ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচা অনলাইনে

ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও টিআইএন নিয়ে ভোগান্তিতে নারী ক্রেতারা

প্রকাশিত: ১২:৩০, ১২ এপ্রিল ২০১৯

ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ও টিআইএন নিয়ে ভোগান্তিতে নারী ক্রেতারা

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসে দুই লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে এসেছিলেন মালিবাগের বাসিন্দা রুমানা ইসলাম। দীর্ঘদিন সংসারের খরচ বাঁচিয়ে অল্প অল্প করে এই টাকা জমিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকে এসে জানতে পারেন, এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কিনতে নিজের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) সনদ লাগবে। এর সঙ্গে নিজ নামে খোলা ব্যাংক এ্যাকাউন্টও লাগবে, যেখানে প্রতি মাসে পাঠানো হবে মুনাফা। আরও দাখিল করতে হবে নিজ ও নমিনীদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপিসহ অন্যান্য কাগজপত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃশ্যমান স্থানে টানিয়ে রাখা হয়েছে এসব নিয়ম-কানুন সম্বলিত ব্যানার। রুমানা ইসলাম এগুলো বারবার পড়ছিলেন আর বলছিলেন, ‘আমার তো টিআইএন নেই। আমি কি তাহলে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারব না?’ আবার বলছিলেন, ‘টিআইএন ছাড়া এক লাখ টাকা করে কি দুইবারে দুই লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে?’ এ সময় পাশ থেকে আরেকজন বলছিলেন, এক অর্থবছরে টিআইএন ছাড়া এক লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্র কেনা যাবে না। এর বেশি কিনতে চাইলে নিজের টিআইএন সনদ জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। শুধু রুমানা ইসলামই নন, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের ওয়েবভিত্তিক (অটোমেশন) সিস্টেমের আওতায় সঞ্চয়পত্র কিনতে গিয়ে বিপাকে পড়ছেন পুরুষ-মহিলা-নির্বিশেষে অনেক ক্রেতাই, যারা নতুন সিস্টেম সম্পর্কে আগে থেকে ওয়াকিবহাল ছিলেন না। বিশেষ করে মহিলাদের মধ্যে যারা সাধারণ গৃহিণী, তারা বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। কারণ তাদের টিআইএন সনদ নেই। অনেকের নেই ব্যাংক এ্যাকাউন্টও। জানা যায়, গত ৩ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় অনলাইন সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের আওতায় পরীক্ষমূলকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মতিঝিল অফিসসহ চারটি অফিস থেকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অন্য অফিসগুলো হলো সোনালী ব্যাংকের লোকাল অফিস, জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের ব্যুরো অফিস ও বাংলাদেশ পোস্ট অফিসের প্রধান কার্যালয়। তবে মার্চের মধ্যেই ঢাকা মহানগরীর সব অফিসে এই সিস্টেম চালু করা হবে। এ ছাড়া এপ্রিলের মধ্যে বিভাগীয় শহরে এবং জুনের মধ্যে দেশের অন্যান্য স্থানে এই সিস্টেম চালু করা হবে। আর ১ জুলাই থেকে এ সিস্টেমের আওতা বহির্ভূত কোন সঞ্চয় স্কিম লেনদেন যেন না করা হয় সেজন্য শীঘ্রই সংশ্লিষ্ট সব অফিসে চিঠি পাঠানো হবে। রাজধানীর বনশ্রী থেকে সঞ্চয়পত্র কিনতে আসেন নাঈমা ইসলাম নামের আরেক গৃহিণী। তিনি বলেন, ‘পাঁচ লাখ টাকার পরিবার সঞ্চয়পত্র কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু সেটা কিনতে পারছি না। টিআইএন সনদ চাচ্ছে। কিন্তু এটা তো আমরা নাই। এটা কখনও দরকার হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, শুধু টিআইএন নয়, নতুন নিয়মে আরও অনেক কিছু চাওয়া হচ্ছে। রাজধানীর খিলগাঁও থেকে আসা আরেক গৃহিণী হাসিবা রহমানও একই অভিমত দেন। তিনি বলেন, ‘এটা সমস্যাই বাড়িয়েছে। শুধু টিআইএনই নয়, আমরা যদি এক লাখ টাকার সঞ্চয়পত্রও কিনি তাহলেও ব্যাংক হিসাব নম্বর ও তার চেকের পাতা জমা দিতে হবে। আগে এগুলো লাগত না। এখন নমিনির এনআইডির ফটোকপিও জমা দেয়ার নিয়ম করেছে। এছাড়া আগের কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদপূর্তির পর ওই টাকা দিয়ে নতুন করে সঞ্চয়পত্র কিনতেও জটিলতা তৈরি হয়েছে। এই টাকা আগে নগদে তুলে সঞ্চয়পত্র কেনা সম্ভব হলেও এখন নিজস্ব ব্যাংক এ্যাকাউন্টে জমা করে চেকের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে হবে। এতে টাকা বহনের নিরাপত্তা ঝুঁকিও আছে। কে দেবে আমাদের সেই নিরাপত্তা?’ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, সরকার থেকে একটা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ওই সুবিধা কে বা কারা ভোগ করছে এবং সরকার এখান থেকে এর বিপরীতে যে টাকা ঋণ হিসেবে নিচ্ছে সেটা একটা সিস্টেমে থাকা উচিত। দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই এটা হওয়া উচিত। এটা অবশ্যই ভাল উদ্যোগ। এর মাধ্যমে এই খাতে সচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়বে। ফলে কেউ চাইলেই অবৈধ অর্থে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবে না। জাতীয় সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-মার্চ) ৩৫ হাজার ৬০২ কোটি ৪৯ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের একই সময়ে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৩ হাজার ১১৯ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। এ হিসাবে চলতি অর্থবছরের আট মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এদিকে সর্বশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে ৪ হাজার ৬০৬ কোটি ১০ লাখ টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। গত বছরের মার্চে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১৫৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা। তবে জানুয়ারির চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেছে। জানুয়ারিতে ৬ হাজার ৩ কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছিল। যা ছিল এক মাসের হিসাবে সবচেয়ে বেশি নিট বিক্রি। জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচা অনলাইনে ॥ এদিকে আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে সারাদেশের সঞ্চয়পত্র কেনাবেচা কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রীয় ব্যবস্থার (অনলাইন) মধ্যে নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মার্চে এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল অর্থমন্ত্রণালয়। সেই প্রজ্ঞাপনের সূত্র ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার একটি সার্কুলার জারি করেছে। সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো সার্কুলারে বলা হয়েছে, অর্থ বিভাগ ‘সরকারী ব্যয় ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ: অগ্রাধিকার কার্যক্রমগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা’ শীর্ষক যে কর্মসূচী বাস্তবায়ন করছে, তার আওতায় চলছে ‘জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প অনলাইন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’ নামের আরেকটি কর্মসূচী। এই কর্মসূচী সঞ্চয় প্রকল্পের সুদ ও আসলকে বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্কের (বিইএফটিএন) মাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কাজ করছে। সার্কুলারে মার্চ মাসের মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে, চলতি এপ্রিল মাসের মধ্যে বিভাগীয় শহরে এবং জুন মাসের মধ্যে দেশের সব স্থানে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করতে বলা হয়েছে। ১ জুলাই থেকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতা বহির্ভূতভাবে কোন সঞ্চয়পত্র লেনদেন করা যাবে না। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
×