ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সত্যরঞ্জন সরকার

কর্মজীবনে কর্মক্ষমতার প্রাসঙ্গিকতা

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ৬ মে ২০১৮

কর্মজীবনে কর্মক্ষমতার প্রাসঙ্গিকতা

পরিবারের আয়ক্ষম ব্যক্তিকে ঘিরেই পরিবারের সবার চাওয়া-পাওয়ার লাটাই ঘুরতে থাকে। জীবনের বড় একটা সময় আসে কর্মবিরতি তথা ‘অবসর জীবন’ নামে। অনেকের কাছে অবসর জীবন সুখের, আবার অনেকের কাছে অবসর জীবন নতুন করে শুরু করা। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিটির লাটাইয়ের সুতো শেষ হলেও তার মন থেকে দুশ্চিন্তার কালো মেঘ অপসারিত হয় না, যদি তাঁর আত্মজ কেউ আবার নতুন করে ঘুড়িতে লাটাই সংযোজন করতে না পারে। ঘুড়িটা মাটিতে পড়বে না তো? এভাবনায় তার মনে আস্থা ফিরে আসবে যদি উপার্জনে ভাটা না পড়ে। অবসরের প্রাকমুহূর্তে ব্যক্তিটির কাজে-কর্মে, কথাবার্তায়, চলনে যে দুশ্চিন্তার ছাপ প্রতিফলিত হয় তা আমরা অনুধাবন করি না। কতটুকু ত্যাগের ফসল ফলিয়ে সংসারের চাকা সচল রাখতে পরিবারের আয়ক্ষম ব্যক্তিটি তিল তিল করে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। কর্মশেষে হাসিমুখে ফেরা মানুষটির ওপর প্রশান্তির ছাপ মিললেও ভেতরে ভেতরে যে তিনি বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত তা কাউকে বুঝতে দিতে চাননা। ঘরে ফেরা এ মানুষটির হাসির আড়ালে যে কত বেদনা লুকিয়ে থাকে কেউ তার খোঁজ রাখে না। ‘বুদ্ধিমানরা’ পরিবারের সদস্যদের বুঝতে না দিয়ে ‘শরীরটা খারাপ’-বলে নিজেকে আড়াল করেন। আয়ক্ষম ব্যক্তিটি যদি মহিলা হন বাসায় ফিরে ‘ভাল লাগছে না’ বলে বিছানায় যান অথবা সাংসারিক কাজে মনোনিবেশ করেন। ছেলে মেয়ে পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, সবার কাছে সুখী পরিবারের দৃষ্টান্ত হিসাবে স্বীকৃতি মিললেও সুখ পাখি সেখানে বাসা বাঁধে না। দৈনন্দিন জীবনে কর্মস্থলে এমন কিছু ঘটছে যার রেশ তার সুপ্ত মনের উপর প্রভাব বিস্তার করলেও বাইরে সেটা প্রকাশ পায় না। কখনও উর্ধতনের শাসানি, চোখ রাঙানি, কখনও অধস্তনদের চরম গাফিলতি, অবজ্ঞা সহ্য করেও সংসারের জোয়াল কাঁধে হাসিমুখে সংসার যাত্রা নির্বাহ করতে সে বাধ্য হয়। ¯েœহ সুধায় ভরিয়ে নিজেকে নিংড়ে দিতে সে কসুরবোধ করে না। ‘কর্মক্ষেত্রে তৃপ্তি’ পাশ্চাত্য দেশে বহুল প্রচলিত শব্দ, যার মাধ্যমে কর্মজীবী মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিমাপ করা হয়। কর্মস্থলে যদি মানুষ আনন্দের সঙ্গে, নিজের প্রতিভা অনুযায়ী সৃজনশীল ও রুটিন মাফিক কাজ করতে না পারে অর্থাৎ প্রতি পদে পদে যদি হোঁচট খায় তাহলে ওই মানুষটির মানসিক শান্তির ব্যাঘাত ঘটবে। আমাদের দেশে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আগমন-নির্গমনের সময় অফিসে সবাই তটস্থ থাকেন। বড় সাহেবের ঘরে ডাকপড়া মানে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে ঢোকা-মন খুলে নিজের কথা বলতে পারা সেখানে সৌভাগ্যের ব্যাপার। জ্বী- হুজুর করার যে স্বভাব ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমল থেকে চলে আসছে, আমাদের কর্মক্ষেত্রে আজও তা বিদ্যমান বিশেষত সরকারী অফিস-আদালতে। বড় সাহেবরা তাদের সমর্যাদার পদাধিকারীদের সঙ্গে যেমন ব্যবহার করেন অধস্তনদের সঙ্গে তেমনটি করেন না। ‘আমাকে সমীহ করে চল’ এমন মানসিকতায় অফিসের পাইক, আর্দালি, বরকন্দজ এসব অফিস আদালতের কর্মচারীসহ কেরানীকুলের তটস্থভাব সর্বজনবিদিত। ঝড়ের ঝাঁকুনির মতো দমকা হাওয়া এসব অধস্তনদের ভাগ্যে যখন জোটে তাদের মানসিক শান্তির দফারফাই শুধু ঘটে না- পরিবারের উপরও তার একটা প্রভাব পড়ে। অতএব কর্মক্ষম, কর্মব্যস্ত মানুষটির মানসিকতা যদি বিকারগ্রস্ত হয়, তবে তার প্রভাব পারিবারিক জীবনেও পড়তে বাধ্য। যে মানুষটি সবসময় হাসি-খুশি, প্রাণোচ্ছ্বলে ভরপুর ছিল এক সময় সে পাল্টাতে পাল্টাতে অন্য জগতের মানুষ হয়ে যায়। মুখে হাসি নেই, তেজস্বী চেহারার আড়ালেও বিষণœতার ছাপ, পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও সুসম্পর্কের বাঁধন আলগা, কর্মক্ষেত্রের, অমনোযোগিতা- এসব হরহামেশাই ঘটে থাকে। আবেগনির্ভর মানুষের ক্ষেত্রে মানসিক বিকৃতির চিরন্তন এ রূপটি আজ চির সত্য। কর্মক্ষেত্রে সফল মানুষের সংখ্যা আজ বিরল, নিজের সহকর্মীদের হাতে নাজেহালসহ অপমান অপদস্থ হওয়া নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সে ক্ষেত্রে ধর্ম ও লিঙ্গ ভেদের রংও নতুন মাত্রা পেয়েছে। তটস্থ হয়ে উপরের নির্দেশানুযায়ী কর্মসম্পাদনের পরেও, বিবেকের কষাঘাতে কাজের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে সেখানে আত্মসমর্পণ শুধু আত্মশ্লাঘার বিষয়ই নয় বিবেকবানের কাছে তা আত্মহত্যার সামিল। ভেতরের যন্ত্রণা তাকে স্বস্তি দিতে পারে না। আর এই অস্বস্তির অনলে প্রতিনিয়ত দগ্ধ হতে হতে যদি কেউ মানসিক বিকারগ্রস্ত হয় তাহলে তার জন্য দায়ী কে? কর্মক্ষেত্রে সততার মূল্যায়ন যদি প্রতিশোধ পরায়ণ মানুষের দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় তাহলে সৎ, ন্যায়পরায়ণ, দুর্নীতির প্রশ্নে আপোসহীন মানুষগুলোকে দুরবীন দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে। আত্মমর্যদাসম্পন্ন মানুষ কখনও নিজের বিবেককে বন্দী করে অনৈতিক কর্মকা-ের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে পারে না। বরং সময়ের উল্টোস্রোতেও তারা আজও আমাদের আশার আলো, জাতির বাতিঘর। তাদের বহু অভিধায় অভিষিক্ত করলেও মনের মনিকোঠায় জমে থাকা যন্ত্রণা তাদের প্রতিনিয়ত কুঁড়ে খাচ্ছে। যে আগুন চোখে দেখা যায় না অথচ তার দহন ক্ষমতা এত বেশি যে একটা মানুষকে এক নিমিষেই সে আগুনের আঁচে ঝলসে শেষ করে দিতে পারে। বর্তমান সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভাল কাজের মূল্যায়ন ও তার প্রতি সুবিচার ভাগ্যের ব্যাপার। উর্ধতনের নেকনজরে না পড়লে সারা জীবন ঘানি টেনেও ‘প্রোমোশন’ নামক সোনার হরিণের দেখা মেলে না। ‘প্রমোশন’ শুধু স্ট্যাটাস বাড়ার জন্য নয় বরং সেখানে আর্থিক ব্যাপারটাও জড়িয়ে থাকে। এসব পেতে গেলে ওপর ওয়ালাদের খুশি করতে হয়। হাতধুয়ানীর জলের ব্যবস্থা করতে হয়। এসব অবৈধ লেনদেনের কারবার এমনিভাবে জেঁকে বসেছে যে আজ কাল এটাই বৈধ বলে মনে করে অনেকে। অর্থাৎ চাকরির সঙ্গে প্রাপ্ত ন্যায্য পাওনা আদায়েও আজ অন্যায্য পথে হাঁটতে হচ্ছে। দুর্নীতি না বলে এগুলোকে ভদ্রভাষায় আজ ‘কালো বেড়ালকে দুধ খাওয়ানো’ বলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মানুষ। অফিস আদালতের ঘুষ প্রথা নতুন কিছু নয়, তবে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। নিজেকে যদি ঘুষ দিয়ে, ঘুষখোরের সঙ্গে আপোস করতে হয়, তাহলে এক সময় নিজেই ঘুষখোরের ভূমিকায় যে তিনি নামবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়? লোভের লকলকে জিহ্বা সব সময় নতুন স্বাদ পেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। নীতি ও নৈতিকতার সঙ্গে আপোসকামি মানুষের মেরুদ- কখনও সোজা থাকে না। অন্যায়ের কাছে আপোসকামিতা যদি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায় নীতিবান মানুষেরা সেখানে টিকতে পারে না। বস্তাভরা পচা আলুর ভেতরে একটা ভাল আলু রাখলে সেও পচে যায়। কর্মক্ষম চাকরিজীবীদের মানসিক স্বাস্থ্য কীভাবে ভাল থাকবে বা থাকে তার জন্য দৃষ্টি দেয়া আমাদের কর্তব্য। কারণ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব, সুনাম, সেবা সবকিছুই তো এদের ওপর নির্ভর করে। খিটমিটে মেজাজ, মন বিগড়ানো, সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে ভাল সেবা আশা করা যায় না। কর্মক্ষেত্রে নির্মল পরিবেশ, হাসি মুখে কাজ করার সংস্কৃতি যদি না থাকে, চাকরির খাতিরে চেয়ারকে ব্যবহার করে সর্বেসর্বা হওয়ার মানসিকতা যদি বিরাজ করে, তাহলে সাধারণ জনগণ সেবা পাবে কি করে? সেবাদানে বাধ্যতামূলকভাবে ওপরওয়ালাদেরও নেকনজর থাকতে হবে। খুঁটি মেরে নিজের চেয়ারে বসে সব ঠিকঠাক চলছে বলে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা উর্ধতন কর্মকর্তারাই সব চেয়ে দুর্নীতিবাজ হয়। তাদের ঘিরে কর্মক্ষেত্রে এক শ্রেণী অসৎ, স্বার্থোদ্ধারকারী টাউটবাজের জন্ম হয়, যারা ইঁদুরের মতো গর্ত করে গোলার ধান সব সাবাড় করে। বিড়ালের মতো পাহারাদার অর্থাৎ নজরদারিটা যদি থাকে তাহলে সেবা গ্রহণকারীরাও উপকৃত হবেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সাধারণ জনগণ যেসব জায়গায় সেবা প্রদানকারীর মুখোমুখি হন তারা রাজা- আর প্রজার দৃষ্টিতে সবকিছুই বিচার করেন। অদৃশ্য কোন সে সুতোর জোরে প্রকাশ্যে দুর্নীতি করলেও তিনি পার পেয়ে যান। এ ক্ষেত্রে ‘মাছের মাথা থেকেই যে পচন শুরু হয়’ তা মনে রাখতে হবে। ওই অফিসের বড় সাহেবের যদি দুর্নীতি করার ইচ্ছা না থাকে তাহলে অধস্তনরাও দুর্নীতি করতে পারে না। তবে এ কথা সত্যি সৎ মানুষ, নীতিবান মানুষ এখনও আছে বিধায় সমাজের চাকা সামনে ঘুরছে। কর্মক্ষম মানুষ যারা কর্মক্ষেত্রে কর্মসম্পাদন শেষে নাস্তানাবুদ হয়ে বাড়ি ফেরেন কিংবা কর্মক্ষেত্র থেকে হাসিমুখে বাড়ি ফেরেন এদের প্রত্যেকের স্বভাব, আচার-আচরণ ভিন্নভাবে সংসারে প্রতিফলিত হবে। এ প্রতিফলন গোটা পরিবারের ওপরও ক্রিয়াশীল হবে। বেতন মানসিক শান্তি ও স্বস্তির মাপকাঠি না হলেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে বেতন প্রাপ্তি উচ্চতর স্কেলে প্রমোশনসহ সবকিছুই নির্ভর করে একজন কর্মজীবী মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি কিংবা অবনতি নির্ধারণে। একজন মানুষ হিসাবে কর্ম সম্পাদনান্তে সমাজের অন্য মানুষের সঙ্গে যাতে তার কোন দুরত্ব তৈরি না হয় এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। সুস্থ মন কর্মের প্রেরণা সৃষ্টিতে উদ্দীপ্ত করে। সামনে এগিয়ে চলার রাস্তা যদি মসৃণ হয়- গতির বেগ বাড়িয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই সে তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। কর্মক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি তথা সমাজ রাজনীতির রসায়নে যে দুর্গন্ধ ও দুর্বিনিত অসুরের সৃষ্টি হচ্ছে তার লাগাম যদি এখনই না টানা যায় তাহলে আগামীতে সমূহবিপদ। বর্তমানের কর্মকা- তারই পূর্বাভাস যোগান দিচ্ছে। কর্মসংস্কৃতির শৃঙ্খলা যদি ভেঙে যায় কর্মপ্রেরণার উৎস কর্মক্ষম মানুষগুলোর সততা যদি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দেখা দেয় তাহলে উন্নয়নের জোয়ারেও দেশের অগ্রগতির চাকা থমকে দাঁড়াতে বাধ্য হবে। লেখক : কুয়েত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত
×