ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ধ্বংসের পথে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ‘পাক্কা বাড়ি’

প্রকাশিত: ০২:৪০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯

ধ্বংসের পথে বরিশালের ঐতিহ্যবাহী ‘পাক্কা বাড়ি’

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ নদী বেষ্টিত বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার চরএককরিয়া এলাকায় অবস্থিত মোগল আমলের ঐতিহ্যবাহী পাক্কা বাড়িটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের উদাসীনতায় আজ বিলীনের পথে। ৩০ ফুট দৈর্ঘ্য ২১ ফুট প্রস্তের ২ ফুট ১ ইঞ্চি ব্যাসের চুন, সুরকি ও ইট দিয়ে নির্মিত পাক্কা বাড়িটি ছয় কক্ষের দ্বিতল বাড়ি। পাক্কা বাড়িকে ঘিরে চারপাশে রয়েছে প্রাচীর, সামনে বড় দিঘী, দোতালায় ওঠার সিড়ির নিচে অন্ধ কুপ, সিড়ির কোঠা লাগোয়া দেয়ালে ৬ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ গোলাকার ছিদ্র (যা দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হতো) ভিতরে প্রবেশ গেট, সামনে পুকুর থাকা সত্বেও দোতালায় চৌবাচ্চা রয়েছে। স্থানীয়রা যাকে জল পুকুর বলে থাকেন। বাড়িটির সুড়ঙ্গে প্রবেশের দরজাটির উচ্চতা ৩ ফুট ১০ ইঞ্চি। বাড়িটি নির্মান করতে ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক প্রকারের ইট, চুন ও সুরকি। বাড়িটির গঠণ প্রনালী দেখে স্থানীয়রা এ বাড়িটিকে প্রাচীন দূর্গ বলে ধারনা করছেন। বাড়িটির অবকাঠামো দেখে মনে হয় যারা তৈরি করেছিলেন তারা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্যই চারদিকে দেয়াল ঘেরা বাড়ি বা দুর্গটি তৈরি করেছেন। স্থানীয় সত্তোরর্ধো আব্দুল খালেক বিশ্বাস বলেন, ছোটবেলা থেকেই বাড়িটি এ রকমই দেখে আসছি। শিশুকালে বৃদ্ধদের মুখে শুনেছি এ বাড়িটি মোগল আমলে নির্মিত হয়েছে। তবে পাশ্ববর্তী ভোলা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে জানা যায়, ভোলার আদি নাম ছিলো দক্ষিণ শাহবাজপুর। আর সেখানকার ইলিশা নদীর উত্তরাংশে আজকের মেহেন্দিগঞ্জ, হিজলা ও মুলাদী নিয়ে তৎকালীন নাম ছিলো উত্তর শাহবাজপুর। ওই দুই জনপদে পর্তুগিজ ও আরকান জলদস্যুদের তান্ডব ছিলো ব্যাপক হারে। জলদস্যুরা নারী নির্যাতন, হত্যা, লুন্ঠন, দুর্বল মানুষদের দাস-দাসী বানিয়ে বিক্রি করার এক ভয়াবহ রাজত্ব কায়েম করেছিলো। ওই জলদস্যুদের শায়েস্তা করার জন্য স¤্রাট আকবর ১৫৮৩ খ্রীষ্টাব্দে তার সাবেক সেনাপতি শাহবাজ খানকে এ অঞ্চলে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সাহসিকতার সাথে জলদস্যুদের পরাস্ত করে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন এবং তার নামানুসারে বর্তমান ভোলা, মেহেন্দিগঞ্জ, হিজলা ও মুলাদী উপজেলায় দক্ষিণ ও উত্তর শাহবাজপুর নামে পরিচিতি পেয়েছে। সূত্রে আরও জানা গেছে, শাহবাজ খান চলে যাওয়ার পর উত্তর শাহবাজপুরের বৃহত্তামাংশে বর্তমান মেহেন্দিগঞ্জে আসেন সম্রাট আকবরের আরেক সেনাপতি আঁগা মেহেদী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বঙ্গে বিভিন্ন সময়ে মোগল সম্রাটদের প্রতিনিধিরা এসেছেন। তারা রাজত্ব করতে গিয়ে গড়েছেন প্রাসাদ, রাস্তা-দিঘী, মসজিদ, মন্দির ও গির্জা। কিন্তু পাক্কা বাড়ির আশে-পাশে মোগল আমলের কোন মসজিদ খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে আনারস বাগানের চিহ্ন। আনারস বাগানের চিহ্ন দেখে স্থানীয়রা ধারনা করছেন-পাক্কা বাড়িটি মোগল আমলের হলেও সেটি শাহবাজ খান বা আগা মেহেদীর আমলে তৈরি নয়। বরং মোগল শাসকদের থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্যই পর্তুগিজ বা আরকান জলদস্যুরা এ বাড়িটি নির্মান করেছিল। পাক্কা বাড়ির বিষয়ে স্থানীয় আশি বছরের বৃদ্ধ আসলাম আলী হাওলাদার বলেন, ছোট বেলা থেকে বাড়িটি এমনই দেখে আসছি। এখন বাড়িটির দেয়ালে গাছপালা জন্মে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাড়িটিকে ঘিরে অনেক রহস্য রয়েছে বলেও তিনি দাবী করেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য রিপন হোসেন বলেন, বর্তমানে পাক্কা বাড়ির আশেপাশে অনেক বসতি গড়ে উঠেছে। বাড়িটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকলেও সামনের দিঘীসহ চারপাশের যায়গা স্থানীয়রা দখল করে নিয়েছে। এ ব্যাপারে চর এককরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মকিম তালুকদার বলেন, ঐতিহাসিক এ বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষনের জন্য ইতোমধ্যে একাধিকবার প্রতœতাত্ত্বিক বিভাগকে অবহিত করা হলেও তারা বাড়িটি সংস্কারের জন্য কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। বরিশাল বিভাগীয় জাদুঘরের সহকারী কাষ্টরিয়ান শাহিন আলম বলেন, দেশে কোন পূরাকৃতির সন্ধান পেলে আমরা সেখানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংরক্ষনের উদ্যোগ গ্রহণ করি। মেহেন্দিগঞ্জে মোগলদের ব্যাপক বিচরন ছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাড়িটির সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে বাড়িটি সংরক্ষনের জন্য প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হবে। স্থানীয়রা মনে করছেন-ঐতিহাসিক মোগল আমলের স্থাপত্য কৃতি পাক্কা বাড়িটি সংস্কার করা হলে প্রাচীনতম এ বাড়িটিকে ঘিরে হতে পারে একটি পর্যটকন কেন্দ্র।
×