ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

শিক্ষকরা যখন যাত্রাপালায়

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ১৯ এপ্রিল ২০১৮

শিক্ষকরা যখন যাত্রাপালায়

কত ঘটনা, কত গল্প ছড়িয়ে আছে যাত্রাপালার ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। এবারের বৈশাখ উৎসবে এই যাত্রা নিয়ে এক নবতর আয়োজনের সূচনা হচ্ছে নারায়ণগঞ্জ শহরে। আজ ৬ বৈশাখ নগরীর আমলাপাড়ায় আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষকরা যাত্রাপালায় অভিনয় করছেন। তাদের অংশগ্রহণে সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হবে যাত্রানুষ্ঠান-‘ঈশা খাঁ।’ ক’দিন ধরেই পুরো শহর জুড়ে হই হই কা- রই রই ব্যাপার। চারদিকে হাঁকডাক-‘যাত্রা যাত্রা যাত্রা।’ স্কুলের সামনের রাস্তা দিয়ে যেতে পথচারীদের চোখ পড়ে প্রাচীরে টাঙ্গানো ডিজিটাল ব্যানার ফেস্টুনের দিকে। সেখানে রাজা-বাদশা সেজে দাঁড়িয়ে আছেন আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকা। বাংলাদেশের বহু স্কুল কলেজ নির্মাণের তহবিল গঠনে যাত্রাগানের গৌরবময় ঐতিহ্য আছে। যাত্রার যখন স্বর্ণযুগ ছিল, সেই সময় স্কুল কিংবা কলেজ কর্তৃপক্ষ যাত্রাদল বায়না করে আনতেন। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে যাত্রা চলত একনাগাড়ে ১০-১৫ দিন ধরে। ছাত্রছাত্রীরা পেশাদার যাত্রা শিল্পীদের অভিনয় দেখে ইতিহাসের অনেক ঘটনা জানতে পারত। মুগ্ধ হতো ঝলমলে পোষাক পরা রাজা বাদশাদের মজার মজার কাহিনী জানতে পেরে। সেই যাত্রাগানের টিকেটের পয়সা ব্যয় হত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন না কোন ভবন সংস্কারে। সেই সুদিন এখন আর নেই। সেই ধরনের বিখ্যাত যাত্রার দলও নেই, নামী দামী শিল্পীও নেই, নেই পৃষ্ঠপোষকতাও। সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে এখন সম্মিলিত ঐক্যের ডাক দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষক সম্প্রদায়। তারা বলছেন, যাত্রা আবহমান বাংলার ঐতিহ্য। এই মাধ্যমটিকে কোনক্রমে হারিয়ে যেতে দেয়া যায় না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই পারবে যাত্রার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে। আইডিয়াল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কাশেম জামাল বললেন, এক সময় আমাদের নারায়ণগঞ্জের যাত্রাগানের জোয়ার ছিল। জাতীয় জাগরণ কিংবা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় এ লোকশিল্পের কী প্রচ- শক্তি, সেটা আমরা তখন দেখেছি। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেই শক্তিটা আমরা অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে দেখাব। প্রতিবছরই আমরা চেষ্টা করব আমাদের শিক্ষকদের দিয়ে দুই একবার যাত্রাপালায় অভিনয় করাতে। প্রধান শিক্ষক কবি আনোয়ার হোসেন হাসিমুখে এবং উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা যাত্রাপালায় অভিনয়ের মাধ্যমে যে নতুন ঘটনা জন্ম দিলেন, সেটা আশা করি আরও অনেককে অনুপ্রাণিত করবে। পিন্টু সাহা একজন সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং এই প্রতিষ্ঠানের আবৃত্তির শিক্ষক। তার তত্ত্বাবধানেই তৈরি হয়েছে ‘ঈশা খাঁ’ যাত্রাপালাটি। এখানে তিনি খলনায়ক ‘শাহ্বাজ খাঁ’ চরিত্রে অভিনয় করছেন। তিনি বললেন, বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম ঈশা খাঁর অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, খিজিরপুর, কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি ও একডালা দুর্গে। সাম্রাজ্যবাদী মোগল সেনাপতি মানসিংহকে তিনি দ্বন্দ্ব যুদ্ধে পরাস্ত করেন। কিন্তু নিরস্ত্র মানসিংহের কোন ক্ষতি করেননি। এই দেশপ্রেমিক বীর বাঙালীকে আমরা সমকালীন প্রেক্ষাপটে উপস্থাপন করছি। আমাদের শিক্ষকরা পেশাদার শিল্পী নন, তবে পেশাদারি মনোভাব নিয়ে তারা মঞ্চে অবতরণ করবেন। ভৈরবনাথ গঙ্গোপাধ্যায় রচিত এবং মিলন কান্তি দে নির্দেশিত ঈশা খাঁ যাত্রাপালায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করছেন অংকের শিক্ষক আনোয়ার সাদাত খান, তার মেয়ে মেহেরের চরিত্রে বিজ্ঞানের শিক্ষক ইসরাত জাহান স্নিগ্ধা, বিজ্ঞানের আরেক শিক্ষক আমজাদ হোসেনকে দেখা যাবে সম্রাট আকবরের ভূমিকায়, ডাকাত সর্দার ভবানীর চরিত্রে বাংলা বিভাগের শিক্ষক দেলোয়ার হোসেন এবং তার মেয়ে মহুয়ার চরিত্রে অভিনয় করছেন বিজ্ঞান বিভাগের গুল-এ-জান্নাতুরুমকি। শিক্ষকদের মধ্যে অভিনেতা হিসেবে আরও যারা মঞ্চে আসছেন, তারা হলেন : বিধানচন্দ্র, সুজন মাঝি, মেজবাহ্ উদ্দিন, বাছেদুল আলম, জিয়াউর রহমান জয়, আব্দুল হালিম, মোঃ সোলায়মান, মোক্তার হোসেন, রণজিত সরকার, উম্মে লায়লা, লাকী সাহা, মম, সোনালী। বিবেক চরিত্রে শাজাহান সাজু এবং দশম শ্রেণীর এক ছাত্র প্রীতম দাশও এই পালায় অভিনয় করছেন। চূড়ান্ত মহড়ায় ঈশা খাঁর একটি সংলাপ শোনালেন শিক্ষক-অভিনেতা আনোয়ার সাদাত- ‘অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। ইতিহাসের পাতায় অমর অক্ষয় হয়ে থাকবে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিতে ভাস্বর লাখো লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত আমার এই স্বপ্ন স্বাধীন সোনারগাঁও।’ সবশেষে অংশগ্রহণকারী শিক্ষকরা একই কণ্ঠে বললেন, ‘হারিয়ে যাওয়া বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম ধারা যাত্রাপালায় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমরা আনন্দিত, গর্বিত।’
×