ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

তিন বছর আটক রাখার পর ভুল স্বীকার করল পুলিশ

বাংলাদেশী সন্দেহে অসমের বন্দীশিবিরে ভারতীয় নারী

প্রকাশিত: ১০:১২, ২৯ জুন ২০১৯

 বাংলাদেশী সন্দেহে অসমের বন্দীশিবিরে ভারতীয় নারী

ভারতের অসমে মধুবালা মন্ডল নামে এক নারীকে ‘বাংলাদেশী’ বলে তিন বছর ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখার পর অবশেষে পুলিশ ভুল স্বীকার করে তাকে মুক্তি দিয়েছে। অসমের চিরাং জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা ৫৯ বছরের মুধবালা যখন বাড়ি ফেরেন তখন তার মেয়ে আর নাতনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ বাছাইয়ের কাজে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি সরকার। এনডিটিভি। তখন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশী অনুপ্রেবশকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান রয়েছে যে রাজ্যে সেই অসম থেকেই এই বাছাইয়ের কাজ শুরু করা হবে। সে অনুযায়ী অসমে নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ওই নাগরিকপঞ্জির খসড়া প্রকাশের পর দেখা যায় সেখানে মাত্র এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের ঠাঁই হয়েছে। যা নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্কের পর জুলাইয়ে দ্বিতীয় খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে নাগরিক হিসেবে দুই কোটি ৮৯ লাখ মানুষের নাম তালিকায় দেখা যায়। অথচ আবেদন করেছিলেন তিন কোটি ২৯ লাখ মানুষ। অসমে এই ‘বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী’ বাছতে গিয়ে নিজ দেশেই বহু মানুষকে হেনোস্তার শিকার হতে হচ্ছে, যাদের একজন মধুবালা। ২০১৬ সালে অসম পুলিশ মধুবালাকে ‘বিদেশী’ বলে আটক করে। যদিও পুলিশ আসলে মধুমালা দাসকে খুঁজছিলেন, যিনি প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। নানাভাবে চেষ্টা করেও মধুবালা ম-ল নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে পারেননি। অবশেষ পুলিশ তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং মুক্তি মেলে মধুবালা ম-লের। মুক্তি পাওয়ার পর মধুবালা বলেন, ‘পুলিশ আসার পর আমি তাদের বার বার বলেছিলাম আমি মধুবালা, মধুমালা নই। তাছাড়া আমার টাইটেল ম-ল, দাস নয়। কিন্তু তারা আমার কোন কথা না শুনে ধরে নিয়ে যায়। ডিটেনশন সেন্টারে তিন বছর আমি অনেক কষ্ট করেছি।’ প্রায় ২২ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর মধুবালাই তার তিন সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার মেয়ে ফুলমালা (৩৪) বোবা হওয়ায় আট বছর আগে স্বামী পরিত্যক্ত হয়ে একমাত্র মেয়ে জয়ন্তীকে (১২) নিয়ে মায়ের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ডিটেনশন সেন্টারের বর্ণনা দিতে গিয়ে মধুবালা বলেন, ‘সেখানে জীবন যাপন ভয়াবহ। শত শত মানুষের সঙ্গে সেখানে অমানবিক ব্যবহার করা হয়। আমি মুক্তির আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমাকে ছাড়া আমার মেয়ে আর নাতনির কী হবে সেটা ভেবে আমি কষ্ট পেতাম। আমাদের সেখানে সবজি খেতে দেয়া হতো। মাঝে মধ্যে ভাত ও ডাল, যার সবই আধাসিদ্ধ থাকতো। সেখানে তরুণ-বৃদ্ধ অনেক মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে যারা আসলে ভারতীয়। আমি নিজে সেখানে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা দুইজনকে মরে যেতে দেখেছি।’ মধুবালাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ফুলমালা ও তার মেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তবে ভাগ্য ভালো, কয়েকজন গ্রামবাসী তাদের পাশে দাঁড়ায়। এক প্রতিবেশী বলেন, ‘জয়ন্তী স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। আর ফুলমালা মায়ের খোঁজে পুরো গ্রাম পাগলের মত দৌঁড়ে আর চিৎকার করে বেড়াত। আমি মাঝে মধ্যে তাদের ধরে খাবার দিতাম।’ মধুবালার পরিবার বা তার গ্রামের মানুষের পক্ষে তাকে মুক্তির উদ্যোগ নেয়া সম্ভব ছিল না। ডিটেনশন সেন্টারেই হয়তো মধুবালার জীবন শেষ হয়ে যেত যদি না স্থানীয় সমাজকর্মী অজয় কুমার রায় তার সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। তিনি মধুবালার ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ জোগাড় করেন এবং সেগুলো পুলিশকে দেন। ‘আমি সব প্রমাণ পুলিশের এসপিকে দেই এবং বলি আরও একবার গ্রামে এসে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করতে। সানাউল্লাহ নামে আরও এক ব্যক্তি ডিটেনশন সেন্টার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমি মধুবালার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সাহায্য চাই এবং এটা নিয়ে হইচই শুরু হয়’, বলেন তিনি। অসমের খসড়া নাগরিকপঞ্জিতে মধুবালার পুরো পরিবারের নাম আছে। এ বিষয়ে চিরাং পুলিশের এসপি সুধাকর সিং বলেন, ‘তদন্তে আমরা পরিচয় সনাক্তে ভুল হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে আদালতে আমাদের প্রতিবেদন পাঠাই এবং তিনি মুক্তি পান।’ মাত্র একমাস আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা মোহাম্মদ সানাউল্লাকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে ১২ দিন ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখার ঘটনা নিয়ে ভারতজুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল।
×