ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফল করে শিক্ষকতার সুযোগ কম!

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ২৮ এপ্রিল ২০১৮

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফল করে শিক্ষকতার সুযোগ কম!

জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ ‘সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফলে উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীরা সহজেই সেসব বিশ্ববিদ্যালয় এমনকী বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। কিন্তু যে কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফল করে বের হওয়া ছাত্রছাত্রীরা এ সুযোগ পান না। এ বিষয়ে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।’ অনেকটা আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যায়নরত শেষ বর্ষের ছাত্র ফাহাদ হাসান। তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘বুয়েটে প্রতি বছর ৮ থেকে ৯ হাজার ছাত্রছাত্রী ভর্তি পরীক্ষা দেয়, কিন্তু বুয়েটের সিট মাত্র ১ হাজার ২০০টি। তার মানে কী বাকি ৭ হাজার ৮০০ জন খারাপ ছাত্র? তা কিন্তু নয়, বাকিদের তখন কী করতে হয়, অন্যান্য প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে হয়। তারা অনেক ভাল রেজাল্টও করে অনেক সময় তারা নিজেদেরকে বুয়েটের ছাত্রছাত্রীদের থেকেও নিজেদেরকে দক্ষ করে গড়ে তোলে। কিন্তু শিক্ষকতার সুযোগ পাচ্ছেন বুয়েটের ছাত্রছাত্রী।’ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় অনেকেরই দুর্বলতা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার পেশায় অনেক ছাত্রছাত্রী আগ্রহ দেখাচ্ছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীও এর থেকে পিছিয়ে নেই। তবে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া ছাত্রছাত্রী সমান সুযোগ পাচ্ছেন না এই পেশায়। এ ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া সর্বোচ্চ নম্বরধারী ছাত্রছাত্রী। কেন এই বৈষম্য? প্রশ্নের জবাবে রাজধানীর স্বনামধন্য এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাচেলর অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (বিবিএ) হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের এক অধ্যাপক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘যদি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী শিক্ষকতা পেশায় আসতে চায় তারা যেন আগে বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করে আসে। অথবা দেশেই যদি পিএইচডি করতে পারে এবং কোন কর্পোরেট অভিজ্ঞতা থাকে তাহলে তারা সহজেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবে।’ তিনি আরও বলেন, আমরা যে সমস্ত প্রার্থী পাচ্ছি তাদের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে এসেছে এবং যোগ্যতা সম্পূর্ণ। সেইসঙ্গে প্রতিযোগিতা করার মতো তারা, তাদের কর্পোরেট অভিজ্ঞতাও আছে, তারা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাও নিয়ে আসে। তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের বিজনেস স্কুল থেকে যারা গ্র্যাজুয়েশন করেছে তাদের থেকে বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তবে নির্বাচনী বোর্ডে আমরা এ রকম কোন প্রার্থী পাইনি যারা ওদেরকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পেরেছে এখনও। এ জন্য বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিদেশ থেকে ডিগ্রী আনা আবশ্যক। আমাদের দেশে সিটের ঘাটতির জন্য আমি পাবলিকে পড়তে পারলাম না, কিন্তু সেক্ষেত্রে আমার ইচ্ছা যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া, তাহলে প্রাইভেটে পড়ার কারণে সেই ইচ্ছাটা স্বপ্নই থেকে যাবে।’ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ইউ আই ইউ) এ ইংরেজী বিভাগে অধ্যায়নরত শেষ বর্ষের ছাত্র আরাফাত হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাবলিক ইউনিভার্সিটিকে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির থেকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এ জন্য প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোতে পাবলিক ইউনিভার্সিটির থেকে লেকচারার রিক্রুট করার প্রবণতা দেখা যায়। এ ছাড়া প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলো বেশিরভাগ ব্যবসা কেন্দ্রিক এবং তারা এখানে ব্যবসায় ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রোডাক্ট রাখা হয়। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির টিচাররা অনেকাংশেই ভার্সিটির প্রোডাক্ট। আর তাদের ব্র্যান্ড হলো যে তারা পাবলিক ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট। এ জন্য তারা সব কাজের জন্যই যোগ্যতার দাবিদার বলে ভাবা হয়ে থাকে। এটা অবশ্যই বৈষম্য। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন, ‘এর নানাবিধ কারণ আছে। তবে রিক্রুটমেন্ট বোর্ডে যারা থাকেন তারা পাবলিক ইউনিভার্সিটির থাকে, আর তাই পাবলিক ইউনিভার্সিটির যোগ্য প্রার্থী থাকলে তাকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়ে থাকে। তবে ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির কথা যদি বলেন, তাহলে বলতে হবে এখানে নিজেদের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছে।’ প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কতগুলো নীতিমালা অনুসরণ করতে হয় জানিয়ে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক মিলন কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাংলাদেশের একদম শুরুর দিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল খুবই কম। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার যোগ্যতা অনেকেরই ছিল না। সে সময় শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে অগ্রাধিকার পেত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া সর্বোচ্চ নম্বরধারী ছাত্রছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তাদেরকে ওই নির্দিষ্ট বিভাগেই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিত। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিপূর্ণ করতে হতো। পরবর্তীতে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যখন শিক্ষকের দরকার হতো তারা বিজ্ঞাপন দিত এবং বিজ্ঞাপনের বিপরীতে বিভিন্নজন এ্যাপ্লাই করত। সেইসঙ্গে যারা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন তারাও আবেদন জানাত। তখন নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হতো। তবে যারা অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছে তাদের অগ্রাধিকার বেশি থাকত এবং এদের স্থায়ী করা হতো। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশে শিক্ষিত লোকের হার ও বাড়তে থাকে। এখন প্রায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সবাইকে এ্যাপ্লাই করতে হয়। তবে দেখা যায় যে, যেহেতু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা নির্বাচনী বোর্ডে থাকেন এ কারণে শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষক হিসেবে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের প্রসার বৃদ্ধি পায় না কারণ প্রতি বছর স্বল্প সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদেরকে গেলানোর মতো করে পড়ানো হয় বলে মন্তব্য করে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস (ইউল্যাব) বিশ্ববিদ্যালয়ের গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকটা বিভাগে অধ্যায়নরত ছাত্রী জিনিয়া শেখ বলেন, ‘বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী শুনলেই সাধারণ মানুষ ভাবে এরা বোধ হয় খারাপ স্টুডেন্ট। আবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাল ফল করে বের হওয়ার পর চাকরিতে এ্যাপ্লাই করলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে সরিয়ে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদেরকে প্রাধান্য দেয়া হয়। এর কারণ হলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাঠামো অনেক সংক্ষিপ্ত। এ ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের শেখার সুযোগ কম। তাই আমার মনে হয়, যদি কোন স্টুডেন্ট পরে সেই ইউনিভার্সিটির টিচার হয় তখন সে ছাত্রছাত্রীদেরকে তাই সেখাবে যেটা সে শিখে এসেছে। আসলে সত্যি কথা বলতে, আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল এবং ইউনিভার্সিটি লেভেল থেকেই সেই দুর্বল শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই স্টুডেন্টদের উঠিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।’ ক্ষেত্র বিশেষে আবার এটাও দেখা যাচ্ছে, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়কে নিয়োগ বোর্ডে নিয়োগ না দিয়ে বিশতম স্থান অধিকারীকে নিয়োগ দিয়েছে। এখানে কিছু রাজনৈতিক সমীকরণও কাজ করে, এটা বলার অবকাশ রাখে না যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পর্ষদ গঠিত হয়, সেটি একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, তবে ভোটাধিকার থাকে, যখন যেই সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের পছন্দের লোক স্বাভাবিক ভাবেই এটা অলিখিত হলেও সত্য পছন্দের লোক উপাচার্য, উপ- উপাচার্য, নিয়োগ প্রাপ্তি ঘটে, ফলে উনারা তখন উনাদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সুবিধার্থে নিজেদের মতাদর্শের লোককে নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেন। সে ক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায় প্রথম, দ্বিতীয় স্থান অধিকারীকে বাদ দিয়ে বিশতম স্থান গ্রহণকারীকে নিয়োগ দেয়ার দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছে। সুতরাং এটা সর্বদা সত্য নয় যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের টপ রেজাল্ট করা ছাত্র শিক্ষক হয় আবার অসত্য বলা যাচ্ছে না।
×