ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

রিফাত মুনীর ইতি

প্রেম ও মাধুর্যের কবি

প্রকাশিত: ১২:৪৩, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৯

প্রেম ও মাধুর্যের কবি

পৃথিবীর প্রাচীনতম সাহিত্য কবিতা, কবিতা সৃজনশীলতার প্রাথমিক ধাপ, কোমল, প্রতিক্রিয়াপ্রবণ ও অনুভূতিপ্রবণ মনের যথার্থ প্রকাশ। কবিতা শুধু মানব জীবনের নান্দনিক সঙ্গী নয়, এটি মানুষের রুচি ও সুকোমল সংস্কৃতি চর্চার বাহন, সৌন্দর্য ও শিল্পবোধের ধারক। কবিতার চর্চা, বিশেষ করে আধুনিক বাংলা কবিতায় যে সার্বক্ষণিক নিরীক্ষার প্রচেষ্টা তার নানান রূপ আমরা দেখতে পাই প্রকাশনায়, বলতে দ্বিধা নেই যদিও, এটি কবিতার পাঠক সৃষ্টিতে কতটা ভূমিকা রাখছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। এখন, ভেবে দেখতে হবে, বাক্যে, ছন্দে, গতিময়তায়, চিত্রকল্প সৃষ্টিতে, অলংকার ব্যঞ্জনায়, কাব্যের মাধ্যমে কাহিনীর চিত্তাকর্ষক ধারাবাহিক উপস্থাপনা কবি হিসেবে একালের সহযাত্রীরা কতটা সফল, কতটুকু বা তাদের কবিতার প্রতি প্রেম, দায়বদ্ধতা? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অবসরে যে কবি আমাদের সহজাত বাংলায় শুনিয়ে যাচ্ছেন কবিতার অপরিহার্যতা তিনি স্বাভাবিকভাবেই হয়ে উঠেছেন পাঠকের খুব কাছের মানুষ। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার এক স্বচ্ছন্দ সহচর, যিনি অবলীলায় পাঠককে নিয়ে প্রবেশ করতে পারেন তাঁর কবিতার রোমাঞ্চকর রহস্যাবৃত মঞ্চে, পাঠক পুলকিত হয় তাঁর ভাষার সাবলীলতায়, অলঙ্কারের ঐশ্বর্যে। তিনি আমিনুল ইসলাম। সমসাময়িক বাংলা কাব্যে যার অবস্থান স্বতন্ত্র, স্বাধীন, ও সুসংহত। যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজের মূল উৎস প্রেম, উদ্দেশ্যও তাই। বলাবাহুল্য, কবিতাও তার ব্যতিক্রম নয়। কবি সৃষ্টির প্রেরণা খুঁজে পান প্রেমে, আর পরে ছড়িয়ে দেন তার মাধুর্য পাঠকের মাঝে। প্রেমের বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনা পাঠককে শুধু আলোড়িত করে না, করে ঋদ্ধ, আত্মসচেতন। কবিতায় আমিনুল ইসলাম পাঠককে দিয়ে যাচ্ছেন সেই পৃথিবীর সন্ধান, নিয়ত। কবি নিজে পদ্মা পাড়ের ছেলে, বেড়ে উঠেছেন বাংলার ‘ক্ষেত, মাঠ, নদী ভালোবেসে’। ‘জলঙ্গির ঢেউয়ে ভেজা’ বাংলার প্রতিটি বাঁকে খুঁজেছেন ভালোবাসা, আর তার প্রকাশে ভাষার সীমাবদ্ধতাকে করেছেন তুচ্ছ : ‘যে দেশের মাটিতে মিশে আছেন বেহুলা লখিন্দর / আমি সে দেশের লোক/ চোখে খোদাইকৃত ভালোবাসার ভিসা,/ হে ইমিগ্রেশন বিভাগ/কি খোঁজো মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের বুকে!’ (কবিতা : অভিবাসী চিরদিন/অভিবাসী ভালোবাসা) লক্ষণীয় যে, ভাষাকে গতিশীল করার কবির নিজস্ব পদ্ধতি বাদ দিলেও, এটি মূলত দুটো ভিন্ন ধারার সংমিশ্রণ, পুরাণের সঙ্গে আধুনিকতা। সেই কবেকার এক পতিপ্রেমের অমর কাহিনী ভেসে ওঠে মানসপটে, প্রেমের শাশ্বত, গভীরতার সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য চিত্রনাট্যে দেখা মেলে আত্মবিশ্বাসী প্রেমিকের, যে নিজের ভালোবাসা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকারীকেই উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে পরম সাহসিকতায়। নিঃসন্দেহে, ভাবনার এক নতুন দুয়ার খুলে দেয় এই লাইন, পাঠককে সচকিত করে। অন্যদিকে, ভাষার গতিময়তা সৃষ্টি যেন কবির আরেকটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ। কারণ, কবি বিশ্বাস করেন বাংলা কবিতা শব্দের কাঠিন্য দূর করে সহজ স্বচ্ছন্দতায় বিচরণে সক্ষম। এ কারণেই, ভাষাকে সহজবোধ্য করেছেন কবি, কবিতাকে নিয়ে গেছেন সাধারণ পাঠকের কাছে : ‘চাঁদবোনা শাড়ি পরে হেঁটে যায় রাত আমার জীবন জুড়ে কুয়াশার হিম উষ্ণতার গোলাঘরে লাগিয়ে কপাট তুমি একা বসে আছো উদাসী অসীম।’ চাঁদবোনা শাড়ি, কিংবা ‘উষ্ণতার গোলাঘর’ শব্দগুচ্ছতে কবির সঙ্গে সঙ্গে নিবিড় কল্পনাশক্তির পরিচয় আর পাঠকের মনকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস লক্ষণীয়। এই জানা সাধারণ শব্দই পাঠক হৃদয়কে সচকিত করে, করে তোলে মোহাবিষ্ট, বিমুগ্ধ। এই যে পাঠককে সচকিত করা, এটিও সম্ভবত কবির সবচেয়ে সচেতন ও সফল প্রয়াস। তিনি বাক্যবিন্যাসে সরলতার আশ্রয় নিয়েছেন, কিন্তু কবিতার মূলসূত্র থেকে দূরে সরে যাননি। আবার, লাগামহীন ¯্রােতেও তিনি গা ভাসাননি। আমিনুল যা করেছেন, তাহলো, পাঠককে জীবনের বহুমাত্রিক সৌন্দর্যকে উপভোগ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এটি একটি দুরুহ কাজ, সন্দেহ নেই, যদিও তাঁর কবিতায় তা মনে হয় না। বর্তমান সময়ের কবিতায় যে বিষয়টির অভাব চরমভাবে লক্ষণীয়, তা হলো কবিদের পাঠাভ্যাসহীনতা। এটি কবিতার রাজ্যে কবিদের প্রবেশের প্রাথমিক শর্ত, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার দেখা মেলে না। কবিতায় চিত্রকল্প সৃষ্টি, উপমার যথার্থ ব্যবহার, ভাষার প্রয়োগ ও বাক্যবিন্যাসে খাপছাড়া ভাব, ভাবনার বিচ্ছিন্নতা, ছন্দ সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে তাদের লেখায়, কবিতা স্বাভাবিকভাবেই পাঠকপ্রিয়তা হারিয়ে ক্রমশ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের আরাধ্য হয়ে উঠেছে। কবি আমিনুল ইসলাম এই সবগুলো দোষ থেকে শুধু নিজেকে মুক্তই রাখেননি, বরং তাঁর পাঠাভ্যাসের প্রমাণ রেখেছেন কবিতার প্রতিটি ছত্রে, বিষয় নির্ধারণে, ভাবে, ছন্দ ব্যবহারে, চিত্রকল্প নির্মাণে, ভাষার নিরীক্ষায়, কাব্যের বৈচিত্র্যময়তায়। কবিতাকে তিনি সকল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে চেয়েছিলেন, সফলও হয়েছেন। ভারতীয় মিথ্ থেকে পারসিক প্রেম, মিসরীয় মমি থেকে বাংলার লালন, গ্রেট সালাউদ্দিন থেকে সক্রেটিসের দর্শন, আরব্যরজনী থেকে শুরু করে ক্লিউপেট্রার রাজসিক চরিত্র সবকিছু তাঁর হাতে হয়ে গেছে শব্দ-মঞ্জরীর খেলার পুতুল। তাইতো অবলীলায় তিনি গাইতে পারেন নেফারতিতির স্তবগীত, পরম প্রতাপশালী রাজা তুতেনখামেন তাঁর কাব্যে পায় ভিন্ন ব্যঞ্জনা : ‘এবং মুখোমুখি সেই উপচে পড়া প্রাণ- সেই উদ্বেলিত বাসনা/একদিকে তুতেনখামুন/ অন্যদিকে নেফারতিতি, কিন্তু আমি যে/নেফারতিতিকে চেয়েছি, গ্রেট ফারাও আখেনাতেনের রাজরানী/একদিন নিজেই ফারাও হয়ে রাজত্ব করেছেন দুইহাতে, তিনি তো পাথর ছিলেন না...’ (নেফারতিতির সঙ্গে, কাব্যগ্রন্থ : জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র) আবার, কবি আমিনুল ইসলাম সমাজ বাস্তবতার কবি। কবিতা তাঁর কাছে হতে উঠেছে বারবার প্রতিবাদের হাতিয়ার। এই প্রতিবাদ শুধু শোষিত, বঞ্চিত কিংবা নিপীড়িত মানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য নয়, তিনি সামাজিক নানা সংস্কারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, নারীরা স্বাভাবিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী প্রতিটি বিষয়ে আলাদাভাবে প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনকের উদাত্ত আহ্বানের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় এসেছে দেশপ্রেমের লৌকিক প্রদর্শনীর চিত্র, কবি চেয়েছেন, সমাজের যাবতীয় এসব বাহ্যিক লালসার বেদীতে কুঠারাঘাত করতে। তাঁর সাহসিকতা আর আপোসহীন কাব্যিক প্রতিবাদ শুধু প্রাঞ্জল হয়নি, বরং এটি এক শ্রেণীর মানুষের জন্য সত্যিকারের দিকনির্দেশনা হয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে আলোর পথ: ‘যতদূর অভিবাসন, ততদূর মাতৃভাষা যতদূর মাতৃভাষা, ততদূর মাতৃভূমি’ (কবিতা : অভিবাসীর গান) প্রতিবাদের এই ধরনের পদ্ধতিটিও কবির উদ্ভাবিত। তিনি কঠোর কঠিন ভাষায় কিছু বলেন না, তাঁর কাব্যময়তা ঠিক রেখে, তিনি নীরবে, নিভৃতে পাঠকদের অন্তরে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন প্রতিবাদী চেতনা, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন সামাজিক নানা অসঙ্গতির চিত্র, ভয়হীন চিত্তে। এটি একদিকে তাঁর মানবিকতাকে সুউচ্চ তুলে ধরছে, অন্যদিকে চিনিয়ে দিচ্ছে ব্যক্তি আমিনুল ইসলামের নৈতিকতার মানদ-। তিনি সচেতনতা, দায়বদ্ধতা, আর মানবপ্রেমের অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন তাঁর কাব্যের মাধ্যমে: ‘বিস্মৃত বাঁশের কেল্লা, জলে ভাসে আলাওল নাম/কালের করাত হাসে : বটভায়া, দ্যাখো দফারফা/সুরের অরিশ ভুলে প্রেমে ভরা নগরের ধাম/শেরাটনে হয়ে ওঠে কৌটিল্যের গোপন মুনাফা’ (মেঘের মিনারে বসে দেখা : কাব্যগ্রন্থ ভালোবাসার ভূগোলে) একজন কবি, এইভাবে যখন একই সঙ্গে একজন সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাকে প্রবল রাজনীতি সচেতন হিসেবে দেখা যায়। গভীর মানবিক বোধের দর্শন তাঁর লেখা ঘিরে থাকবে এটাও তখন স্বাভাবিক মনে হয়। অন্যদিকে, ছন্দ ও ভাষা নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন কবি, বলা যায়, ভেঙেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাকে করেছেন খেলার উপকরণ। আর তাই তাঁর কবিতা নিজের গবেষণালব্ধ এক গভীর অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞানের ফসল। এটি করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই কবির পাঠতৃষ্ণার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার পাঠকদের তিনি রাঙাতে চেয়েছেন বর্ণিল রঙে, বাঁধতে চেয়েছেন ছন্দোবদ্ধ শব্দশৈলীর ভেতর : ‘আমার বয়স শুধু ঝাপসা দিতে চায় তোমার বয়সে ওঠে পাগলার ঢেউ কত ডাক বেজে ওঠে গাঙের হাওয়ায় তুমি আর আমি ছাড়া শোনেনি তা কেউ’ (ধবল মেঘের দিনগুলো : কুয়াশার বর্ণমালা) শব্দ নিয়ে, ছন্দ নিয়ে, বর্ণনা রীতি নিয়ে, উপস্থাপনে যে নিরীক্ষা কবির কবিতার প্রাণসঞ্চার করেছে, তা আধুনিক কবিদের মধ্যে বিরল। বিশেষত, ক্রমাগত শব্দ চয়নে তিনি যে বৈচিত্র্যের স্বাদ দিয়েছেন, সেটা তার কবিতার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে। আমাদের রোজকার ব্যবহৃত শব্দ নিয়েও সিটকানো ভাব দূর করেছেন। কথ্যভাষা তার ব্যবহারের গুনে হয়ে উঠেছে একেবারেই সহজ বোধগম্য শিল্পের মাধ্যম হিসেবে তার আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। বরং পাঠের পর, তার হয়ে উঠেছে আরো কাছের, আরো ভেতরকার আহ্বান। প্রকৃতি যে কোন সংবেদনশীল মানুষকে নাড়া দেয়, হবে ওঠে আনন্দ, বেদনা, বিষাদ কিংবা আনন্দের উপলক্ষ। কবিদের প্রকৃতিপ্রেম নতুন কিছু নয়, উর্ধে বরং বলা যায় প্রকৃতিই হয়ে উঠেছে তাদের সৃষ্টির প্রেরণা, স্মরণাতীত কাল থেকে। কবি আমিনুল ইসলাম কবিতায় যেটি করেছেন, সেটি একটু ব্যতিক্রম। তিনি শুধু প্রকৃতিবন্দনা করেননি, মানব জীবনকে তার সঙ্গে যুক্ত করেছেন। আমাদের চাওয়া পাওয়া, আশা-আকাক্সক্ষা, দুঃখ সুখে জড়িয়ে আছে এই মাটি, নদী, সমুদ্র কিংবা সুবিশাল বৃক্ষরাজি তা তাঁর কবিতায় আরেকটু গভীরতায় প্রকাশিত: ‘কুটিল আলোর প্রান্তে তিমিররাত ফুরিয়েছে তেল সারেংবৌয়ের ঘরে আমরা যাত্রী ¯্রােত শ্যাওলার সাথ হাঙরের নাক অধীর করেছে তারে!’ (কবিতা : এই নদী এই হাওয়া, কাব্যগ্রন্থ : মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম) কেন আধুনিক পাঠক কবিকে বেছে নেবেন? এই প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো উত্তর সম্ভবত দুটি। এক : কবির কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্প। যেকোন একটি কবিতা শুধু কবিতা হয়ে ওঠেনি তাঁর কলমে, এটি অসাধারণ এক দৃশ্যকল্পের চিত্রায়নের কথা মনে করিয়ে দেবে বারবার। দুই: কবির স্বতন্ত্র শব্দগুচ্ছের ব্যবহার যা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। আমাদের জানা, পরিচিত, সহজ শব্দমালা তাঁর লেখায় পেয়েছে অভিনবত্ব। আর তাইতো: ‘মর্নিং শিফটের ভিজিটিং প্রফেসর’ এরিস্টটলের ন্যায়জ্ঞান, ‘সোমপুর বিহারের শপথকন্যা’, মেয়রের বুলডজার, ‘পুরোহিত কবি’, ‘সর্বজয়ী প্রণয়ের প্রতœরঙা বিস্ময়ের স্মারক’, সাঝরঙা মৃত্যু অনন্য, অপরিসীম মায়াময় হয়ে ধরা দেয় পাঠকের চোখে। কবিতায় মুগ্ধতা সৃষ্টির জন্য কবি আমিনুল ইসলামের নামটি তাই বার বার উচ্চারিত হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে আশা করা যায়। জয়তু কবি আমিনুল ইসলাম।
×