ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিডনির মেলব্যাগ ॥ জয় বাংলা জিতলে দেশ জিতবে

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮

সিডনির মেলব্যাগ ॥ জয় বাংলা জিতলে দেশ জিতবে

সত্তরের নির্বাচন দেখার সুযোগ হয়েছিল। বাবা-মায়ের হাত ধরে বাড়ির কাছের ভোটকেন্দ্রে যাবার স্মৃতি এখনও জ্বলজ্বলে। সে নির্বাচনে মানুষ সঠিক রায় দিয়েছিলেন বলে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশের নাগরিকদের গোড়ার দিকে যে সংশয় আর অপমানের শিকার হতে হতো, তা এখন নেই। যখন তারুণ্যে দেশের এমন চেহারা হয়েছিল, আমাদের ভবিষ্যত কি সেটা জানা ও বোঝা যেত না। এক সময় পাকিস্তানের ছায়া রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য আদাজল খেয়ে লাগা সরকারী দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে প্রায় অকার্যকর প্রমাণের চেষ্টায় মরিয়া হওয়ার পরও মানুষ দমেনি। তারা সবসময় সঠিক সিদ্বান্ত নিয়ে জাতিকে এগিয়ে রেখেছিল। আশাহীনতার ভেতর থেকে উঠে আসা আশার নাম বাংলাদেশ। কম সহ্য করেনি এই মাটি। কম দেখেনি কিছু ইতিহাস। যারা দেশ স্বাধীনের জন্য প্রাণ দিয়েছিল, যাদের ত্যাগে পতাকা সঙ্গীত তাদের অপমান মেনে নেয়নি। এককালের জবরদস্ত রাজাকাররা আজ ফসিল। যেসব আস্ফালন আর মিথ্যা বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতিকে বেগবান করেছিল, তাও আজ আর কাজ করে না। এখন এক নতুন বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে দুনিয়ায়। একাত্তরে স্বাধীন হওয়ার পর তলাবিহীন ঝুড়ি নামের দেশটি আজ উপচে পড়া দেশ। যেসব মুরুব্বি কথায় কথায় চোখ রাঙাতেন, তাদের চোখের ভাষা পাল্টে গেছে। তারা বুঝে গেছে ধমকের দিন শেষ। এখন তোয়াজ করে চলতে হবে আমাদের। এই সেদিনও আমাদের চেনানো হতো নেক্সট টু ইন্ডিয়া বলে। সে বাস্তবতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আজ বাংলাদেশ তার নিজের মান, নিজের নাম নিজস্ব পরিচয়ে উদ্ভাসিত। তাই এবারের নির্বাচনটি আবার অপরিসীম গুরুত্ব আর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে হাজির। কোন দলের হয়ে কথা বলা লেখকের কাজ না। আবার দলহীনতার নামে দেশ জাতির সর্বনাশ করতে চাওয়া রাজনীতিকে উৎসাহিত করাও লেখার উদ্দেশ্য হতে পারে না। আপনি আমাকে এমন একটা দেশ দেখান যেখানে রাজনীতি তার মৌলিক বিষয় নিয়ে এমন বচসা করে। পাশের দেশ ভারত আর একদা যে দেশের অঙ্গ ছিলাম, সে পাকিস্তানের রাজনীতিও তা করে না। বিজেপি গান্ধীর আততায়ী নাথুরাম গডসেকে হিরো মনে করে। অথচ আপনি দেখবেন তাদের নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশে-বিদেশে কত জায়গায় হাতজোড় করে গান্ধী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এর নাম দেশ ও জাতির ইতিহাসকে সম্মান করা। পাকিস্তানে সামরিক-বেসামরিক যত ধরনের সরকার আসে যায়, কারও রাজনীতিতে জিন্নাহ নিয়ে বিতর্ক নেই। সে জায়গায় আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো এক মহান কালজয়ী নেতাকে নিয়ে এখনও তর্ক করি। লন্ডনে পালিয়ে থাকা বিএনপির সন্ত্রাসী তারেক তাঁকে বঙ্গবন্ধু বলে সম্বোধন পর্যন্ত করে না। তাদের নেতারা বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন কিংবা চার জাতীয় নেতার কাউকে শ্রদ্ধা করা দূরে থাক, পারলে তাদের সবকিছু নষ্ট করে দিতে সচেষ্ট। আমি এমন কোন দেশের নাম জানি না, যেখানে মা মাটি ও জনগণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা রাজনীতির এত কদর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের ভূমিকা জার্মানদের জন্য কি খারাপ? তাদের দিক থেকে বিবেচনা করলে হিটলার তো হিরো হওয়ার কথা। যিনি প্রায় গোটা দুনিয়া জয় করে এনেছিলেন। অথচ আজও তার প্রতি ঘৃণা আর তাকে এড়িয়ে চলাই জার্মানির রাজনীতি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কতটা গৌরবের, সেটা তারুণ্য এখনও জানে না। তখন সবদিক থেকে চালচুলোহীন এক জাতি কিভাবে আমেরিকা চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে একটা যুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছিল, তা না জানলে এদেশের কিছুই জানা হবে না। আজ আবার এ কথাগুলো বলার কারণ নির্বাচন। কে না চায় দেশে একটা সঠিক বিরোধী দল থাকুক। রাজনীতিতে বিরোধী দল না থাকলে চেক এ্যান্ড ব্যালেন্স থাকে না। যেসব দেশ গণতান্ত্রিক বা যেখানে জবাবদিহি আছে, সেখানে বিরোধী দল সিংহাসনে না থেকেও রাজা মন্ত্রী। সে প্রক্রিয়া নেই বলেই হয়ত বিরোধী দল মানেই মারমুখো আর ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা। এবার আরও বিপদ তৈরি করেছে প্রবীণ কিছু রাজনৈতিক নেতা। এদের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি, একটা সময় তাদের অবদান বা কাজ দেশকে কিছু দিলেও এখন আর তা নেই। বহুকাল ধরে তারা আধুনিক রাজনীতি ও নতুন প্রজন্মের স্পর্শহীন। এখন কি আর সত্তর দশক বা আশির দশকের রাজনীতি চলবে? বাংলাদেশে এখন ঢালাও বিরোধিতার দিন শেষ। এটা মানি রাজনীতির উভয়দিকে আছে ঝামেলার ছড়াছড়ি। আওয়ামী লীগ দুই দফা সরকারে থাকার পরও ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেক আবর্জনা সাফ করেনি। বরং নানা বিষয়ে তারা এমন সব তর্ক আর বিপদ জড়ো করেছে, যা নানা সময়ে মানুষকে বিরক্ত করার পাশাপাশি উগ্র করে তুলেছে। তবু শেখ হাসিনাকে আবার দরকার। কারণ গত দুইবারে তিনি এদেশকে ভালভাবে বুঝে নিয়েছেন। রক্তের উত্তরাধিকার নিয়ে মতামতে বিভেদ থাকলেও মানতে হবে উপমহাদেশে রক্তের শুদ্ধ উত্তরাধিকার শক্তিশালী। ইন্দিরা গান্ধী যেমন ইতিহাস, তেমনি বেনজীরও। আমাদের নেতা দুইবারে বাংলাদেশকে যে উন্নয়ন ও অগ্রগতি দিয়েছেন, তার নজির আছে? যদি না থাকে, কোন গণতন্ত্রের নামে আপনি নিজের পায়ে কুড়াল মারবেন। বছরের পর বছর গদি আঁকড়ে থাকা যারা বাংলাদেশের কোন সমস্যার সমাধান করতে পারেনি, আবার কোন ভরসায় কোন গণতন্ত্রের নামে তাদের চাইবে মানুষ? হরতাল ধর্মঘট অবরোধের জমানা পেরিয়ে আসা দেশকে যেন সে পথে ঠেলে না দেই আমরা। সবচেয়ে বড় কথা ভিশন। দূরদৃষ্টিহীন মানুষ আর যাই হোক নেতা হতে পারেন না। এটা মানি মন্ত্রী থেকে ব্যবসায়ী সবার ভেতর গলদ আছে। সে গলদ থেকে বেরিয়ে আসার রাজনীতি এখনও দুরস্ত। এবার যদি শান্তি ও উন্নয়নের শক্তিকে জিতিয়ে আনা যায়, তাহলে আমরা সে পথে পা রাখতে পারব। আর তা না হলে আবারও হানাহানি আর মারামারির ভেতর চলে যাবে সমাজ। যার মানে অগ্রগতি ও শান্তি হবে সুদূর পরাহত। বিদেশে আজ বাংলাদেশ একটি মর্যাদার নাম। নানা সূচকে আমরা পাশের দেশগুলোকে ছাড়িয়ে সামনে চলেছি। এই যাত্রা এ জীবনে দেখে যেতে পারব মনে হয়নি। অথচ আজ তাই সত্য। এই সত্যকে তুলে ধরার নেতাকে বিদায় করার আগে ভাবতে হবে বৈকি। আর একটা কথা। আমাদের পরম শক্তি আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। আমরা সেসব বিরল জাতিসত্তার একটি, যার সংস্কৃতি শুধু নাচ গান কবিতা নাটকে সীমাবদ্ধ থাকে না। সময় মতো জ্বলে উঠে আমাদের পথ দেখায়। এখন যারা বিরোধী দলে তারা কেন জানি বাংলা সংস্কৃতি ও অতীত ঐতিহ্যের প্রতি নাখোশ। তারা তাদের রাজনীতির কারণেই সংস্কৃতি বিমুখ। আমরা কি আমাদের দেশ ও জাতিকে সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু দেখতে চাই? খোলা মন খোলা মত খোলা বিবেকের বিকল্প নেই দুনিয়ায়। যারা তা করতে পারে তারাই সম্মানিত। এ সম্মান এখন দোরগোড়ায়। এবারের নির্বাচন তারুণ্যের জন্য এক আগুনের গোলা। তাদের ভোটেই ঠিক হবে মাশরাফির বাংলাদেশ তিরিশের ওয়ানডেতে জিতবে না হারবে? ক্রিকেট যেমন আমাদের জাতীয় গর্ব, আমাদের অহঙ্কার, নির্বাচনে জয় পরাজয়ও আজ বড় এক বিষয়। যারাই জিতুক বাংলাদেশের উন্নয়ন ও শান্তি হবে মানুষের চাওয়া। যার সন্ধানে জাতির জনক চার জাতীয় নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের অনেক সেনানী প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীন দেশের মাটি রক্তরঞ্জিত হয়েছে তাদের খুনে। এর পুনরাবৃত্তি চাই না। শেখ হাসিনার অবদান মানুষ এখন মানুক আর না মানুক, একদিন তা মানবেই। সময় করে নির্বাচনে অংশ নেয়া আর সঠিক জায়গায় ভোট দেয়ার ভেতর আরেকবার সত্তরের আদর্শ, পঁচাত্তরের বেদনা ও ডিজিটাল দেশের স্বপ্ন তুলে আনাই হোক এবারের ভোটাভুটি। তাহলেই নির্বাচন হবে ফলাফলে টইটুম্বুর। লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড বা পাওয়া না পাওয়ার বেদনাও তখন ছোট হয়ে বড় হয়ে উঠবে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। যার কল্যাণ যার মঙ্গল মানেই আমাদের সবার মঙ্গল।
×