ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জাবিতে প্রাণের বার্তা নিয়ে অতিথি পাখি

প্রকাশিত: ০৬:৪৫, ২৬ নভেম্বর ২০১৯

  জাবিতে প্রাণের বার্তা নিয়ে অতিথি পাখি

জাবি সংবাদদাতা ॥ চারপাশ গাছগাছালিতে ঢাকা, মাঝরাতে হঠাৎই একপাল শিয়ালের হুক্কা হুয়া চিৎকারে সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডেকে ওঠে রাতজাগা পাখি, ভেঙে যায় হাজার বছরের মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা। বনের তীর ঘেষে বয়ে চলা আঁকা বাঁকা জলাশয়ে লাল সাদা শাপলা ফুল আর ডালে ডালে শিকারের আশায় বসে থাকা মাছরাঙ্গার তীক্ষè চোখ। কখনওবা হর্ন বাজিয়ে ছুটে যায় দূরন্ত বাস, চারিদিক সরগরম থাকে মানুষের কোলাহলে, আড্ডায়। বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নান্দনিক এসব দৃশ্য ধারণ করে আছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। সাংস্কৃতিক রাজধানীখ্যাত দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এটি বাংলাদেশের অন্যান্য ক্যাম্পাস থেকে ভিন্ন। এই ভিন্নতা প্রকট হয়ে ওঠে শীতের আগমনে । অন্য কোথাও শীতের আমেজ না শুরু হলেও, ভোরের কুয়াশা, শিশির ভেজা ঘাষ, রাতের হিমেল হাওয়া, শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ, আর হাজার মাইল দূরের সাইবেরিয়া থেকে ছুটে আসা অতিথি পাখি যেন জাহাঙ্গীরনগরের শীতে একটি উৎসবের বার্তা বয়ে আনে। গোধূলীর শেষে সূর্য যখন ড্বুবে ডুববে তখনই মাথার উপর দিয়ে দল বেধে উড়ে যাচ্ছে একঝাঁক অতিথি পাখি। রাতের শেষে সূর্য যখন পূর্ব দিগন্তে উকি দিতে শুরু করে, তখন কাথা মুড়ে ঘুমের ঘোরে আচ্ছন্ন ব্যস্তনগরীর বাসিন্দারা, তার আগেই জেগে ওঠে পাখিরা। সকালের ¯িœগ্ধতায় ছোয়া লাল আভাময় পরিবেশে পাখির কিচির মিচির ডাক যেন এক নৈসর্গিক আবহাওয়া উপহার দেয়। শীত আসতে না আসতেই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি আসতে শুরু করেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলাকাকলিতে মুখরিত ক্যাম্পাস, বাড়ছে পাখিপ্রেমিদের ভীড়। ক্যাম্পাস সাজছে নতুন রুপে। প্রতি বছরই জাহাঙ্গীরনগরের শীতের চিত্র এমন হলেও, চলমান উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে গত ৫ নবেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে গোটা ক্যাম্পাসই এখন নির্জন, গুমোট অন্ধকার। সন্ধ্যার অন্ধকারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় হাঁটতে গেলে ঝি ঝি পোকার ডাকে গা ছমছম করে, ক্যাম্পাসটা হয়ে উঠেছে ভুতুড়ে। শিক্ষার্থীদের পদচারণা নেই, গোধুলীর আভাস যেন সবুজ অরণ্য আর লাল ইটের সাথে মিশে ভারী করে তোলে ক্যাম্পাসটাকে। নেই বাড়িওয়ালা, তবু সময়ের নিয়ম মেনে চলে এসেছে অতিথি। তবে অতিথি পাখির আগমনে এই নির্জন ক্যাম্পাসের জলাশয়গুলো এরই মধ্যে প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে। পাখির কলতানে দিনভর মুখর থাকে এসব জলাশয়। অতিথি পাখির আগমন লেকগুলোতে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে। ইতোমধ্যেই পাখি আসার খবর শুনে ক্যাম্পাসে ভিড় করতে শুরু করেছেন দর্শনার্থীরা। তারা বলছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার সবচেয়ে বেশি পাখি এসেছে ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় ১২টি জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনের জলাশয়, জাহানারা ইমাম ও প্রীতিলতা হল সংলগ্ন জলাশয়, ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ সেন্টারের ভেতরের জলাশয়, সুইমিংপুল এলাকার জলাশয়ে অতিথি পাখির আধিক্য দেখা যায়। এই জলাশয়গুলো অতিথি পাখির জন্য উন্মুক্ত করে রাখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তথ্যমতে, জাবির জলাশয়গুলোতে ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম অতিথি পাখি আসতে শুরু করে। তখন ক্যাম্পাসে লেঞ্জা হাঁস, গার্গেনী, সরালিসহ ৪-৫ প্রজাতির পাখির দেখা মিলেছে। পরে ৪০-৫০ প্রজাতির পাখি এলেও গত কয়েক বছর থেকে এটা কমতে শুরু করেছে। প্রতিবছর অক্টোবরের দিকে পাখি আসলেও এ বছর সেপ্টেম্বরের শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন চত্ত্বর সংলগ্ন লেকটিতে প্রথম অতিথি পাখি আসতে দেখা গেছে বলে জনকণ্ঠকে জানান প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান। তিনি বলেন, “এ বছর এখন পর্যন্ত তিনটা প্রজাতির পাখি আসতে শুরু করেছে ছোট সরালি, বড় সরালি আর লেঞ্জা হাঁস। তবে ডিসেম্বরের মাঝামঝি থেকে মধ্য জানুয়ারি পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি পাখি আসে, সে হিসেবে আরও কিছু প্রজাতির পাখি আসতে পারে। সাধারণত হিমালয়ের উত্তরের দেশ সুদূর সাইবেরিয়া, চীন, মঙ্গোলিয়া ও নোপালে এ সময়টায় প্রচুর তুষারপাত হয় এবং তীব্র খাদ্যাভাব সৃষ্টি হয়। যে কারণে পাখিরা মানিয়ে নিতে না পেরে বাংলাদেশেরে মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে চলে আসে। এসময় অতিথি পাখি ক্যাম্পাসে আসার প্রধান কারণ হচ্ছে দেশের বাইরে থেকে এ সময় প্রচুর পরিমাণে অতিথি পাখি হাওড় অঞ্চলগুলোতে আসতে থাকে। হাওড় অঞ্চলে পাখি শিকার হওয়ায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে পাখিরা। তাই খাবার ও নিরাপত্তার কারণে পাখিগুলো শীতের শুরুতেই আমাদের ক্যাম্পাসে আসতে থাকে। অক্টোবরের শেষের দিকে প্রায় ১ হাজার পাখি এসেছে ক্যাম্পাসে। তার মধ্যে ৯৭% ছোট সরালি।” এদিকে, প্রতিবছর জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে পাখি মেলার আয়োজন করা হয়। জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে পাখিমেলার আয়োজন করা হবে বলে জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মূলত দুই ধরনের পাখির আগমন ঘটে এ ক্যাম্পাসে। এক ধরনের পাখি ডাঙ্গায় বা শুকনো স্থানে বা ডালে বসে থাকে ও বিশ্রাম নেয়। আরেক ধরনের পাখি পানিতে থাকে ও বিশ্রাম নেয়। এদের বেশিরভাগই হাঁসজাতীয় ও পানিতে বসবাস করে। এরাই সবার নজর কাড়ে। এর মধ্যে সরালি, পচার্ড, ফ্লাইফেচার গার্গেনি, ছোট জিরিয়া, পান্তামুখী, পাতারি, মুরগ্যাধি, কোম্বডাক, পাতারি হাঁস, জলকুক্কুট, খয়রা ও কামপাখি অন্যতম। এছাড়া মানিকজোড়, কলাই, ছোট নগ, জলপিপি, নাকতা, খঞ্জনা চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি, বামুনিয়া হাঁস, নর্দানপিনটেল ও কাস্তে চাড়া প্রভৃতি পাখিও আসে এই ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসের পরিবেশবাদী সংগঠন ‘সেভ দ্য ন্যাচার’-এর সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল আজিম (সৈকত) জানান, অতিথি পাখি আমাদের ক্যাম্পাসের অতিরিক্ত সৌন্দর্য। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার তুলনামুলক বেশি পাখি এসেছে এটা আমাদের জন্য আনন্দের খবর। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে জলাশয়গুলো পরিষ্কার করলে অতিথি পাখিরা অবাধে বিচরণ করতে পারবে। যে সমস্ত জলাশয়ে অতিথি পাখি পাখি বেশি আসে সেগুলো লিজমুক্ত রাখা উচিত।” এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নুরুল আমিন জনকণ্ঠকে বলেন, “ক্যাম্পাস নীরব থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অনেক বেশি পরিমাণে পাখি এসেছ। পাখিদের আবাসস্থল উপযুক্ত করতে ইতোমধ্যে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এই সপ্তাহেই জনসচেতনতামূলক নির্দেশিকা টানিয়ে দেয়া হয়েছে। গতবছরের কাঁটাতারের বেড়া এখনও ভালো থাকায় এ বছরের নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া লাগানো হয়নি।” তবে দর্শনার্থীদের জলাশয়গুলোর কোলঘেঁষে কোলাহল করা, হর্ন বাজানো, গাড়ি পার্কিং না করার নির্দেশনা নির্দেশনা থাকলেও তারা এটা মানছে না। এ বিষয়ে নিরাপত্তা শাখার দৃষ্টি আকর্ষণের কথা জানান তিনি। পাখি এসেছে তবে, ক্লাস টিউশনির ফাঁকে বন্ধুরা মিলে দলবেঁধে পাখি দেখতে যেতে পারছেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চাতকের মতো শিক্ষার্থীরা অপক্ষো করে আছে, কবে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে আর তারা অতিথি পাখির কিচির মিচির শব্দে তাদের সকালটা শুরু করবে। আড্ডার মাঝখানে কেউ হয়তো বলে উঠবে, ট্রান্সপোর্টের পাশের লেকটাতে অনেক পাখি এসছে, চল ঘুরে আসি!
×