ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব;###;প্রায় ১৫ শতাংশ দারিদ্র্য বাড়তে পারে ॥ মার্কিন রিপোর্টে উদ্বেগ

বাংলাদেশে চার দশকে প্রায় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৭ জানুয়ারি ২০১৯

বাংলাদেশে চার দশকে প্রায় কোটি লোক বাস্তুচ্যুত হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জলবায়ু বিষয়ক এক প্রতিবেদনে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে চার দশকে প্রায় এক কোটি লোক উদ্বাস্তু হবে। এই উদ্বাস্তু অভিবাসীরা বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। সেই সঙ্গে জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ দারিদ্র্য বাড়াতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জবাবদিহিতা সংক্রান্ত দফতর (ইউনাইটেড স্টেট গবর্নমেন্টস এ্যাকাউন্টিবিলিটি অফিস) থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও খরা বৃদ্ধিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ : এ্যাক্টিভিটিস অব সিলেক্টেড এজেন্সি টু এ্যাড্রেস পোটেনশিয়াল ইমপ্যাক্ট অন গ্লোবাল মাইগ্রেশন’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত সপ্তাহে প্রকাশ করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি ওই প্রতিবেদনের মূল আলোচ্য বিষয়। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অভিবাসন বাস্তবতাকে কী করে বদলে দিচ্ছে প্রতিবেদনে তা তুলে ধরা হয়েছে। বদলে যাওয়া অভিবাসন বাস্তবতার প্রভাব শনাক্তে মার্কিন সরকারের বিভিন্ন ভূমিকার পর্যালোচনা করা হয়েছে এতে। প্রতিবেদনে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও মোকাবেলার প্রস্তুতি প্রসঙ্গ। ওই মার্কিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি ও মৎস্য চাষের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করায় মানুষ নিজেদের এলাকা ছেড়ে উপকূলবর্তী অঞ্চলে আবাস গড়ছে। অথচ ওই উপকূলীয় অঞ্চলগুলোও জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাব মোকাবেলা করছে। প্রায়শই ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কবলে পড়ে উপকূলীয় এলাকা কিংবা নদীর কাছাকাছি অঞ্চল। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রভাবে লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার বাড়ি ও ফসল। ’১৭ সাল ঘূর্ণিঝড় মোরার কারণে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন দুই লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে আশঙ্কা জানানো হয়েছে, পরিবেশের উষ্ণতা বাড়লে এই ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা আরও বাড়বে। এতে বাড়ি, জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৭.৫ শতাংশ ভূখ- পানিতে তলিয়ে যাবে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পরিবর্তন হলে খরা আরও বেড়ে যাবে এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা আরও বেশি হুমকিতে পড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবণাক্ত পানি বেড়ে গেলে ফসল উৎপাদনও ব্যাহত হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুতি বা অভিবাসন এখন বেঁচে থাকার সাধারণ কৌশল। যেমন অনেক কৃষক এখন লবণাক্ত পানির প্রভাবে নিজেদের চাষাবাদের কৌশল পাল্টেছেন। কেউ এখন লবণ সহিষ্ণু ধান উৎপাদন করছেন, আবার কেউ ফসল ফলানো বাদ দিয়ে চিংড়ি চাষ শুরু করেছেন। আর অনেকে গ্রাম ছেড়েছেন। জীবিকার আশায় পাড়ি জমিয়েছেন শহরে। রিফিউজি এ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট আর সাসেস্ক সেন্টার ফর মাইগ্রেশন রিসার্চ নামের দুই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী অভিবাসনের এই ধারা ভবিষ্যতে আরও তীব্র হতে পারে। ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ রিলেটেড মাইগ্রেশন ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ’১১ থেকে ’৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ৯৬ লাখ অভিবাসী তৈরি হবে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট অভিবাসী বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা ডেকে আনতে পারে। আইপিসিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ’৩০ সালের মধ্যে জীবিকা ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর প্রভাব বাংলাদেশে প্রায় ১৫ শতাংশ দারিদ্র্য বাড়াতে পারে। ’১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে যত দ্রুত সম্ভব কার্বন নির্গমণ হ্রাস এবং এই গ্যাসের উৎপাদন ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য আনার কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের (৩ দশমিক ৬ ফারেনহাইট) ‘বেশ নিচে’ রাখার কথা বলা হয়। ’১৫ সালে প্যারিসে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নের নীতিমালা তৈরির লক্ষ্যকে সামনে রেখে তিন বছর পর ’১৮ সালের ডিসেম্বরে পোল্যান্ডে সম্মিলিত হয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের ব্যাপারে একটি রুলবুক তৈরিতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আইপিসিসি তাদের সবশেষ প্রতিবেদনে দাবি করেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ১.৫ এ সীমিত রাখতে ’৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের হার ’১০ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনতে হবে। তবে আইপিসিসির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে নেচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, উষ্ণতা বৃদ্ধির হার ২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখতেই কার্বন নিঃসরণ সীমিত করতে হবে আগের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হারে। প্রতিবেদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলেন, প্যারিস চুক্তিতে বিভিন্ন দেশের সরকার যেই পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার মাধ্যমে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা দুঃসাধ্য। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী যুগে উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রাকে ভয়াবহ পর্যায়ে নিয়ে গেছে। উষ্ণায়নের কারণে গলছে হিমবাহের বরফ, উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র, বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যাহত হচ্ছে স্বাভাবিক ঋতুচক্র। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষি, বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। অভিবাসী কিংবা শরণার্থীতে রূপান্তরিত হচ্ছে তারা। এরই মধ্যে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারেই সামনের কাতারে।
×