
মোরসালিন মিজান ॥ একদমই কথার কথা নয়। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যে যাচ্ছে, তার আরও একটি বড় প্রমাণ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ তার ক্ষুধা-দারিদ্র্যের আলোচনা থেকে বের হয়ে এসে মহাকাশের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ৭ মে দেশের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহটি উৎক্ষেপণ করা হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে টেলিযোগাযোগসহ ৪০ ধরনের সেবা পাওয়া যাবে। আর তাই অনেকদিন ধরেই এ নিয়ে আলোচনা চলছে। এখন যেহেতু বাস্তবায়নের শেষ ধাপ, আবেগ-উত্তেজনা বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে গেছে।
সহজ করে বললে, স্যাটেলাইট হচ্ছে বিশেষ বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভাবিত এক ধরনের কৃত্রিম উপগ্রহ। ট্রান্সমিটার বা রিসিভারও বলা যেতে পারে। তারবিহীন রিসিভার বায়ুম-লের বাইরে নির্দিষ্ট কক্ষে স্থাপন করা হয়। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নিজ অক্ষের ওপর চারদিকে ঘুরে বেড়ায় এটি। তবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় পৃথিবী থেকেই। বেতার তরঙ্গের সাহায্যে কৃত্রিম উপগ্রহে তথ্য পাঠানো হয়। কৃত্রিম উপগ্রহ সেগুলো গ্রহণ করে। শক্তি বৃদ্ধি করে পৃথিবীতে প্রেরণ করে।
আজ এ পর্যায়ে এসে ভাবতে ভালই লাগে যে, অনেক বছর আগে সেই ১৯৯৬ সালে নিজস্ব স্যাটেলাইটের কথা ভাবেত পেরেছিল বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর পরই এই স্বপ্ন দেখার শুরু। একেবারেই নতুন চিন্তা হওয়ায় এটি নিয়ে বিরতিহীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার সমস্যা ছিল। সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিছু হটার নন। তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও মায়ের স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করেছেন।
বর্তমানে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের জন্য রাশিয়ার উপগ্রহ কোম্পানি ইন্টারস্পুটনিকের কাছ থেকে কক্ষপথ (অরবিটাল স্লট) কেনা হয়েছে। মহাকাশের ১১৯ দশমিক ১ পূর্ব দ্রাঘিমায় প্রায় ২১৯ কোটি টাকায় ১৫ বছরের জন্য এই কক্ষপথ কেনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট নির্মিত হয়েছে ফ্রান্সের তালেস এলিনিয়া স্পেস ফ্যাসিলিটিতে।
এর পর থেকে উৎক্ষেপণের অপেক্ষা। আগামী ৪ মে ফ্লোরিডার কেপ কেনাভেরালের লঞ্চপ্যাড থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারী মহাকাশ অনুসন্ধান ও প্রযুক্তি কোম্পানি ‘স্পেসএক্স’র ফ্যালকন-৯ রকেটের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটকে উৎক্ষেপণের কথা ছিল। প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান শাহজাহান মাহমুদ নতুন তারিখের কথা জানিয়ে বলেছেন, স্যাটেলাইটটি আগামী ৭ মে উৎক্ষেপণ করা হবে। এখন পর্যন্ত যে তথ্য আছে, তাতে ওইদিন আবহাওয়া অনুকূলে থাকবে বলে আশা করছেন তারা। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণস্থল ফ্লোরিডায় সরকারের ৪২ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল থাকবে।
জানা যায়, মহাকাশে ৮ দিন ওড়ার পর নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্যাটেলাইটটি স্থাপন করা হবে। এই অভিযানের ব্যাপ্তিকাল ১৫ বছর। ভর ১,৩০০ কেজি। ক্ষমতা ১,৬০০ ওয়াট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে থাকছে ৪০ টি ট্রান্সপন্ডার। এগুলোর মধ্যে ২০টি বাংলাদেশ ব্যবহার করবে। বাকি ২০টি বিদেশী বা প্রতিবেশী দেশের কাছে ভাড়া দেয়া হবে। দেশের ৩৭ স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কাছে ফ্রিকোয়েন্সি বিক্রির মাধ্যমে প্রায় ১২৫ কোটি ডলার আয় হবে। এসব চ্যানেল এখন বিদেশের বিভিন্ন স্যাটেলাইট থেকে ফ্রিকোয়েন্সি কিনে অনুষ্ঠান প্রচার করছে। এতে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তবে এই টিভি চ্যানেলগুলো এখনকার প্রচলিত কেবলভিত্তিক প্রচারের পরিবর্তে ছোট ডিশ এ্যান্টেনার ডাইরেক্ট টিভি সিগন্যাল পাবে।
স্যাটেলাইট পাঠানোর কাজটি বিদেশে হলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা হবে বাংলাদেশ থেকেই। এজন্য গাজীপুরের জয়দেবপুর ও রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ায় দুটি গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা। তবে খরচ ২০০ কোটি টাকার মতো কম হয়েছে বলে জানা যায়। এ উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পর বিদেশী স্যাটেলাইটের ভাড়া বাবদ বছরে ১৪ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে। আশা করা হচ্ছে, আগামী ৭ থেকে ৮ বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের বিনিয়োগের পুরো টাকা উঠে আসবে।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট শুধু কারিগরি বা ব্যবসার বিষয় নয়, এটি আমাদের গর্বের বিষয়। ভবিষ্যতের ভাবনার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এরপর ২, ৩, ৪ নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এখন অপরিহার্য ভাবনা।
এদিকে, স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হওয়ার পর জাতীয়ভাবে তা উদ্যাপন করা হবে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামসহ উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। স্যাটেলাইটের উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান বঙ্গœ্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও সংশিষ্ট কর্মকর্তারা স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করবেন। সব মিলিয়ে দারুণ আনন্দের উপলক্ষ। বড় অর্জন। এগিয়ে চলার এই গল্প অব্যাহত থাকুক।