ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এডিসসহ মশামাছি ঠেকাতে গাঁদাফুল তুলসী পাতা

প্রকাশিত: ১০:৪৬, ৩০ আগস্ট ২০১৯

এডিসসহ মশামাছি ঠেকাতে গাঁদাফুল তুলসী পাতা

শাহীন রহমান ॥ এডিস মশা বা অন্যান্য মশামাছি প্রতিরোধে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল একটি কার্যকর পদ্ধতি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, এই পদ্ধতিতে বিশেষ করে গাঁদা ফুল, তুলসীপাতা, পুদিনা পাতা, ব্যাজল, সিট্রোনেলা, লেমন গ্রাস, ল্যাভে-ার ইত্যাদি খুবই কার্যকর। তারা বলেন, সাধারণত এসব গাছ অনেকেই সৌন্দর্য বর্ধনের কাজে বা ঔষধি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এসব গাছ, লতাগুল্ম ব্যবহার করে ঘরের অভ্যন্তরে বা চারপাশের মশামাছির প্রকোপও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ বছর ডেঙ্গুজ্বর সারাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সারাদেশে এ বছর ৬০ হাজারের বেশি মানুষ এই জ্বরে আক্রান্ত। রাজধানী ছাড়িয়ে এখন প্রত্যন্ত পল্লীতে এখন এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই মূলত এই ধরনের কীটপতঙ্গের প্রকোপ বাড়ে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহম্মেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জীববৈচিত্র্যের প্রভাবে মশার বংশবিস্তার বেড়েছে। বিশ^ব্যাপী তাপমাত্রা চরমে উঠেছে, যার ফলে মশা বিস্তার বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ক্লান্তিলগ্নে দেশের স্কুল-কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্থানীয় নেতাকর্মী ও বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাকে ব্যবহারের মাধ্যমে মশার আবাসস্থল ধ্বংসের আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে বায়োজিক্যাল কন্ট্রোল পদ্ধতি অর্থাৎ এসব উদ্ভিদের ব্যবহারের মাধ্যমে এডিস মশা প্রতিরোধ করা সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গাঁদা ফুল দেশে একটি সহজলভ্য গাছ। প্রায় সব জায়গায় পাওয়া যায়। অথচ এটি মশা তাড়াতে দারুণ কার্যকর। এই ফুলের মনোমগ্ধকর ঘ্রাণে এটি সবার কাছে প্রিয় বটে, কিন্তু এই ফুলের রেণু ও পাপড়ি থেকে নিঃসৃত বিশেষ গন্ধ মশার জন্য অসহনীয়। ঘরে গাঁদা ফুল রাখলে মশামাছি থাকে না। আবার ঠা-াজনিত সর্দির প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে অনেকে বাড়িতে তুলসীগাছ রোপণ করে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রত্যেকের বাড়িতে ধর্মীয় কারণেই তুলসী গাছের ব্যবহার রয়েছে। এই গাছের ঔষধি গুণ ছাড়াও মশা নিয়ন্ত্রণে এটি বেশ কাজ করে থাকে। অধ্যাপক মজুমদার বলেন, ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে পুদিনার তেল মশার লার্ভার জন্য খুবই বিষাক্ত। এটি মশার ডিম সরবরাহের হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এর তীব্র গন্ধ মশা দূরীকরণের বেশ ভূমিকা রাখে। অথচ আমরা অনেকেই পুদিনার পাতা সালাদ হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এটি মশা দূরে রাখতে সাহায্য করে থাকে। আর ব্যাজল হলো পুদিনা পাতা বা ধনিয়াপাতার মতোই সুগন্ধযুক্ত লতাগুল্ম। ব্যাজলের পাতা খাবারের স্বাদ বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এই গাছ মশা তাড়ানোর কাজ করে থাকে। কারণ ব্যাজলের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। সিট্রোনেলা এক ধরনের ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ। এটি পাঁচ-ছয়ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ঘাস থেঁতলে তেল বা রস বের করে পানিতে মিশিয়ে ঘর মুছলে মশার উপদ্রব কমে। ল্যাভে-ার এক ধরনের সুগন্ধি গাছ। এতে বেগুনী রংয়ের ফুল ধরে, যার সুগন্ধ মশার অপছন্দ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব উদ্ভিদ ছোট আকারের তাই সহজেই ঘরের আঙ্গিনায় ফুলবাগানে বড় বাগানের ধারে, বারান্দা কিংবা জানালার পাশে টবে লাগানো যায়। তবে টবে পানি জমিয়ে রাখা যাবে না। ব্যাজল গাছের জন্য প্রচুর পানি ও সূর্যের আলো দরকার। যেখানে আলো আর পানি বেশি থাকবে এটি সেখানে লাগাতে হবে। এই গাছে দেয়া পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। সিট্রোনেলা গাছেও পানি নিষ্কাশন ও আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। তবে পুদিনা গাছকে সরাসরি সূর্যের আলো থেকে দূরে রাখতে হবে। তারা বলেন এসব গাছ টবে অন্যান্য গাছের সঙ্গে লাগানো হয় তবে ভুলবশত টবে যে পানি জমে থাকে সেখানে আর মশার বংশ বিস্তার করতে পারবে না। এর ফলে একদিকে যেমন মশার উপদ্রব কমবে, তেমনি ঘর বা চারপাশের পরিবেশ সুন্দর থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব গাছ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তারা বলেন, গাপ্পিমাছও মশার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ মাছ ছোট আকারের। কম অক্সিজেনযুক্ত ও অপেক্ষাকৃত দূষিত পানিতেও এই মাছ বেঁচে থাকতে পারে। এই মাছের গড়আয়ু তিন থেকে চার বছর হয়ে থাকে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মতে এই মাছ প্রতি ঘণ্টায় ২শ’ মশার লার্ভা খেয়ে ফেলতে পারে। ডোবানালা, পুকুর, সুইমিংপুল, ড্রেন এ্যাকুরিয়ামের মধ্যেও এই মাছ চাষ করা যায়। এতে মশার উপদ্রব কমে। গাপ্পি মাছ মশার জীবনচক্রের সব অবস্থাতেই (ডিম, শুক মুক কীট এবং পূর্ণাঙ্গ মশা) খেয়ে ফেলতে পারে। তারা বলেন মশামাছির উপদ্রব দেশে নতুন নয়। সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ মশা নিয়ন্ত্রণে নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে আসছে। বিশেষ করে ঘরে ধূপ দেয়া হলে মশা থাকে না। অনেকে ঘরের মধ্যে নিমগাছের ডাল রেখে দেন। কখনো কখনো আবার নিম গাছের ডাল পোড়ানো হয় মশা তাড়াতে। আগের দিনে মশার উৎপাত থেকে মুক্তির জন্য বদ্ধঘরে কর্পূর পোড়ানো হতো। কর্পূর মশা তাড়াতে একটি কার্যকর উপাদান। এটি মশা তাড়াতে দীর্ঘ সময় কাজ করে। গ্রামের মানুষ খোসা ছাড়া রসুন বা রসুন মিশ্রিত পানি মশার বিষাক্ততা থেকে রক্ষার জন্য ব্যবহার করতেন। আগের দিনে মানুষ মশা নিয়ন্ত্রণে রাসায়নিক উপায়ের ওপর কম নির্ভর করত। প্রকৃতিকে কাজে লাগিয়েই তারা নিজেদের মশার কামড় থেকে রক্ষা করত। এখন সময় এসেছ মশা নিয়ন্ত্রণে এসব জ্ঞান ব্যবহারের।
×