ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শুল্ক পুনর্নির্ধারণ ও পুঁজি বাজারে প্রণোদনা

প্রকাশিত: ১০:০৫, ৩০ জুন ২০১৯

 শুল্ক পুনর্নির্ধারণ ও পুঁজি বাজারে প্রণোদনা

সংসদ রিপোর্টার ॥ পুঁজিবাজারে প্রণোদনা ও ভ্যাটে কিছুটা সংশোধন এনে জাতীয় সংসদে অর্থবিল ২০১৯ পাস হয়েছে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের ওপর আরোপিত ১০ শতাংশ কর বহাল রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কেউ চাইলে যেন ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে রেয়াত পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে নতুন আইনে সে বিধান আনা হবে। তাঁত শিল্পের ওপর ৫ শতাংশ মূসকের পরিবর্তে প্রতি কেজিতে ৪ টাকা হারে সুনির্দিষ্ট হারে মূসক আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া দেশী শিল্প রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। দেশীয় মুদ্রণ শিল্পে প্রণোদনা ও বন্ড ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধ করতে দেশে উৎপাদন হয় না এমন পেপার মিলের শুল্ক হার যৌক্তিক করা হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানিকৃত কতিপয় পণ্যের শুল্ক হারও পুনর্নির্ধারণ করা হয়। তবে বহুল আলোচিত সঞ্চয়পত্রে উৎসে কর কমানোর কোন সংশোধন করা হয়নি অর্থ বিলে। বাজেট আলোচনার সমাপনী টানতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে যোগ দিলেও অসুস্থতার কারণে তার অনুরোধে অর্থবিল ২০১৯ সংসদে উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবশ্য বাজেট আলোচনার সমাপ্তি টানতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যেভাবে সমৃদ্ধশালী হচ্ছে, আমরা আশা করছি, আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ আর কারও কাছ থেকে ঋণ নেবে না, ঋণ দেবে। তিনি বলেন, গত ১০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে যেখানে নিয়ে গেছেন সেখান থেকে বাংলাদেশকে আর কেউ পেছাতে পারবে না। আমরা এখন কেবল এগিয়েই যাব। আমাদের বিদেশী ঋণ জিডিপির ৫ শতাংশ। উন্নয়নশীল অনেক দেশের ঋণই তাদের জিডিপির পাঁচ শতাংশের বেশি। সবচেয়ে কম ঋণ জিডিপি অনুপাত নিয়ে বিশ্বে আমরা এক ইউনিক’ দেশে পরিণত হয়েছি। অর্থবিল পাসের আগে যেসকল সংশোধনী আনা হয়েছে তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোন কোম্পানি যে পরিমাণ স্টক ডিভিডেন্ট প্রদান করবে, একই পরিমাণ নগদ ডিভিডেন্ট দেবে। এক্ষেত্রে স্টক ডিভিডেন্টের পরিমাণ নগদ ডিভিডেন্টের চেয়ে বেশি দেয়া হয় সেক্ষেত্রে সকল স্টক ডিভিডেন্টের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর প্রদান করা হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে এটি ১৫ শতাংশ করা হয়েছিল। এছাড়া পুঁজিবাজারে কোন কোম্পানির পরবর্তী নিট লাভের ৭০ শতাংশ রিটেইন আর্নিংস, রিজার্ভসহ বিভিন্ন খাতে স্থানান্তর করতে পারবেন। বাকি ৩০ শতাংশ স্টক, ডিভিডেন্ট ও নগদ লভাংশ দিতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যর্থ হলে প্রতিবছর রিটেইন আর্নিংস ও রিজার্ভসহ স্থানান্তর মোট অর্থের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। শেয়ার বাজারের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকায় উন্নীত করা হবে। স্থানীয় পর্যায়ে একাধিক মূসক হার প্রচলন করা হচ্ছে। তবে ১৫ শতাংশের নিম্নের হারগুলোতে উপকরণ কর রেয়াত নেয়ার সুযোগ না থাকায় ব্যবসায়ীরা হ্রাসকৃত হারের পরিবর্তে উপকরণ কর গ্রহণ করে ১৫ শতাংশ হারে কর প্রদানে সুযোগ সৃষ্টির জন্য দাবি করেছেন। হ্রাসকৃত হারের পাশাপাশি কেউ চাইলে যেন ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে রেয়াত পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে পারে নতুন আইনে সে বিধান আনা হয়েছে। এছাড়া তাঁত শিল্পের ওপর ৫ শতাংশ মূসকের পরিবর্তে প্রতিকেজিতে ৪ টাকা হারে সুনির্দিষ্ট হারে মূসক আরোপ করা হবে। দেশী শিল্প রক্ষায় প্রস্তাবিত বাজেটে বেশ কিছু শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধি করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের কাগজ ও গ্যাস উৎপাদনকারী শিল্প যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। দেশীয় মুদ্রণ শিল্পে প্রণোদনা ও বন্ড ব্যবস্থার অপব্যবহার রোধ করতে দেশে উৎপাদন হয় না এমন পেপার মিলের শুল্ক হার যৌক্তিক করা হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে আমদানিকৃত কতিপয় পণ্যের শুল্ক হার পুনর্নির্ধারণ করা হবে। অর্থমন্ত্রী শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ হওয়ায় তার অনুরোধে এবারই প্রথম অর্থ বিল পাসের প্রস্তাব উত্থাপন করে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থবিল উত্থাপনের পর বিরোধী দলের সাত জন সদস্য বিলটি জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব করেন। তবে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। নাকচ হওয়ার আগে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাবগুলের ওপর বক্তব্য রাখেন জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, পীর ফজলুর রহমান, কাজী ফিরোজ রশীদ, বেগম রওশন আরা মান্নান, রুস্তম আলী ফরাজী এবং বিএনপির রুমিন ফারহানা এবং গণফোরামের মোকাব্বির খান। তাদের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি যে মনোনয়ন বাণিজ্যটা করেছে সেই টাকাগুলো কোথায় রেখেছে খোঁজ নিলেই সুইচ ব্যাংকের হিসাবটা মিলে যাবে। বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য বলেছেন, টাকা সুইচ ব্যাংকে যাচ্ছে। উনি যাদের (বিএনপি) এত প্রশংসা করেন, যাদের কথা বেশি বলেন তাদের কথাটাই সুইচ ব্যাংকের তালিকায় বেশি এসেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাজেট উত্থাপনের পর প্রত্যেকের কথা বলার অধিকার আছে। মন্ত্রীরা একমত কি না, বা সংসদ সদস্যরা একমত কি না প্রশ্নের জবাবে বলেন। বাজেট যখন তৈরি হয় তখন সবার মতামতটা নেয়া হয়। বাজেট যখন ক্যাবিনেটে পাস হয়, পাস হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর নিয়ে সংসদে আসে। বাজেট যেদিন উপস্থাপন করা হয় বিশেষ ক্যাবিনেট করেই বাজেট উপস্থাপন করা হয়। কাজেই সেখানে মন্ত্রীদের সকলের মতামতটা থাকে। তারপর কথা বলার অধিকার সকলেরই আছে, কথা বলার স্বাধীনতা আছে। গণফোরামের সদস্য মোকাব্বির খানের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে সংসদ নেতা বলেন, উনি এক লাখ অটোমেশন মেশিন উপহার দেবেন। এটা আমরা গ্রহণ করলাম, উনি উপহার দেবেন। এখানে জনমত যাচাইয়ের কোন প্রয়োজন নাই। তিনি যখন উপহার দিতেই চাচ্ছেন, দেশকে দেবেন, তিনি যথেষ্ট সচ্ছল, দিতে তিনি পারবেন। দেবার মতো ক্ষমতা তার আছে। খেলাপী ঋণ নিয়ে কতিপয় সংসদ সদস্যের ক্ষোভের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেলাপী ঋণের সংস্কৃতিটা কখন এসেছে? যখন থেকে এই দেশে সামরিক শাসন এসেছে। এই সামরিক শাসন কিভাবে এসেছে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনা আইন লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে সামরিক শাসক ক্ষমতা দখল করে। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর যখন দল গঠন করতে গেল তখন দল গঠন করতে গিয়ে কিছু লোককে বিশেষ সুযোগ সুবিধা দিতে গিয়ে এই ব্যাংক থেকে অকাতরে ঋণ নেয়া এবং ঋণ পরিশোধ না করার সংস্কৃতিটা সৃষ্টি। কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেক সময় মানুষের অপ্রত্যাশিত কিছু অর্থ আসে। কিন্তু এই অপ্রত্যাশিত অর্থটা কোন কাজে লাগানো যায় না। তাদের যদি একটা সুযোগ দেয়া হয়, যেন এই টাকাটা মূল ধারায় চলে আসে এবং সেটা জনগণের কাজে দেবে। তবে যদি দেখি সেখানে দুর্নীতি বাড়ছে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব এবং সেটার সুযোগ আছে। বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য রুমিন ফারহানার প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, সুইচ ব্যাংকের টাকায় কাদের নামের তালিকা এসেছে, উনি যেন একটু ভাল করে দেখেন। যাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকেন, যাদের কথা এত বেশি বলেন, তাদের কথাটিই বেশি এসেছে। অর্থ বিলের ওপর বেশ কিছু সংশোধনী আনেন সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা। এরমধ্য থেকে বেশ কিছু সংশোধনী প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেন। সংশোধনীগুলো নিষ্পত্তি শেষে প্রধানমন্ত্রী অর্থ বিল ২০১৯ পাসের প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। উপস্থিত সদস্যদের কণ্ঠভোটে রাত সোয়া আটটায় ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য আর্থিক প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে জাতীয় সংসদে পাস হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশকে সবাই মিলে এগিয়ে নিতে চাই। এজন্যই সরকর ও বিরোধী দলের সদস্যরা মিলে প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সংশোধনী আনা হয়েছে। এর আগে বাজেটের ওপর সমাপনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই বাজেটটি শুধু একটি বছরের জন্য নয়। এই বাজেটটি ফাউন্ডেশন এই বছর। কিন্তু এই বাজেটটি থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত অর্জন করতে পারব। সেইভাবে আমরা বাজেটটি প্রণয়ন করেছি। আমি বিশ্বাস করি, ২০২৪ সালে আমরা ডাবল ডিজিট গ্রোথে পা রাখব। ২০২৪ সাল থেকে শুরু করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত এই বাজেটের ফলাফল পাব। তিনি বলেন, একটা দেশ এবং জাতির সঙ্গে অনেক মিল আছে। মানুষের জীবনে যেমনিভাবে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় ঠিক তেমনিভাবে দেশের ক্ষেত্রেও সেটা সম্ভব হয়। দেশের ক্ষেত্রে সম্ভব হয় বলেই আমরা আমাদের এই বাজেটে টাইটেল রেখেছি সময় এবার আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে লেখা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী মালয়েশিয়া কোরিয়া চীনের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, আমরা কী দেখতে পাই? আমরা যদি মালয়েশিয়ার দিকে তাকাই? ৩০ বছরের মধ্যে মালয়েশিয়া চলে গেছে তাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে, কাক্সিক্ষত জায়গায়। চীনের অবস্থা কি ছিল? চীন সবচেয়ে দরিদ্র দেশ ছিল। চীনে কোন খাবার ছিল না। অথচ সেই আজকে পৃথিবীর এক নম্বর দেশ। তারা তাদের মতো করে মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে। ১৯৬০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয় ছিল ১৫৮ ডলার। আমাদেরও একই আয় ছিল। কোরিয়ার মায়েরা রেশমি চুল বিক্রি করে তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়েছে। তাদের একমাত্র খাবার ছিল জিনসেন স্যুপ। স্ইে স্যুপ খেয়ে তারা আজ কোথায় চলে গেছে। তিনি বলেন, যদি চীন পারে, মালয়েশিয়া পারে, দক্ষিণ কোরিয়া পারে তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই পারবে। আমরা গত দশ বছরে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে নিরলস পরিশ্রম করে সবাই মিলে বাংলাদেশকে যে জায়গায় নিয়ে এসেছি। ট্রেন একবার যখন ট্র্যাকের ওপর উঠে যায় তখন আর ট্রেন পেছনের দিকে যায় না। কোন জাতি নাই আমাদের এখান থেকে গতিচ্যুত করতে পারবে। আমরা এগোবই, এগোবই ইনশাল্লাহ। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমরা বেশি ঋণ করি কী না? আমাদের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশ। মালয়েশিয়ার এর চেয়ে বেশি। ঋণের পরিমাণ হিসেব করা হয় জিডিপি দিয়ে। আমরা ঋণ নেই চীনের কাছ থেকে। চীনের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ২৮৪ শতাংশ। ওরা আমাদের ঋণ দেয়। আমাদের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৩৪ শতাংশ। ২০৩০ সাল নাগাদ আমরা আর ঋণ নেব না। আমরা ঋণ দেব ইনশাল্লাহ। সারা বিশ্বের মানুষকে ঋণ দেব আমরা।
×