ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘বেঙ্গল ॥ দ্য মার্ডার অব পিপল’

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ১০ আগস্ট ২০১৯

 ‘বেঙ্গল ॥ দ্য মার্ডার অব পিপল’

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ১০ আগস্ট দিনটি ছিল মঙ্গলবার। এই দিন সিলেটে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে পাঁচ কোম্পানি যোদ্ধা পাকবাহিনীর শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশন অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দু’ঘণ্টা যুদ্ধ শেষে মুক্তিবাহিনী শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দখলকৃত এলাকায় পাকিস্তানী পতাকা ধ্বংস করে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। এ পর্যায়ে হঠাৎ পাকসেনারা আর্টিলারি আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনীর এ পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং পিছু হটে। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী প্রচুর গোলাবারুদ উদ্ধার করলেও ইপিআর হাবিলদার কুতুব, নায়েক মান্নান ও মুজাহিদ হাবিলদার মোহাম্মদ ফয়েজসহ ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৫ জন আহত হন। ৪নং সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টরে মুক্তিবাহিনী পাকহানাদার বাহিনীর সহযোগী রাজাকারদের চতুলবাজার ঘাঁটি আক্রমণ করে। এতে ৩ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয় ও ২ জন নিহত হয়। ক্যাপ্টেন সালেক এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে শালদা নদীর পশ্চিমে সিএ্যান্ডবি রোডের কাছে শিদলাই নামক গ্রামে ঘাঁটি স্থাপন করেন। মুক্তিবাহিনী দিরাই এলাকায় ডাকাতদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং ২১ ডাকাত নিহত হয়। এ ছাড়াও তারা একটি হাল্কা মেশিন গান, আটটি রাইফেল, ২১টি শটগান, চারটি গ্রেনেড এবং কিছু গোলাবারুদ জব্দ করে। দিরাই এলাকায় একটি পাক সমর্থকের বাড়ি ধ্বংস করে। টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এলাকার বিশাল এক জঙ্গল এলাকার নিয়ন্ত্রণ ছিল কাদেরিয়া বাহিনীর হাতে। একজন বেসামরিক ব্যক্তি হয়েও কাদের সিদ্দিকী গড়ে তুলেছিলেন বিশাল বাহিনী। অনবদ্য এক রণকৌশল এবং সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল এ বাহিনী। ৫ আগস্ট, ১৯৭১ সাল। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর এক ওয়্যারলেস বার্তা ধরে ফেলে। সদরঘাটে কয়েকটি বড় বড় জাহাজে অস্ত্র বোঝাই করা হচ্ছে। গন্তব্য বগুড়ার ফুলতলি, তারপর রংপুর। উল্লেখ্য, তখন মুক্তিবাহিনী সীমান্ত সংলগ্ন বিওপিগুলোতে অতর্কিত হামলা শুরু করেছে। তাই উত্তরের সীমান্তে বাড়তি অস্ত্র পাঠানো। কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ করা এলাকার ভেতর দিয়েই যাবে জাহাজগুলো। ইউএসএ ইঞ্জিনিয়ারিং এলসি-৩ এবং এসটি রাজন নামের দুই জাহাজ। টাঙ্গাইলের ভূয়াপুর ঘাট ঘেঁষে যাবে জাহাজগুলো। এই জায়গা বেছে নেয়ার কারণ হলো পানির কম গভীরতা এবং সামনে থাকা কিছু চর। দেশব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর অস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানি ও রসদ বোঝাই ৭টি ছোট-বড় জাহাজ ধলেশ্বরী নদী তীরবর্তী সিরাজকান্দিতে নোঙ্গর করে। এসব অস্ত্র, গোলা বারুদ, জ্বালানি উত্তরবঙ্গের ফুলছড়ি ঘাটের মাধ্যমে রংপুর, সৈয়দপুর ও ধানুয়া কামালপুরসহ সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পৌঁছানোর পরিকল্পনা ছিল। জাহাজগুলো মুক্তিযোদ্ধা ও পাক হানাদার বাহিনী উভয়ের জন্যই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুক্তিবাহিনীর ভূয়াপুর আঞ্চলিক দফতরকে কড়া সতর্কতায় রাখা হয়। দায়িত্ব পান কমান্ডার হাবিব। ১০-১৫ জন সেরা যোদ্ধা বাছাই করেন তিনি। বিশালাকারের জাহাজগুলোতে বেশ ক’টি বড় শহর একেবারে জ্বালিয়ে দেয়ার মতো গোলাবারুদ ছিল। কমান্ডার হাবিব মোতাহার, জিয়া এবং জামশেদকে নিয়ে জেলের ছদ্মবেশ ধারণ করে আক্রমণের আগে আরও তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেন। বিপদ আসার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জাহাজের কাছে গিয়ে তিনি মাছ ধরতে শুরু করেন। একপর্যায়ে টহল স্পিডবোটের মুখোমুখিও হয়েছিলেন তারা। পাকবাহিনীর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন তারা। যুদ্ধের ক্লান্তিতে থাকা পাক সেনারা জানতে চায় তাজা খাবারের কথা। তরতাজা মুরগি আর চমচমের খোঁজ দেন তাদের। কৌশলে জেনে নেন দরকারি তথ্যগুলো। যেমন- সব জাহাজের লোক খাওয়াতে কয়টা মুরগি চাই? জানা গেল, ভেতরে অন্তত ১ ব্যাটালিয়ন সেনা আছে। এই ১০-১৫ জনের দল কয়েক মিনিটও টিকতে পারবে না। রিইনফোর্সমেন্টের বদলে আসল এক রহস্যময়ী বার্তা। ‘এই মাত্র সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে, সুবিধামতো অবস্থান থেকে শুধু আক্রমণ কর, আক্রমণ করা মাত্রই জাহাজের পতন ঘটবে’ এই বার্তার মর্মোদ্ধার করতে পারে না কেউই। তবে সবাই বুঝতে পারে, ভাল কিছুর ইঙ্গিত করা হয়েছে। হয়ত গোপন কিছু আছে যেটা আক্রমণের আগে কাউকে জানানো ঠিক হবে না। ১০ আগস্ট মাটিকাটা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম একটি শক্তিশালী দল নিয়ে পজিশন নেন। এই দলটিতে ৩ ইঞ্চি মর্টার ছিল। এ ছাড়াও আশপাশে আরও কয়েকটি দল পজিশন নেয়। গভীর রাতে কমান্ডার হাবিব নদীর কিনারে গিয়ে দেখে আসেন হানাদাররা কী করছে। কমান্ডার হাবিব এর নেতৃত্বে সাহসী মুক্তিযোদ্ধাগণ জাহাজ ২টি আক্রমণ করে। আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে শাহবাজপুরের সবুজপুর (লাটু) রেলওয়ে স্টেশন অপারেশনের মাস্টার প্লান সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল চিত্তরঞ্জন দত্ত পর্যালোচনা করেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার উড প্রয়োজনীয় আর্টিলারি সাপোর্ট দেয়ারও প্রতিশ্রুতি দেন। পুরো এলাকা ৩১ পাঞ্জাবের এক প্লাটুন এবং এক প্লাটুন অস্ত্রধারী রাজাকার দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। শত্রুর ঘাঁটিতে সরাসরি হামলা চালানোর সহজ কোন উপায় ছিল না। তবুও মুক্তি সেনারা হামলা চালাতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। আজকের দিনটিকে বেছে নেয়া হলো অপারেশনের জন্য। মুক্তির দলে ৫টি কোম্পানি রাখা হয় অপারেশনের জন্য। রেকি কার্যক্রম শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সামনা সামনি হামলা করার, এ ছাড়া আর কোন উপায়ও ছিল না, কিন্তু সেটা হবে অনিয়মিত উপায়ে। এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধাকে বিয়ানীবাজার থেকে শত্রুর সংযোগ লাইন কেটে দেয়ার কাজে নিয়োজিত করা হলো। তাদের ওপরই দায়িত্ব পড়ে পেছন দিক দিয়ে শত্রুর ওপর প্রথমে হামলার সূচনা করার। হামলার সূচনা করার ঠিক ১০ মিনিট পরে তাঁরা ফায়ারিং বন্ধ করবে। এর পরে তাঁরা পিছু হটবে এবং একই সময়ে এক ব্যাটালিয়ন মিডিয়াম গান শত্রুর ওপর ফায়ারিং করবে তাদের ব্যস্ত রাখতে। ৫ মিনিটের জন্য শেলিং করা হবে এবং তারপরে ৩ কোম্পানি সামনা সামনি শত্রুর ওপর হামলা চালাবে। অবশিষ্ট এক কোম্পানি শাহবাজপুর-বড়লেখা রাস্তায় পজিশন নিয়ে থাকবে, যাতে সেখানে শত্রুরা জমায়েত হতে না পারে। ৫টার দিকে মুক্তির সব কোম্পানি তাদের নিজ নিজ নির্ধারিত পজিশনে অবস্থান নেয়। কোম্পানিগুলোর নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের কোন উপায় ছিল না। অন্য ২ কোম্পানির কাজ এতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, তাঁরা যদি শত্রুর সাপ্লাই লাইন বন্ধ করতে না পারে, তাহলে পুরো অপারেশনটা ফেল করবে। শত্রুর বাঙ্কার অবস্থান মাটির এত গভীরে খনন করা ছিল যে, মিডিয়াম গানের শেলিং তেমন কোন ক্ষতি করতে পারছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা পুরো শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল শত্রু হননে। ১৫ মিনিটের মধ্যে শত্রু বাহিনী পিছু হটা শুরু করল। ৭টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা শাহবাজপুর রেলওয়ে স্টেশনের একটা বড় অংশ থেকে হানাদারদের উচ্ছেদ করে। শত্রুর যেই অবস্থান থেকে সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধ আসছিল, সেখানে চার্জ করল মুক্তির দল। গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে মুক্তির কমান্ডো বাহিনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। এরই মধ্যে খবর এলো হানাদার সৈন্যরা বাম দিকে জড়ো হচ্ছে। বড়লেখা থেকে সাপ্লাই লাইন বন্ধ করে দেয়ার এবং তাদের পুনরায় একত্রিত হতে বাধা দেয়ার যেই দলের দায়িত্ব ছিল, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে এবং পাকিস্তানীরা, মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানে আর্টিলারি শেলিং শুরু করে। লে. কর্র্নেল দত্ত নির্দেশনা দিলেন অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে। অবশেষে মুক্তিফৌজ পিছু হটে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। সেদিন ওখানে ৮ জন শত্রু সেনার লাশ পড়েছিল এবং হতাহতের সংখ্যা ৫০ এর মতো। মুক্তিফৌজের ৬ জন শহীদ আর ৫ জন আহত হন। এই দিন চারটি চা বাগানসহ ২০ বর্গমাইল এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিফৌজের দখলে আসে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×