাঃ মাখদুমা নার্গিসের কাছ থেকে সে প্রাপ্য সঠিক ব্যবহার আশা করত। কিন্তু সে গরিব মানুষ বলে সেটি পেত না বলে তার মনে হয়। এতে সে মনের কষ্টে ও রাগে চাকরি ছেড়ে দেয়। কিন্তু মনে মনে নাজমুল ডাঃ সারওয়ার আলীর পরিবারকে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে। নাজমুল হিন্দি সিনেমার পাগল। সেসব সময় নিজেকে সিনেমার নায়ক বা ভিলেনের মতো ভাবতে ভালবাসত। সে মূলত কল্পনার জগতে থাকতে বেশি পছন্দ করত। একজন প্রতিবাদী নায়ক বা ভিলেন সিনেমায় যেভাবে গরিবের প্রতি হওয়া অবিচারের প্রতিশোধ নেয়, ঠিক সেভাবেই সে ডাঃ সারওয়ার আলীর পরিবারকে উচিত শিক্ষা দিবে এবং ভয় দেখিয়ে ডাকাতির করবে বলে পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক একাজে তার সহযোগী হিসেবে তারই চাচাতো ভাই রনিকে ভেড়ায়। রনি তার বোন জামাই পলাতক আল-আমিন ও নুর মোহাম্মদ এবং গ্রেফতারকৃত ফয়সালকে দলে ভেড়ায়। নাজমুল রাজধানীর ঢাকার আজমপুর লেবার মার্কেট থেকে গ্রেফতারকৃত মনির ও ফরহাদকে দৈনিক ৫০০ টাকা মজুরিতে দিনমজুর হিসেবে নেয়। কয়েক দিন কাজ করার পর তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক করে। পরে তাদের ডাকাতি করার পরিকল্পনাটি জানায়। টাকার লোভে তারা রাজি হয়। পরিকল্পনা মোতাবেক সে দলের ছয় সদস্যকে সিনেমার মতো করে কাল্পনিক অফিসের কথা বলে। যে অফিসে পুলিশ, সাংবাদিক, উকিল ও ডাক্তার ছায়ার মতো নিরাপত্তা দেবে। পুলিশ অস্ত্র দিবে, সাংবাদিক ক্যামেরা দিবে, উকিল স্ট্যাম্প দিবে এবং ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জামাদি দিবে। ঘটনার সময় স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর ও ফিঙ্গার প্রিন্ট নিতে হবে এবং ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করে রাখতে হবে। সে মোতাবেক তারা স্ট্যাম্প, প্রেসার মাপার মেশিন, টেথেসকোপ, ক্যামেরার স্ট্যান্ড ও ট্যাব যোগাড় করে। ডাকাতির ঘটনাটি পুরোপুরি ভিডিও করে রাখার কথা ছিল। কিন্তু সেটি তারা আর করার সুযোগ পায়নি। সে মোতাবেক গত ৪ জানুয়ারি সকালে তারা রাজধানীর আশকোনা এলাকায় হাজী ক্যাম্পের সামনের একটি হোটেলে নাস্তা করে। সেখানে ডাকাতি করার বিষয়ে বৈঠক করে। বৈঠকে নাজমুল জানায়, তাকে যেন কেউ চিনতে না পারে এজন্য সে তিন মাস ধরে দাড়ি রেখেছে। ঘটনার দিন ৫ জানুয়ারি বিকলে পাঁচটার দিকে আশকোনা এলাকার হোটেল রোজ ভ্যালির ৩০৩ নম্বর কক্ষে মূল পরিকল্পনাকারী নাজমুলের নেতৃত্বে বৈঠক হয়। বৈঠকে কে কোথায় কিভাবে অবস্থান করবে সে সম্পর্কে ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দেয়। নাজমুল বাসার পরিবেশ, কক্ষ, পার্কিং প্লেস ইত্যাদি সম্পর্কে সকলকে অবগত করে। ডাকাতির সময় কার কি ভূমিকা হবে তা বুঝিয়ে দেয়। নাজমুল অন্যদের জানায়, ডাঃ সারওয়ার আলীর বাড়িতে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার আছে। নাজমুল অন্যদের ডাঃ সারওয়ার আলীর স্ত্রীর ওপর ক্ষোভের বিষয়টি গোপন রাখে। কারণ এতে অন্যরা এমন কাজে নাও রাজি হতে পারে। ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাতটার দিকে রোজ ভ্যালি হোটেল থেকে নাজমুল একা বের হয়। এরপর অন্যরা বের হয়। অন্যরা ঘটনাস্থলে গেলে নাজমুল একটি ব্যাগে করে ৭টি চাপাতি ও ৫টি সুইচ গিয়ার ছুরি নিয়ে সেখানে যায়। রনি ঘটনাস্থলে থাকা ৫ জন আসামিকে ছুরিগুলো দেয়। নাজমুল রাত নয়টার দিকে পরিকল্পনা অনুযায়ী চার প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে বাসায় যায়। যার মধ্যে তিন প্যাকেটে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। প্রথমেই দারোয়ান হাসানকে দেয়। হাসান ঘুমিয়ে পড়বে এ অপেক্ষায় থাকে। কিন্তু রাত ১০টা নাগাদ হাসান ঘুমায় না। এজন্য হাসানকে অন্য কথা বলে ব্যস্ত রাখে নাজমুল। এই সুযোগে ফয়সালকে ডেকে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় গিয়ে আড়ালে থেকে অপেক্ষা করতে বলে। আর সঙ্গে থাকা চাপাতিসহ ব্যাগটি গ্যারেজের পাশে রেখে দেয়। নাজমুল ও ফয়সাল দ্বিতীয় তাদের সেন্ডেল খুলে রেখে তৃতীয় তলায় যায়। সেখানে ডাঃ সারওয়ার আলীর মেয়ে ডাঃ সায়মা আলীর বাসায় নক করে। তার মেয়ে দরজা খুললে নাজমুল ও ফয়সাল ধাক্কা দিয়ে বাসার ভিতরে প্রবেশ করে ডাঃ সায়মা আলী, তার স্বামী মোঃ হুমায়ুন কবির ও মেয়ে অহনা কবিরকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখে। রাত সাড়ে দশটার দিকে ফয়সালকে তৃতীয় তলায় রেখেই নাজমুল চতুর্থ তলায় ডাঃ সারওয়ার আলীর ফ্ল্যাটে নক করে। ডাঃ সারওয়ার আলী দরজা খুলে দিতেই জোরপূর্বক ভিতরে প্রবেশ করে তাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে মেঝেতে ফেলে গলায় ছুরি ধরে। এ সময় তার ডাঃ মাখদুমা নার্গিস চিৎকার শুরু করলে নাজমুল বাইরে অপেক্ষারত সহযোগীদের ফোনে ভেতরে আসতে বলে। ডাঃ সারওয়ার আলীর স্ত্রীকেও ভয় দেখায়। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে দ্বিতীয় তলার ভাড়াটিয়া মেজর (অবঃ) সাহাবুদ্দিন চাকলাদার ও তার ছেলে মোবাশ্বের চাকলাদার সজিব চতুর্থ তলায় যান। পিতাপুত্র তাকে ধরার চেষ্টা করলে অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে সে নিচে নেমে যায়। কারণ ততক্ষণে নিচে থাকা দারোয়ান ঘুমিয়ে না পড়ায় সহযোগীরা আর উপরে যায়নি। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো উত্তরের পরিদর্শক মোঃ তরিকুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, চার আসামিই ঢাকার সিএমএম আদালতে হামলার স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি সাইদুর রহমান ও খন্দকার আব্দুর রউফ, ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ বশির আহমেদ, দক্ষিণের বিশেষ পুলিশ সুপার মোঃ শাহাদাত হোসেনসহ উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×