ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

খাদের কিনারায় সুদান

প্রকাশিত: ১২:৩৩, ৩ জুলাই ২০১৯

খাদের কিনারায় সুদান

সুদানকে নিয়ে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল তা বেশিদিন টিকেনি। মাসের পর মাস গণবিক্ষোভের পর গত এপ্রিল মাসে সেখানকার এক স্বৈরশাসক ক্ষমতাচ্যুত। ত্রিশ বছর ধরে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাসির এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারান। বাসির পশ্চিমাঞ্চল দারফুরে গণহত্যা চালিয়েছিলেন। তার তীব্র নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে বিশাল দেশটির এক- তৃতীয়াংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তার সরকারের নিষ্ঠুরতা ও অর্থ লোলুপতার কোন সীমা-পরিসীমা ছিল না। তার পতনে রাজধানী খার্তুমে জনতা আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেও তাদের হতাশ হতে সময় লাগেনি। বাসিরের পতনের পর যে অন্তর্বর্তী সামরিক পরিষদ ক্ষমতা দখল করে জনগণের প্রত্যাশা ও দাবি অনুযায়ী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোন অভিপ্রায় তাদের নেই। সেটা আরও পরিষ্কার হয়ে ওঠে ৩ জুন। এদিন র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামে একটি আধাসামরিক গ্রুপ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে শুরু করে। তারা গুলি করে এক শ’ কি তারও বেশি লোককে হত্যা করে। কাউকে কাউকে সেতুর ওপর থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়। তারপর থেকে আর এসএফ রাজধানী খার্তুমকে সন্ত্রস্ত অবস্থায় রেখেছে। তারা দোকানে ঢুকে জিনিসপত্র লুটে নিচ্ছে। নারীকে ধর্ষণ করছে। এদের উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। তাহলো সিভিলিয়ানদের মনে এমন আতঙ্ক সৃষ্টি করা, যাতে করে তারা নির্বাচন ও গণতন্ত্রের আশা পরিত্যাগ করে বসে। অবশ্য ক্ষমতায় বসা সামরিক পরিষদ বা জান্তা মোটেও ঐক্যবদ্ধ নয়। র্আএসএফের জবাবদিহিতা জান্তার উপপ্রধান হামদান দাগালোর কাছে। ইনি একজন যুদ্ধবাজ, যিনি হেমেদতি ডাকনামে পরিচিত। তত্ত্বগতভাবে তিনি জান্তার চেয়ারম্যান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল-বুরহানের জুনিয়র হলেও দাগারোই সুদানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছেন। ভাড়াটে খুনীদের খার্তুমজুড়ে তা-ব চালানোর সুযোগ দিয়ে তিনি সম্ভবত এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চাইছেন যেÑ তিনি সুদানের প্রেসিডেন্ট হতে চান এবং যেই তার এই ইচ্ছার পথে বাদ সাধবে তার বিরুদ্ধেই কঠোর ব্যবস্থা নেবেন। জান্তার অন্য সদস্যরা এতে অসন্তুষ্ট। নিয়মিত সেনাবাহিনীর অফিসাররা দাগালোর এই উচ্চাভিলাষের ঘোরতর বিরোধী। উচ্ছৃঙ্খল মিলিশিয়ারা রাজধানীতে যেভাবে লুটপাট চালাচ্ছে তাতে তারা রীতিমত ক্রুদ্ধ। জান্তার এই বিভাজন দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। অসংখ্য বিরোধ ও সংঘাতে পরিপূর্ণ সুদান। একটি বিরোধের অবসান হয় যখন অমুসলমান ও কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানপ্রধান দক্ষিণাঞ্চল ২০১১ সালে মুসলমানপ্রধান উত্তরাঞ্চল থেকে আলাদা হয়ে যায়। দক্ষিণ সুদানেই রয়েছে অধিকাংশ তেলখনি। ফলে খার্তুমের হাতে তেল থেকে প্রাপ্ত আয় অনেক কম। নগদ অর্থের অভাবে উত্তরের অনেক দল-উপদলকে কিনে নেয়ার মতো সঙ্গতি খার্তুমের নেই। বাসির এই উপদলগুলোর একটিকে অপরটির বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়ে তিন দশকে ক্ষমতায় থেকে যেতে পেরেছিলেন। তার শাসনের বিরুদ্ধে যাতে অভ্যুত্থান না ঘটতে পারে তার জন্য তিনি সেনাবাহিনী, আরএসএফ এবং গোয়েন্দা বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিয়েছিলেন। এখন এই পক্ষের সবাই একে অপরকে অপছন্দ ও অবিশ্বাস করে। গত এপ্রিলে বাসির গোয়েন্দা সার্ভিসগুলোকে রাজপথে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকরাই জনতাকে রক্ষা করেছিলেন। গৃহযুদ্ধ ঠেকানোর জন্য জেনারেলরা মি. জাগালোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাসিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল। এখন তাদের মধ্যেই বিরোধ শুরু হয়ে গেছে। পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে বাইরের শক্তিগুলো এই বিরোধে জড়িয়ে পড়ার কারণে। মিসর, সৌদি আরব ও আমিরাত জান্তার সমর্থক। তারা নগদ ৩শ’ কোটি ডলার সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু জান্তার মধ্যে তারা আবার ভিন্ন ভিন্ন শক্তিকে সমর্থন দেয়। মিসর সেনাবাহিনীর সমর্থক। প্রতিবেশী দেশের ইসলামপন্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা রক্তপিপাসু মিলিশিয়াদের মিসর দেখতে পারে না। অন্যদিকে সৌদি আরব ও আমিরাত দাগালোকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। কারণ, তার মিলিশিয়া বাহিনী ইয়েমেনে এই দেশ দুটির উদ্দেশ্যহীন যুদ্ধে হাজার হাজার পদাতিক সৈন্য যুগিয়েছে। এদিকে সামরিক জান্তার দমন-পীড়ন সত্ত্বেও গণতন্ত্রপন্থীদের বিক্ষোভ মাঝে মধ্যেই হচ্ছে। ওদিকে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে। সৈন্যরা আরএসএফের হাত থেকে খার্তুমকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র চাইছে। অনেকের আশঙ্কা, সুদানে প্রকাশ্য যুদ্ধ বেধে যেতে পারে এবং সেই যুদ্ধে সিরিয়ার যেমন হয়েছিল তেমনি বাইরের শক্তিগুলোও জড়িয়ে পড়তে পারে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×