ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশের রাজা বাজপাখি

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮

 আকাশের রাজা বাজপাখি

আকাশের রাজা বাজপাখি। এরা দুর্ধর্ষ শিকারি। প্রায় ৪০ প্রজাতির বাজ আছে। এন্টার্কটিকা ছাড়া বিশ্বের সব মহাদেশেই এদের দেখতে পাওয়া যায়। এদের ডানা পাতলা এবং অগ্রভাগের দিকে ক্রমশ সরু যার ফলে এরা অনেক দ্রুতগতিতে উড়তে এবং গতিপথ দ্রুত বদলাতে পারে। বাজপাখির বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে গায়ার ফ্যালকন সবচেয়ে বড়। এরা ৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। সবচেয়ে ছোট আকারের হলো কেসট্রেল। মাত্র ২৫ সেন্টিমিটার। শিকারি পাখিদের মধ্যে বাজের দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। এদের দর্শন শক্তি একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় আড়াই থেকে আটগুণ বেশি। পেরেগ্রিন বাজের ডাইভ করার গতি ঘণ্টায় ২৪০ মাইল বা ৩৮৪ কিলোমিটার যার জন্য এদের বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির প্রাণী বলা হয়। মানুষ যেসব প্রাণী তীর ছুড়ে বধ করতে বা ফাঁদ পেতে ধরতে পারে না সেগুলো শিকারের কাজে দীর্ঘদিন ধরে বাজপাখি ব্যবহার করে আসছে। তবে কবে থেকে শিকারিবাজদের ধরে এনে পোষ মানা ও ট্রেনিং দেয়া শুরু হয়েছে ইতিহাসে তার রেকর্ড নেই। ‘দি এপিক অব গিলগামেশ’-এ উল্লেখ আছে যে, বাজপাখি পোষ মেনে শিকারের কাজে ব্যবহার করার প্রথাটি সেই চার হাজার বছর আগে আজকের ইরাক অঞ্চলে চালু ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই প্রথার বিস্তার ঘটতে ঘটতে বিশ্বের সমস্ত সমাজেই ছড়িয়ে পড়েছে। রাজা তুতকে বাজপাখির প্রতিকৃতির দুল পরিয়ে সমাহিত করা হয়েছিল। গ্রীকদের ব্যবহৃত মুদ্রায় দেবতাদের রাজা জিউস ও একটা বাজপাখির প্রতিকৃতি শোভা পেত। নরওয়ের ব্যবসায়ীরা আইসল্যান্ড থেকে বাজপাখি এনে গোটা ইউরোপে বিক্রি করত। হল্যান্ডের ভালকেনসওয়ার্ড নগরীর অর্থনীতি প্রায় একান্তভাবে বাজপাখির ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল ছিল। বিখ্যাত পর্যটক মার্কোপোলো ত্রয়োদশ শতাব্দিতে যখন মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন সে সময় সম্রাট ১০ হাজার বাজপাখি পালনকারীর তত্ত্বাবধান করার জন্য ৬০ জন ম্যানেজার নিয়োগ করেছিলেন। এদিকে ইউরোপে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ফ্রেডারিক বাজপাখি পোষ মেনে এদের দিয়ে শিকার করার ওপর নিজে ব্যাপক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ গ্রন্থাগারে সঙ্কলনে ৩০ বছর সময় ব্যয় করেছিলেন। বাজ দিয়ে শিকারের কৌশল ও এর ইতিহাসের ওপর যত নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলী আছে তার মধ্যে এখনও এটিকে অন্যতম বলে গণ্য করা হয়। তবে আরব দেশগুলোতে এই প্রথাটির মতো এত ব্যাপক ও বহুল প্রচলন বিশ্বের আর কোন অঞ্চলে নেই। বিশ্বে যত বাজ পালনকারী রয়েছে তাদের অর্ধেকেরও বেশি আজ সেখানে বাস করে। শিকারি পাখি পোষ মেনে শিকারের কাজে শুধু যে বাজরাই ব্যবহৃত হয় তা নয়, ঈগল ও অন্য পাখিদেরও ব্যবহার করার রেওয়াজ আছে। বাজদের দিয়ে শিকার করা ইউরোপের বাজ রাজন্যদের বহুলাংশে একটা প্রিয় খেলা ছিল। তবে এ কৌশলটি আরবের মরুভূমিতে বেঁচে থাকা বা অস্তিত্ব রক্ষার এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ারও ছিল। বেদুইনরা হুবারা বাস্টার্ড নামে এক ধরনের পাখি ও মরু খরগোস শিকার করার জন্য বাজপাখি ধরে প্রশিক্ষণ দিত। বন্দুকের আগমনের আগে এই পাখিগুলো বেদুইনদের তাদের পরিবারের জন্য খাদ্য যোগানোর ক্ষমতা বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছিল। মরুভূমির রুক্ষ বন্ধুর পরিবেশে প্রতি আউন্স প্রোটিনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ইসলামের আবির্ভাবের সময় বাজপাখি দিয়ে শিকার করা আরব সমাজে এতই গুরুত্ববহ ছিল যে মহানবী মুহম্মদ (সা)ও এর উল্লেখ করে বলেছেন যে বাজ দিয়ে ধরা খাদ্য খাওয়ার আগে মুসলমানদের তা ভালভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। তবে বিংশ শতকে দুবাই ও আমীর শাসিত অন্যান্য দেশে দ্রুত উন্নয়নের ফলে বাজ দিয়ে শিকারের প্রথাটি আরব আমিরাতে প্রায় সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গেছে। হুবারা বাস্টার্ড পাখির বসতি এলাকার ওপর মানুষের লোলুপ থাবার বিস্তার ঘটায় এই পাখির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেয়েছে। এই বড় আকারের পাখিটির শিকার শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে। শুধু বিত্তশালী আরবরাই বাইরে গিয়ে বিশেষ করে মধ্য এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় গিয়ে হুবারা বাস্টার্ড শিকার করার জন্য বাজপাখি পালন করার সামর্থ্য রাখে। ২০০০-এর দশকের গোড়ার দিকে যুবরাজ শেখ হামদান বিন মোহম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম বাজ পালন গড় আমিরাতিদের কাছে আয়ত্তযোগ্য করে তোলার একটা উপায় হিসেবে ফ্যালকন রেসিং চালু করেন। বাজদের এমনভাবে তালিম দেয়া হয় যে তারা এক নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে তাড়া করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টোপ ধরে ফেলে। বাজ দিয়ে শিকার ধরার এই মৌসুম আমিরাতে ডিসেম্বর থেকে গোটা জানুয়ারি ধরে স্থায়ী হয়। শিকার মৌসুমের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো প্রেসিডেন্ট কাপ প্রতিযোগিতা যেখানে প্রায় ৭০ লাখ ডলারের পুরস্কারের অর্থের জন্য দুই হাজারেরও বেশি বাজ অংশ নিয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার প্রভাব দুবাইজুড়ে লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বাজপাখির মালিকের সংখ্যা আকাশচুম্বী হয়ে উঠেছে। গোটা নগরীতে হোটেল লবি ও অফিস ভবনে পাখির দাঁড় চোখে পড়বে। বাজপাখির মালিকরা অসুস্থ পাখিদের চিকিৎসার জন্য নির্দিষ্ট হাসপাতালে নিয়ে যায়। পাখিদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটা করার জন্য আছে নির্দিষ্ট দোকান। সেখানে বাজপাখির খাবার হিমায়িত কবুতর ও কোয়েল থেকে শুরু করে ভিটামিন, হারানো পাখিদের হদিস বের করার জন্য ক্ষুদে ট্রান্সমিটার এবং বাজের চোখ ঢাকার জন্য মরক্কো ও স্পেন থেকে আনা চামড়ার হুড। এমনও বিশেষ দোকান আছে যেখানে অল্প বয়সী বাজদের শিকার ধাওয়া করা শেখার জন্য হুবারা পাখির মতো দেখতে বেতার নিয়ন্ত্রিত মডেল বিমানও পাওয়া যায়। দুবাইয়ে শপিংমলের এক জায়গায় জ্যান্ত বাজ বিক্রি করা হয়। এগুলোর মধ্যে সৌদি বাজ পালকদের চিরাচরিত পছন্দের পেরেগ্রিন ও সেকার আছে। এছাড়া আছে লম্বা দাগওয়ালা কেসট্রেল। বাজপাখির চোরাচালান বিশ্বের অনেক দেশেই এক উদ্বেগের বিষয়। সেকার ও পেরেগ্রিনরা পাকিস্তান দিয়ে অন্যত্র পাড়ি জমানোর সময় তাদের ফাঁদ পেতে ধরা হয় এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিত্তবান ব্যবসায়ীদের কাছে চোরাপথে বিক্রি করা হয়। রাশিয়ার সুমেরু অঞ্চলের গায়ার বাজদেরও চোরা শিকার করা হয়। এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে শুধু সেকার বিপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত। অবশ্য মুক্তাবস্থায় বিভিন্ন স্থানে গাইরের সংখ্যাও কমে আসছে। আবাসস্থল সঙ্কুচিত হয়ে আসা, জলবায়ুর পরিবর্তন ও চোরা শিকারের কারণেও বাজের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই দিকটা চিন্তা করে দুবাইয়ের শেখ বুত্তি বাজপাখির প্রজনন করছেন। সম্প্রতি তিনি এই প্রজনন কার্যক্রম স্কটল্যান্ডেও সম্প্রসারিত করেছেন। আগে পশুপাখি বিশেষজ্ঞরা বলত যে মরুভূমিতে বাজপাখির প্রজনন অসম্ভব। আর সেখানে তাদের শিকার করতে শেখানোর তো প্রশ্নই ওঠে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের কিছু কিছু বাজপালকও প্রজননের চেষ্টা করেছে। তবে তাদের সাফল্য ছিল সীমিত। অবশ্য শেখ বুত্তির প্রজনন প্রয়াস সফল হয়েছে। তার খামারে সঙ্কর জাতের বাজেরও প্রজনন করা হচ্ছে। এই জাতটি আংশিক পেরেগ্রিন, আংশিক গায়ার অতিমাত্রায় বুদ্ধিমান পাখি, পেরেগ্রিনের চাইতে অনেক বেশি চালাক। গায়ার ফ্যালকন বাজপাখি প্রজাতিগুলোর মধ্যে দীর্ঘতম। এর বসতি তুন্দ্রা অঞ্চল এবং উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার উত্তরাঞ্চলের দ্বীপসমূহ। বেশ বড় এই বাজদের মধ্যে পুরুষরা লম্বায় ৪৮ থেকে ৬১ সেন্টিমিটার, ওজন পৌনে দুই কেজি থেকে প্রায় ৩ কেজি এবং ডানার দৈর্ঘ্য ৪৩ থেকে ৫১ ইঞ্চি লম্বা হয়ে থাকে। স্ত্রী জাতের গায়ার অপেক্ষাকৃত ভারি হয়ে থাকে। লম্বায়ও এরা বড় ৫১ থেকে ৬৫ সেন্টিমিটার। ওজন আড়াই কেজি থেকে সাড়ে ৪ কেজিরও বেশি হয়। গায়াররা শ্বেতশুভ্র, রুপালি, বাদামী ও কৃষ্ণবর্ণের হয়ে থাকে। বাজপাখি দিয়ে শিকার মধ্যযুগের ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও মঙ্গোলীয় সা¤্রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে শুধু জনপ্রিয় খেলা হয়, উপরন্তু তা মর্যাদার প্রতীকও ছিল। সাদা গায়ার বাজপাখির কদর সবসময়ই আলাদা এবং এদের নিয়ে নানা কাহিনীও আছে। শ্বেতশুভ্র গায়ার বাজদের ব্যাপারে মানুষের আচ্ছন্নতার কথা ইতিহাসবিদরাও উল্লেখ করেছেন। ক্রুসেডের সময় রণাঙ্গনের খ্রীস্টান শিবির থেকে উড়ে মুসলিম শিবিরে চলে আসা একটি শ্বেতশুভ্র গায়ার বাজ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে অনেক দরকষাকষি হয়েছিল। এই শিকারি বাজটি প্রকৃতপক্ষে ছিল ফ্রান্সের রাজা ফিলিপের। এটি শেষ পর্যন্ত হস্তগত হয় মিসর ও সিরিয়ার সুলতান সালাহউদ্দীনের। রাজা ফিলিপ তার প্রিয় বাজটি ফেরত পাওয়ার জন্য সালাহউদ্দীনকে এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সালাহউদ্দীন তাতে রাজি হননি। আর আজ এই শ্বেত গায়ারের মতো একটি সুপার ফ্যালকন কেনার জন্য ধনাঢ্য আরব শেখরা আড়াই লাখ ডলার পর্যন্ত ব্যয় করেছেন এমন খবরও পত্রিকায় বেরিয়েছে। বাজপাখির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাদের অসাধারণ দৃষ্টিশক্তি। শিকারি পাখি বলেই তাদের এই বিস্ময়কর ক্ষমতা থাকতে হয়, যাতে তারা অনেক দূর বা উঁচু থেকে শিকার দেখবে এবং আঘাত হানার সঠিক মুহূর্তটি হিসাব করতে পারে। কোন কোন বাজ কমপক্ষে এক মাইল দূর থেকে মশারি আকারের শিকারের হদিস পেতে পারে। মানুষের চেয়ে এদের দৃষ্টিশক্তি ২ থেকে ৮ গুণ বেশি হয়ে থাকে। বাজপাখি অতি নির্মম ও তাদের শিকার করার দক্ষতা অবিশ্বাস্য রকমের। এরা যেমন নির্মম ও হিংস্র তেমনি তাদের উড়বার ক্ষমতাও অবিশ্বাস্য। অন্যান্য পাখির তুলনায় এরা উড়ন্ত অবস্থায় অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে দিক পরিবর্তন করতে পারে। এদের ডাইভ দেয়ার ক্ষমতা ঘণ্টায় ২শ’ মাইল বিধায় এরা বিশ্বের দ্রুততম গতির প্রাণী। আকাশ থেকে তারা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিশক্তির জোরে শিকার দেখতে পেয়ে তারা দ্রুত ছো মেরে এসে শিকার ধরে। বাজপাখি ইঁদুর, ব্যাঙ, মাছ ইত্যাকার সব ধরনের ছোট ছোট প্রাণী শিকার করে। এমনকি আকাশে উড়ন্ত ছোট পাখিদেরও ধরে ফেলে। অবিশ্বাস্য গতির কারণ এদের এরোডায়নামিক শরীর, বিশেষ করে চোখোলো ডানা এবং সেই সঙ্গে বিশেষভাবে ধাতস্থ কার্ডিওভাসকুলার ও শ্বাসযন্ত্র যার বদৌলতে তারা প্রতি সেকেন্ডে চারবার ডানা ঝাপটাতে পারে অথচ ক্লান্ত হয় না। পেরেগ্রিন বাজ খাদ্যের সন্ধানে ও প্রজননের জন্য এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পাড়ি জমায়। বছরে তারা ১৫ হাজার ৫শ’ মাইলেরও বেশি পাড়ি দিতে পারে। সূত্র : ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক
×