ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পর্যালোচনায় ডব্লিউটিও’র চার সদস্যের প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে

সমন্বিত বাণিজ্যনীতি প্রণয়নের উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ৩১ অক্টোবর ২০১৮

সমন্বিত বাণিজ্যনীতি প্রণয়নের উদ্যোগ

এম শাহজাহান ॥ অধিকতর স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে এ রকম একটি সমন্বিত বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) আওতায় বাংলাদেশের পঞ্চম ট্রেড পলিসি রিভিউ সংক্রান্ত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাস করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত একটি খসড়া বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই খসড়া পর্যালোচনায় ডব্লিউটিওর উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল চলতি সপ্তাহে ঢাকায় আসছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য। জানা গেছে, নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন বা পুনর্বিন্যাস একটি স্বাভাবিক কাজ। কোন দেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে প্রভাবিত করে এমন নিয়মকানুন ও রীতিনীতি সমূহের একটি সমন্বিত রূপ হলো বাণিজ্যনীতি। বাণিজ্যনীতি যত স্পষ্ট হয়, ততই তা ব্যবসায়ী ও বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য সহায়ক হয়। এবারের বাণিজ্যনীতির খসড়ায় যেসব বিষয়ে ধারণা দেয়া হয়েছে তা হলো-আমদানি নীতি আদেশ, রফতানি নীতি, বাণিজ্য প্রতিরক্ষা, বিভিন্ন ধরনের সংস্কার, কাস্টমস ও সীমান্ত বিষয়, আন্তর্জাতিক পরিবহন নেটওয়ার্ক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি ও মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার নীতি, ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস সুরক্ষা, গুণগত অবকাঠামো, সরকারী কেনাকাটা, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাণিজ্য উদ্যোগ, মুদ্রা ও বিনিময় হার নীতি, আর্থিক নীতি ও কর কাঠামো, বাণিজ্য সম্পর্কিত অবকাঠামো উন্নয়ন ও সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্ব প্রভৃতি। এছাড়া দেশের শিল্প ও এসএমই নীতি কৃষি ও অন্যান্য খাত বিষয়ক নীতি, বিশ্ববাজারে প্রবেশগম্যতা, আঞ্চলিক বাজারে প্রবেশগম্যতা, বিদ্যমান ও সম্ভাব্য দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের চ্যালেঞ্জ, কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিকার, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক সুরক্ষা, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন, আমদানি ও রফতানি নীতির মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়ও বাণিজ্যনীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বাণিজ্যনীতি এই খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সচিবালয়ের ট্রেড পলিসি রিভিউ ডিভিশনের কাউন্সিলর মি. সারজিয়াস স্টামাস নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আগামী ৪-৮ নবেম্বর বাংলাদেশ সফর করবেন। ওই সময় প্রতিনিধি দলটি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হবেন। শুধু তাই নয়, পুরো বিষয়টি ভালভাবে বিশ্লেষণ তা উপস্থাপনের জন্য সেই সময় জেনেভাস্থ বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ইকোনোমিক মিনিস্টার সুপ্রিয় কুমার কুন্ডু ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। জানা গেছে, ডব্লিউটিওর সদস্য হিসেবে প্রত্যেকটি দেশকেই বাণিজ্য নীতি পুনর্বিন্যাস করতে হয়। এটি হয়ে থাকে বিশ্ব বাণিজ্যে কোন দেশের কতটা অংশগ্রহণ, তার ভিত্তিতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), জাপান ও চীনকে পর্যালোচনা করতে হয় দুই বছর পর পর। উন্নত আরও ১৬টি দেশকে করতে হয় চার বছর পর পর। বাংলাদেশসহ বাকি দেশগুলো করে থাকে ছয় বছর পর। বাংলাদেশের সর্বশেষ বাণিজ্যনীতি পর্যালোচনা হয়েছিল ২০১২ সালে। এবার হচ্ছে পঞ্চমবারের মতো। প্রথমটি হয়েছিল ১৯৯২ সালে। ডব্লিউটিওর নিয়মনীতি অনুযায়ী বাণিজ্য পরিবেশ উন্নয়ন সংক্রান্ত বিধিবিধান প্রত্যেক সদস্য দেশেরই মেনে চলা বাধ্যতামূলক। এর মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, গত ছয় বছরে বাণিজ্যের জন্য সহায়ক অনেক আইন-কানুন করা হয়েছে। কোম্পানি আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এছাড়া এই সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বেশকিছু কৌশল প্রণয়ন করা হয়েছে। ডব্লিউটিওর প্রতিনিধিদের কাছে এসব বিষয় তুলে ধরা হবে। তিনি বলেন, ডব্লিউটিওর প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের বাণিজ্য নীতি পুনর্বিন্যাসের কৌশলে খুশি হবেন। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের রফতানি যেমন বেড়েছে ঠিক তেমনি অন্যান্য দেশ থেকে আমদানিও বেড়েছে। ডব্লিউটিওর রীতিনীতি মেনে বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে আসছে। জানা গেছে, বাণিজ্যনীতি পর্যালোচনা একটি বহুমাত্রিক ও বিশদ কাজ। এটি শুধু বাণিজ্যের মধ্যে আটকে থাকার বিষয় নয়। আমদানি নীতি, রফতানি নীতি, উৎপাদিত পণ্যের মান, পর্যটনশিল্প, আইনী পদ্ধতি, সেবা খাত এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থা কী ধরনের তা-ও এই বাণিজ্যনীতি পর্যালোচনার মধ্যে উঠে আসে। এছাড়া ৩০ থেকে ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এর সঙ্গে জড়িত এবং এটি পর্যালোচনা তৈরির কাজ চলছে গত কয়েক বছর ধরে। এদিকে, বর্তমানে চলমান তিন বছর মেয়াদী (২০১৫-১৮) রফতানি ও আমদানি নীতিসমূহের মেয়াদ এ বছরের ৩০ জুন শেষ হয়েছে। তবে নতুন নীতি কার্যকর না করা পর্যন্ত এই নীতি বহাল রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এবারের বাণিজ্যনীতি পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে প্রধান ও সম্ভাবনাময় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে অগ্রাধিকারমূলক ভিত্তিতে দ্বিপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সম্পন্ন করার বিষয়টি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে এফটিএ করার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়ে নেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া, তুরস্ক, ভুটান, নাইজেরিয়া, মেসিডোনিয়া, মিয়ানমার, মালি ও মরিশাসের সঙ্গে এফটিএ করা নিয়ে আলোচনা করছে সরকার। জানা গেছে, সমন্বিত বাণিজ্য নীতির খসড়ায় ভারত ও চীনসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে রফতানি বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে। আমদানির ক্রমবর্ধমান খরচ মেটাতে ও ব্যালান্স অব পেমেন্ট ঠিক রাখতে বাংলাদেশের বৈদেশিক রেমিট্যান্স ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ভিশন ২০২১ অর্জন করতে হলে সেবা খাতের উন্নয়ন জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে। নতুন নতুন সেবা রফতানিতেও জোর দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাক শিল্পের আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান ভাল। তবে পোশাকের ন্যায্যমূল্য নিয়ে সমস্যা রয়েছে। বিদেশী ক্রেতারা পোশাকের সঠিক দাম দিচ্ছে না। এছাড়া এ খাতের ফরওয়ার্ড লিংকেজ, বিপণন ও নক্সা প্রণয়নে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এতে তৈরি পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্য রফতানির সক্ষমতাও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
×