ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

রেসকোর্সের কিংবদন্তি জকি জাহেদ আলী: এক জীবন, এক ইতিহাস

আফ্রিদি আহাম্মেদ, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ

প্রকাশিত: ০৯:৩৮, ১ জুলাই ২০২৫

রেসকোর্সের কিংবদন্তি জকি জাহেদ আলী: এক জীবন, এক ইতিহাস

ছবি: সংগৃহীত

ঘোড়দৌড়প্রেমী পুরনো ঢাকার মানুষদের কাছে একসময় যিনি ছিলেন কিংবদন্তি, তিনি মানিকগঞ্জের জাহেদ আলী। ‘বাঙালী বাহাদুর’ ও ‘টর্পেডো’র পিঠে চড়ে রেসকোর্স মাতানো এই মানুষটি বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও তাঁর স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল রেসকোর্সের রোমাঞ্চিত দিনগুলো।

জাহেদ আলীর জন্ম মানিকগঞ্জ পৌরসভার কুশের চর গ্রামে। পরিবারে পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝো। শৈশবেই দুরন্তপনায় পরিচিত হয়ে ওঠেন আশেপাশের গ্রামে। একদিন সাহা বাড়ির ঘোড়ায় চড়ে ধরা পড়ার ঘটনাই পালটে দেয় তাঁর জীবন। সেই অপমান থেকেই শুরু হয় তাঁর ঘোড়সওয়ার হওয়ার সংগ্রাম।

মাত্র ৮ টাকার মাসিক বেতনে টাঙ্গাইলের ঘেনু ব্যাপারীর ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে হাতেখড়ি নেন ঘোড়ার সঙ্গে বসবাসের। সেখান থেকে ধাপে ধাপে উঠে আসেন জকি হিসেবে ঢাকার রেসকোর্সে। একদিন কালী গঙ্গা নদীর পাড়ে ঘোড়া দৌড়াতে গিয়ে এক লঞ্চে থাকা তৎকালীন ঢাকার পুলিশ সুপারের (এসপি) নজরে পড়েন। এরপরই সেই পুলিশ কর্মকর্তার সহায়তায় ঢাকায় পা রাখেন জাহেদ আলী। শুরু হয় রেসকোর্সের প্রশিক্ষণ, পরে পরীক্ষায় প্রথম হয়ে হয়ে ওঠেন পেশাদার জকি।

ঢাকা ক্লাবের রেসে ‘বাঙালী বাহাদুর’ নামের ঘোড়ার পিঠে চড়ে প্রথম রেসেই বাজিমাত করেন। সেদিন জিতেছিলেন তিনশ টাকা, যা সে সময়ের জন্য ছিল বিশাল অঙ্ক। এরপর একে একে জিতে নেন অসংখ্য রেস, অংশ নেন গোল্ডকাপ ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতাতেও। চীনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের নামে আয়োজিত সেই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে রীতিমতো ইতিহাস গড়েন তিনি।

তাঁর প্রিয় ঘোড়া ছিল ‘টর্পেডো’, আর প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়াকে রেসের শেষ ধাপে লেজ ধরে টেনে ফেলে দেওয়ার দক্ষতাতেও ছিলেন অনন্য। যদিও একে তিনি বলতেন ‘জুয়ার ভিতরের জুয়া খেলা’, এবং স্বীকার করতেন যে এটা অনৈতিক হলেও রেসের জগতে এমনটা প্রায়শই ঘটত।

স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে জুয়াভিত্তিক ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দিলে হঠাৎ করেই থেমে যায় জাহেদ আলীর সফল জীবনের চাকা। টানা ২০ বছরের রঙিন ক্যারিয়ারের পর নেমে আসে বেকারত্ব আর অভাব।

ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল অস্থিরতা। স্ত্রীকে দেনমোহর হিসেবে দিয়েছিলেন একটি ঘোড়া। তবে সংসারে শেষ বয়সে আশ্রয় জোটেনি ছেলেমেয়েদের ঘরে। বর্তমানে কালীগঙ্গা নদীর তীরে এক মেয়ের টিনের ঘরে দিন কাটে তাঁর।

জকি জীবনের বন্ধুরা অনেকেই হয়েছেন কোটিপতি, কেউ কেউ হয়েছেন সংসদ সদস্যও। বন্ধুরা অনেকবার সাহায্যের হাত বাড়ালেও, আত্মসম্মানের প্রশ্নে তা গ্রহণ করেননি জাহেদ আলী। কেবল মাঝে মাঝে ঢাকায় গিয়ে পুরনো বন্ধুদের রাজকীয় বাড়িতে ক’দিন কাটিয়ে, ফেরার সময় সামান্য বাস ভাড়া নিয়েই ফিরে আসতেন নিজের ছোট ঘরে।

জাহেদ আলীর জীবন কাহিনী লিপিবদ্ধ করছেন তাঁরই এলাকার এক স্কুল শিক্ষক। জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিলসেই বইটি ছাপা হলে দেখে যেতে পারবেন কিনা।

২০০০ সালের ৩১ আগস্ট দৈনিক মানবজমিনে প্রকাশিত হয় এই কিংবদন্তির সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি প্রতিবেদন। এরপর ২০০৩ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন রেসকোর্সের এই মহাতারকা।

তিনি নেই, কিন্তু তাঁর গল্প আছেআছে বাঙালির ইতিহাসে এক স্বর্ণালি অধ্যায়।

রাকিব

×