ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন

শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ১৯ মে ২০১৯

 শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা

‘আমি নেতা নই। সাধারণ মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী। আপনাদের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের নিয়ে আমি নিরলস সংগ্রাম চালিয়ে যাব।’ -কথাগুলো বঙ্গবন্ধু-কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। ১৯৮১ সালের ১৭ মে ঢাকার মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে এভাবেই তিনি গণতন্ত্র মুক্তির নবতর সংগ্রামে তার শপথের কথা উচ্চারণ করেছিলেন। সেদিনের শেখ হাসিনার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি সম্পর্কে পরদিন ১৮ মে’র ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিবেদন ছিল এরকমÑ ‘শেরেবাংলা নগরে সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া এ্যাভিনিউয়ে আয়োজিত বৈদ্যুতিক আলোহীন অন্ধকার পরিবেশ, ঝড়-বৃষ্টির দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যেও দূর-দূরান্ত হইতে আগত অজস্র শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন। দলীয় নেত্রীর আবেগমথিত কান্নার সময়, তার বক্তৃতার আহ্বানের জবাবে অর্ধঘণ্টার এই সমাবেশে শ্রোতারা মুহুর্মুহু স্লোগান দিতেছিলেন।’ লাখ লাখ জনতার ভালবাসায় অভিষিক্ত শেখ হাসিনা সেদিনের জনসভায় গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার যে দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন, স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ৩৮ বছরের মাথায় এসে এখনও সেই অঙ্গীকার পালনে তিনি একনিষ্ঠ ও দৃঢ়। ১৯৮১ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে যেসব বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ক. বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, খ. হত্যা ক্যু ষড়যন্ত্রের রাজনীতির চির অবসান এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গ. বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী তথা অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম, ঘ. গণতন্ত্র এবং ঙ. জাতীয় ঐক্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে কাপুরুষোচিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ঘটনাক্রমে সেদিন দেশের বাইরে থাকার কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘাতকদের হাত থেকে প্রাণে বেঁচে যান। পরবর্তী সময়ে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে দীর্ঘ ২১ বছর বিচারের পথ রহিত করা হয়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে জিয়া-এরশাদ-খালেদার সরকার বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করেছে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর হত্যার উপর্যুপরি অপচেষ্টা ও মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জননেত্রী শেখ হাসিনা চরম ধৈর্য ও সাহসিকতা নিয়ে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার নিরলস সংগ্রাম পরিচালনা করেন। তার প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, আত্মত্যাগ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ধৈর্যশীল প্রচেষ্টার ফলেই আইন-বহির্ভূত কোন পথে নয়; বরং প্রচলিত আইনের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ উন্মুক্ত হয়। ১৯৮১ সালে মানিক মিয়া এভিনিউয়ের লাখো জনতার উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘৭৫-এর হত্যাকান্ডের জন্য সরকারের কাছে নয়, আপনাদের কাছে এর বিচার চাই।’ ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু-কন্যা যখন তার প্রিয় স্বদেশভূমিতে ফিরে আসেন তখন হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বেশ ভালভাবেই বিস্তার লাভ করেছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার বেনিফিসিয়ারিরাই তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও জনগণের মুক্তির জন্য শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন। ত্যাগের মহান ব্রত নিয়ে আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বলেই তার পক্ষে বলা সম্ভব হয়েছিল, ‘আমি আমার জীবন আপনাদের জন্য, সোনার বাংলার দুঃখী মানুষের জন্য, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব তথা শোষিতের গণতন্ত্র কায়েমের জন্য দান করে দিতে চাই।’ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তার ওপর গ্রেনেড হামলা করা হয়। নারীনেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতা-কর্মী নিহত হন। এসব হত্যা প্রচেষ্টা, গুলিবর্ষণ, বোমাবাজি সত্ত্বেও তিনি অসীম সাহসে লক্ষ্য অর্জনে অবিচল থেকেছেন। জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে এগিয়ে গেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৯৬ সালে জনগণের ভোটে সুদীর্ঘ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর সূচিত স্বৈরশাসন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ধারার অবসান হয়। রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ^সভায় বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে ঘুরে দাঁড়ায়। এই শাসনামল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ২০০১ সালে ষড়যন্ত্রমূলক ভোট ডাকাতির নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি-জামায়াত জোট পুনরায় ক্ষমতা দখল করে উন্নয়নের বিপরীতে নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে স্বৈরতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখে। বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতির ফলে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি পটপরিবর্তন সংগঠিত হয়। বিরাজনীতিকরণের হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে সর্বজনস্বীকৃত অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ক্ষুধা দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়নের সফল অগ্রযাত্রায় দেশ এগিয়ে যায়। ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত থেমে থাকেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন-পূর্ব অযৌক্তিক ও জনসম্পৃক্ততাহীন আন্দোলন ও আগুন সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে থামানোর অপচেষ্টা হয়। শেখ হাসিনা অত্যন্ত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সঙ্গে এসব চক্রান্ত প্রতিহত করেন। ২০০৮ থেকে টানা দুই মেয়াদে ১০ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার বাংলাদেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ, সমতা ও ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণের পথে জাতিকে অগ্রসরমান রেখেছেন। জাতির অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল মানুষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের অবাধ নির্বাচনে আবারও নৌকায় ভোট দিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শেখ হাসিনার সরকার দ্রুতগতিতে উন্নয়নের স্বপ্নযাত্রায় দেশবাসীকে শামিল করেছেন। বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। শেখ হাসিনার হাত ধরে আমাদের জন্মভূমি পরমাণু ও স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে। এক সময়ের ক্ষুধা-দারিদ্র্যের বাংলাদেশ আজ আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। ‘শেখ হাসিনাই পারে, শেখ হাসিনাই পারবে’- এ কথা আজ মানুষ বিশ্বাস করছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সম্মানবোধ ও আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমাদের দেশে সকলের চেয়ে বেশি দরকার হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া।... যে দেশে গরিব ধনী হইবার ভরসা রাখে, সে দেশে সেই ভরসাই একটা মস্ত বড় ধন।’ বঙ্গবন্ধুর পর শেখ হাসিনার সরকারই জাতির চোখ খুলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মতো তিনিও বলেছেন, ‘ভিক্ষুকের জাতির কোন সম্মান নেই।’ কবিগুরুর লেখার সূত্র ধরে আমরাও বলতে পারি, বাঙালী জাতির ভরসার স্থল আজ দেশরত্ন শেখ হাসিনা। তার হাত ধরেই দেশ পৌঁছে যাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়। লেখক : তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
×