ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাহাড়ের গায়ে পৌরাণিক গন্ধ

প্রকাশিত: ১২:৩২, ৩০ আগস্ট ২০১৯

পাহাড়ের গায়ে পৌরাণিক গন্ধ

মানুষের মন কভু চেতন কভু অচেতন। মানুষের মন কখন যে কি চায় সেটা বলা মুশকিল। ক্ষণে ক্ষণেই মানুষের মনের গতিপথ পাল্টায়। কখনও বা অচেনা কষ্টগুলো ধরা দেয় আবার কখনও বা সুখগুলো চোখের পলকে হারিয়ে যায়। তখনই মানুষের মনের ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। এমন সময় মানুষের মনে নানা চিন্তার উন্মেষ ঘটে। মানুষ কঠিন সিদ্ধান্তগুলো নিয়ে ফেলে আবেগের তারনায়। আর এমন সময় যদি পাহাড়ের কাছে, প্রকৃতির কাছে যাওয়া যায় তবে অবশ্যই মনের গহীনের কষ্টগুলো কিছুটা হলেও দূরে সরে যায়। আমার মনেও এক বিষাদের ঘনঘটা ক’দিন ধরেই জ্বালিয়ে খাচ্ছিল। ভাগ্যিস কথাগুলো রূপক রায়ের সঙ্গে বিনিময় করেছিলাম। ‘রূপক রায়’ চাঁদপুর সরকারী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের একজন গুণী শিক্ষক। তিনি আমাকে সান্ত¡না দিয়ে জানালেন যখন মন খারাপ হয় তখন প্রকৃতির কাছে যেতে হয়। তার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান ‘ব্রেইভ’ চট্টগ্রামে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাচ্ছে। সেখান থেকে সীতাকু-ও যাবে। তিনি জানালেন আমি যেন তাহাদের সঙ্গে। শুনেই মোবাইল ফোনের ওপ্রান্ত থেকে আমি ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম। আমার ঘুরতে খুব ভাললাগে! প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে আমার মন সর্বদাই আনচান করে। গল্পে অনেকবারই সীতাকু-ের নানা কাহিনী শুনেছি, কিন্তু বাস্তবে তো আর দেখা হয়নি। ভাবলাম একবারে রথও দেখা হবে কলাও বেচা হবে। তারিখটা ঠিক মনে না থাকলেও মাসটা ছিল এপ্রিল। প্রচ- তাপদাহ ছিল সে সময়টাতে। একদিকে গরম অন্যদিকে মনের জমানো কষ্ট সব মিলে আমার অবস্থা খুব খারাপ। যেদিন যাব তার আগের দিনই আমি স্যারের বাসায় হাজির। রাতটা সেখানে কাটিয়ে ভোরের ট্রেনে চেপে যাব চট্টগ্রামে। সেখান থেকেই কাজ সেরে সীতাকু-। স্যার মোবাইল এ্যাপসের কাজ করছেন। সেখানে গিয়ে প্রদর্শন করবেন মোবাইল এ্যাপস। ‘গ্রাম হবে শহর’ এমন থিম নিয়েই তাঁর কাজ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে এ্যাপ তৈরি করে দেয়ার মতো কাজ হাতে নিয়েছেন। আমি বেশ খুশি কেননা সেখানে আমার কাজ করা বিদ্যাপিঠের ও এ্যাপস আছে। সময়টা ছিল ভোর সাড়ে চারটা। চোখে প্রচ- ঘুম। কিন্তু তাতে কি আমার মন তো পরে আছে সীতাকু-ের কাছে। আমাদের সফরসঙ্গী আরও দুজন আছেন। একজন জুয়েল ভাই আরেক জন সাহীদ। সাহীদ এ্যাপসের কাজ ভাল বুঝে। জুয়েল ভাই ব্রেইভ নিয়ে কাজ করেন স্যারের সঙ্গে। আমরা চারজনে চাঁদপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হলাম। ট্রেনে চড়ার মজাই আলাদা। এটাই আমার প্রথম বড় যাত্রার ট্রেন সফর। বিষয়টি নিয়ে তাই আমিও বেশ উৎফুল্ল। ট্রেনে করে যেতে যেতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগেই আমরা ব্যস্ত ছিলাম। রূপক স্যারের কাছে এ পথটা বেশ পরিচিত। তিনি বহুবার এ পথে চলাচল করেছেন। আমার আর জুয়েল ভাইয়ের কাছে এ রুটটি নিয়ে ছিল বেশ কৌতূহল। খোশ গল্পে আমরা মেতে উঠলাম। আামাদের ছিল কেবিন। হঠাৎ করেই ট্রেনের মৃদু ঝাঁকুনিতে আমাদের চোখে ঘুম ঘুম ভাব চলে এলো। তবে ঘুমালাম না। কারণ ঘুমাতে ঘুমাতেই নাকি আমরা জীবনের অর্ধেকটা সময় কাটিয়ে দেই। তাই ভাবলাম ঘুমকে ছুটিতে পাঠিয়ে আমরা একটু জীবনটাকে উপভোগ করি। ট্রেনে করে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়ই চোখে পড়ল পাহাড়। আমি বেশ কৌতূহলবশত স্যারের কাছে জানতে চাইলাম এগুলো কিসের পাহাড়। স্যার জানাল আমি যে পাহাড়গুলো দেখছি এটিই নাকি সীতাকু- পাহাড়। তবে সীতাকু- রেলস্টেশনে আমাদের ট্রেনটি থামবে না। তাই আমাদের চট্টগ্রাম থেকেই সড়কপথে এখানে আসতে হবে। মনটা তো আরও বেশি ছটপট করতে লাগল কখন যে এই পাহাড়ের বুকে যেতে পারব! স্যার জানাল, বুঝলে রিফাত আজ রাতে আমরা এই পাহাড়ের চূড়ায় একটি মন্দিরে রাত কাটাব। এটা শুনে আমার ভাললাগার মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল। বললাম, ঠিক আছে স্যার। দেখতে দেখতে আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছে গেলাম। সেখানে ইনোভেশন শোকেসিং এ অংশ নেব আমরাও। আমাদের প্রিয়, হারুন-অর রশিদ ভাইও সেখানে আছেন। তিনি চাঁদপুর ডিসি অফিসের একজন কর্মকর্তা। মিষ্টভাষী এবং খুব ভাল মনের মানুষ। সেখানে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া শেষে আমরা সেদিনই মনস্থির করি আমরা যাব সীতাকু-। এদিকে সীতাকু- শংকর মঠের একজন মহারাজের সঙ্গে রূপক স্যারের বেশ সখ্যা। কি অদ্ভুত মিল তার নাম ও ‘রূপক’। ওই মুহূর্তে তিনি চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। আমাদের আসার কথা শুনে তিনি জানালেন সীতাকু-ে তিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন মন্দিরের গেস্ট হাউজে। আমরা ছুটলাম সীতাকু-ের দিকে। যেতে যেতে পাহাড়ের সৌন্দর্য আমাদের হৃদয়কে রাঙ্গিয়ে তোলে। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল তখন আমি আর রূপক স্যার এসে পৌঁছাই সীতাকু-ে। রূপক মহারাজ আমাদের থাকার জন্য রুম দেখিয়ে দেন। মন্দিরেই খাওয়ার ব্যবস্থা আছে বলে জানান। আমাদের সঙ্গে আসা জুয়েল ভাই এবং সহীদ ইনোভেশন প্রোগ্রামে থাকায় তাঁদের আসতে একটু দেরি হচ্ছে। আমরা দুজন ফ্রেশ হয়ে খাবার খাওয়ার জন্য মন্দিরের দিকে ছুটলাম। শংকর মঠ মন্দিরটি পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের চূড়ায় উঠছি আর ভাবছি সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা কতই না বিচিত্র, নইলে পাহাড়ের উপরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে একটি মন্দির। মাঝে মাঝে আমার আবার জাগতিক চিন্তা ধরা দেয়। তখন মনে হয় তীর্থস্থানই হলো যেন আসল ঠিকানা। যা ই হোক সেখানে খাবার খেয়ে আমরা আবার কক্ষে ফিরে এলাম। এর ফাঁকে দেখলাম সেখানে একঝাঁক শিশুরাও খাবার খাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তাঁরা নাকি অসহায়, এতিম শিশু। এখানেই তারা থাকে এবং খায়। শংকর মঠ কর্তৃপক্ষই তাঁদের দেখভাল করে। শুনে খুব ভাল লাগল। এবার পাহাড়ের দৃশ্য দেখার পালা। কিছুক্ষণের মধ্যেই জুয়েল ভাই এবং সহীদ এসে হাজির। আমরা সবাই মিলে চন্দ্রনাথ মন্দিরের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। সেখানটাতে ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যদিও চন্দ্রনাথ মন্দিরে উঠিনি তবে রূপক স্যারের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করলেন। আমি তো দূর থেকে এর সৌন্দর্য দেখে বিমোহিত। এর ফাঁকে আমরা পাহাড়ী বেল ও খেলাম। সেখানকার বেল বেশ সুস্বাদু।
×