ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

ইতিহাসের আলোয় দেখা

প্রকাশিত: ০৮:৫১, ৫ নভেম্বর ২০১৯

ইতিহাসের আলোয় দেখা

এক সময়ের অবিভক্ত অখ- উপমহাদেশ আজ তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদায় উন্নয়নের অভিযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে। ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান। ’৪৭ এর দেশ বিভাগ কতখানি শুভ-অশুভের দ্বিধা-দ্বন্দ্বে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে তার দৃষ্টান্ত ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণের নির্মম যাতনা। যা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনই পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের একনায়কত্বের বিভীষিকাময় পর্বে ষাটের দশকের স্বাধিকার আন্দোলন, শেষ অবধি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের এক যুগান্তকারী কাল পর্ব। সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় ভারতীয় উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বলয়কে জানতে হয়েছে বিষয়গত কারণে। সপ্তদশ শতাব্দীর বিখ্যাত ফরাসী পরিব্রাজক বার্নিয়ের বলেছিলেন, এ দেশে প্রবেশ করার বহু পথ আছে, বেরুবার রাস্তা সেভাবে নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস ছিল বিভিন্ন দেশ থেকে আগত উপজাতীয় সর্দার, কতিপয় মুসলিম সুলতানদের আগমন, ভ্রমণ এবং কোন এক সময় এ দেশে তাদের সাম্রাজ্যপত্তন। আমরা জানি, ১২০৪ সালে ইখিতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা লক্ষ্মণ সেনকে পরাজিত করে এদেশে মুসলিম আধিপত্যের ভিত তৈরি করেন। সারা ভারতবর্ষে তখন চলছিল সনাতন হিন্দু ধর্মের কঠোর বর্ণাশ্রম প্রথার দুর্ভেদ্য নিগঢ়ে বাধা এক অচলায়তন সমাজ ব্যবস্থার গতিহীন অবয়ব। এর আগে আমরা জানি, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়। পাক ভারত উপমহাদেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভিন্ন রাজবংশের আধিপত্য এখানকার সংগ্রামী ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরা। ইতিহাসে বিধৃত আছে, গজনীর সুলতান মাহমুদ ১৭ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেও এদেশে আধিপত্য বিস্তারে তেমন ভূমিকা রাখেননি। পরবর্তীতে মোহাম্মদ ঘোরী ভারতে মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখেন। এর পরে তুঘলক এবং খিলজি রাজবংশ ভারতবর্ষে তাদের শাসনামল বিস্তৃত করলে ভারত উপমহাদেশ সরাসরি মুসলিম রাজবংশের করায়ত্ত হয়েছে। ইতিহাসের সে সব সংগ্রামী কাল পর্ব অতিক্রমের এক ক্রান্তিলগ্নে মুঘল অধিপতি গিয়াসউদ্দিন মোহাম্মদ বাবর ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট ইব্রাহিম লোদীকে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতে দীর্ঘ এক রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। সেই ষোড়শ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের একাধিপত্যে সারা ভারতবর্ষ শাসিত এবং নিয়ন্ত্রিত ছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, সম্পদশালী ভারতবর্ষের নৈসর্গিক এবং বৈষয়িক প্রাচুর্যের অঞ্চলটি বার বার ভিনদেশী দ্বারা শাসিত এবং লুণ্ঠিত হয়েছে। ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুঘলদের সাম্রাজ্য বিস্তার এই অঞ্চলের এক অনন্য সংগ্রামী অভিযাত্রা। দেশীয় রাজা-বাদশাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দিল্লীর সম্রাটদের দোর্দ- প্রতাপ, শাসন-শোষণের অভিঘাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর অবস্থা ছিল বিবদমান এবং সাংঘর্ষিক। বাংলার বারভুঁইয়াদের সঙ্গে মুঘল সেনাপতিদের যুদ্ধবিগ্রহের ইতিবৃত্ত। ঈশা খান এবং মানসিংহের সরাসরি সম্মুখ সমরের সেই জয়-পরাজয়ের ঘটনাও সর্বজনবিদিত। রাজস্থানের সেই জয়পুরে জয়গড় ও নাহারগড়ে জয়সিংহ এবং মানসিংহের সেই আমলের রাজমহল আজও তার আপন ঐতিহ্য নিয়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। এসব দেখতে দেখতে মনে পড়ে গেল সম্রাট আকবরের সঙ্গে যোধাবাইয়ের বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কথা। কথিত আছে, আজমিরে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর দরবারে মহামতি আকবর তার আন্তরিক শ্রদ্ধা এবং ভালবাসা জানাতে গিয়ে খাজা বাবার মাজারে সেজদা দেন। দিল্লী থেকে প্রায় দশ ঘণ্টার যাত্রাপথ আজমির। সেখানে মঈনুদ্দীন চিশতীর মাজার দর্শন করতে গিয়ে অনুভব করলাম, তার আধ্যাত্মিক দর্শনের বহু কাহিনী লোকমুখে এখনও প্রচলিত। মাজার তো নয় যেন দরবার শরীফ। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান নির্বিশেষে সব মানুষই এই মহান ব্যক্তিত্বের অন্তিম শয়ানের পবিত্র স্থানটি শ্রদ্ধায়, ভক্তিতে, ভালবাসায় নিজেদের অপূর্ণ আকাক্সক্ষা জাহির করে যাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন অভাবনীয় মিলন শোভা সত্যিই বিস্ময় আর মুগ্ধতার ব্যাপার। এক সময়ের ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকেও যেতে দেখেছি আজমিরের এই বিশাল দরবার শরীফে। তখন ছাত্র জীবনের এক অদম্য কৌতূহলে ইন্দিরা গান্ধীর সাম্প্রদায়িক সহমর্মিতার অপার সম্ভাবনাকে দূর থেকে প্রণামও জানিয়েছি। এখনও তেমনই সম্প্রীতির নিদর্শন খাজা বাবার মাজারকে তার আপন ঐতিহ্যে অম্লান করে রেখেছে। দিল্লী থেকে আজমির যাওয়ার পথে রাজস্থান পার হওয়ার সময়ে চারদিকে দৃশ্যমান হলো কিভাবে এত বড় মরু ও পাহাড়ী অঞ্চলে আধুনিকতার বীজ বপিত হয়েছে। আজমির শরীফ থেকে ফেরার পথে রাজস্থানের জয়পুরে ২ দিন পার করে ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর অনেক স্থাপত্য নিদর্শন থেকে শুরু করে নতুন সময়কে অভিনন্দন জানানোÑ সবই মুগ্ধ আর বিমোহিত হয়ে অবলোকন করলাম। ¯œাতক পড়ার সময় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. অনুপম সেনের পরামর্শে জহরওলাল নেহরুর উরংপড়াবৎু ড়ভ ওহফরধ- ‘ভারত আবিষ্কার’Ñএই মূল্যবান গ্রন্থটি পড়তে হয়েছিল। সেখানে নেহরু বলেছেন, আধুনিক ভারতের স্থপতি জয়সিংহ। সত্যিই সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীর স্থাপনা নিদর্শনে যে আধুনিকতার নব্য প্রযুক্তি তাও দেখার আনন্দকে অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। জয়গড় ও নাহারগড়ের দুর্গে রাজা থেকে রানীদের নয়নাভিরাম মহল দর্শনে সত্যিই অভিভূত হলাম। দেওয়ান-ই-আমÑ যেখানে প্রজাদের সঙ্গে রাজাদের সাক্ষাত, দেন দরবার, শাস্তি, পুরস্কার সবই পরিচালিত হতো। রাজাদের মহলের সঙ্গে রানীদেরও আলাদা মহল। জয়সিংহের ১২ জন রানী ছিল, আর মানসিংহের ৯ জন। মহলের সঙ্গে আলাদাভাবে সংযুক্ত আমিষ-নিরামিষের রান্নাঘর। পাহাড়ী এলাকায় কঠিন কট্টর পাহাড় কেটে যে ভাবে মহলগুলো আধুনিক উপায়ে তৈরি করা হয়েছে তাও বিস্ময়ের সঙ্গে দর্শনকে উপভোগ্য করে তোলে। প্রধানত মরু অঞ্চলের কারণে বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা তেমন নেই। তীব্র তাপপ্রবাহে জীবন অতিষ্ঠ হওয়ার উপক্রম, তার ওপর মরুর লু হাওয়া। আর সেই আমলে ঠা-া বাতাসের ব্যবস্থা এমনকি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণকে মহলগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করা এক অবিস্মরণীয় নির্মাণশৈলী। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত পাথরের প্রাচুর্যে ভরপুর এমন সব অনন্য স্থাপনা। দেওয়ান-ই খাস হলো রাজা-রানীদের নিজস্ব মহল। অভ্যন্তরীণ কারুকার্য, নির্মাণ কৌশল, হরেক পাথরের বাহারি নৈপুণ্যÑসবই যেন এক আধুনিক শিল্প সমন্বয়ের অভাবনীয় শৌর্য। এ সবই মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনামল বিশেষ করে সম্রাট আকবরের ৪৯ বছরের সুদীর্ঘ রাজত্বকাল। জয়পুর ১৭২৭ সালে রাজস্থানের রাজধানী হিসেবে আপন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়। জয়পুরের স্থাপত্যশৈল্পিক নিদর্শন দর্শক মুগ্ধতার সম্পদ। রাজা- মহারাজাদের নিজেদের বাসযোগ্য মহলকে যে মাত্রায় সৌন্দর্যে, শিল্পে, স্থায়িত্বে অবিস্মরণীয় করা হয়েছে তেমন তুলনা ইতিহাসের গৌরবময় অংশ। জয়পুর থেকে আগ্রার পথে দেখে নিলাম ফতেপুরের সম্রাট আকবর এবং তিন রানীর মহল। সেও আর এক বৃহৎ ঐতিহাসিক স্থাপনা। এখানে আকবরের নিজস্ব মহল, সঙ্গে তিন রানীর শয়নকক্ষ। স্ত্রী রোকাইয়া মুসলিম রানী। মরিয়ম ক্যাথলিক ধর্মের পর্তুগীজ রানী আর যোধাবাই কৃষ্ণপূজারী সনাতন হিন্দু ধর্মের রাজপুত রমণী। কথিত আছে, খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর মাজারে গিয়ে তারই এক বংশধর আধ্যাত্মিক পুরুষ সেলিম চিশতিীকে আকবর আজমির থেকে ফতেপুরে নিয়ে আসেন। লোক মুখে প্রচলিতÑ তিন রানী থাকা সত্ত্বেও আকবর তখন অবধি নিঃসন্তান। যোধাবাইয়ের আকবরের সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হওয়া, সেও পিতার আন্তরিক আগ্রহে। ধারণা করা হয়, অভ্যন্তরীণ কলহ বিবাদকে সামাল দিতে এমন শুভ বিবাহের আয়োজন। তবে রাজস্থানের রজপুত নারী যোধাবাই বিয়ের আগেই সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত করতে চাইলে আকবর সানন্দে তাতে সম্মতি দেন। দেখা হয় দু’জনের মাঝে, কথাও হয়। যোধাবাই দুটো শর্ত দেন আকবরকে। নিজ ধর্ম কখনও ত্যাগ করবেন না। তিনি কৃষ্ণ ভক্ত, তাই এই দেবতাকে অর্ঘ্য নিবেদনের সর্বাবিধ সুযোগ দিতে হবে। দুঃসাহসী, রাজপুত নারীর এমন অনমনীয় প্রত্যয়ে বিমুগ্ধ সম্রাটকে সম্মতি প্রদান করতে এতটুকুও ভাবতে হয়নি। শেষ অবধি এই মহান সম্রাট তার কথা রেখেছিলেন। নিঃসন্তান আকবর সেলিম চিশতীর আধ্যাত্মিক চেতনায় সমর্পিত হয়ে তাকে সন্তান লাভের আকাক্সক্ষাও নাকি ব্যক্ত করেছিলেন। এর পরই যোধাবাইয়ের গর্ভে শাহজাদা সেলিমের জন্ম হয়। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। সেলিম চিশতীর আশীর্বাদপুষ্ট সন্তানের ডাক নাম রাখা হয় সেলিম। যোধাবাই যে শুধু সম্রাটকে পুত্র সন্তান উপহার দিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। তার চেয়েও বেশি নিজ হাতে রান্না ও পরিবেশন করে পূজনীয় পতিকে খাওয়াতেন, এমন প্রবাদও সেখানকার মানুষের মুখে মুখে। তিন রানীর মধ্যে যোধাবাইয়ের মহলই ছিল সর্ববৃহৎ। গ্রীষ্মকালের মহল আলাদা আর শীতের সময়ে অন্য মহলে থাকতেন। প্রায় সামনাসামনিই দুটো মহল। এখানেও দেওয়ান-ই আম ও দেওয়ান-ই খাস দ্বারা রাজমহল এবং প্রজামিলনের স্থান নির্ধারণ করা আছে। সে সময়ে মৃত্যুদ-প্রাপ্ত অপরাধীদের ফাঁসির কাষ্ঠে কিংবা শূলে চড়ানো হতো না। হাতির পায়ের নিচেই তাদের শেষ নিশ্বাস নির্গত হতো। ১৯৪৭ সালের সাম্প্রদায়িক দাবানলে দেশ বিভাগ অনিবার্য হলে ভারত-পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। অনেক বিপর্যয়, দেশান্তর, উগ্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সে সময়ে পাক ভারত পরিস্থিতি ছিল এক উত্তাল বিক্ষুব্ধ পরিবেশ। সেখান থেকে নিজ পায়ে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে আরও কিছু সময় অতিবাহিত করতে হয়। বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রভূমির লড়াইয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে লাল-সবুজের পতাকাকে ছিনিয়ে আনতে হয়। ভারতের এসব মধ্যযুগীয় স্থাপনা রাজা-বাদশাদের আবাসস্থল হিসেবে নির্মিত হলেও, ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় এর চিরস্থায়ী আবেদন আজও যুগের সাক্ষী হয়ে চির অম্লান ঐশ্বর্যের মর্যাদায় সমাসীন। লেখক : সাংবাদিক
×